দেশজুড়ে

রাজশাহীতে ফ্ল্যাট কেনা বাড়ি করার ধুম

আধুনিক সড়কবাতির আলোয় আলোকিত, প্রশস্ত রাস্তা, কারুকাজ, সবুজের নান্দনিকতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার এক শৈল্পিক রূপসহ বহুমাত্রিক নাগরিক সুবিধায় অত্যাধুনিক নগরী হিসেবে গড়ে উঠছে রাজশাহী মহানগরী। সৌন্দর্যবর্ধনের পাশাপাশি আধুনিক ও বসবাস উপযোগী নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে চলছে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ।

Advertisement

১২ লাখেরও বেশি জনসংখ্যার প্রায় ৯৭ বর্গকিলোমিটারের এ জনপদে ক্রমশ বাড়ছে উঁচু উঁচু দালানকোঠার সংখ্যা। ক্রমবর্ধমান নগরায়নের ফলে এ শহরে আবাসস্থল তৈরিতে আগ্রহ বাড়ছে মানুষের। প্রতিনিয়ত রাজশাহীতে নতুন করে বসতি গড়তে আসছেন অন্য অঞ্চলের মানুষেরা।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১০ সালের পর থেকেই রাজশাহীর চেহারা বদলে যেতে শুরু করেছে। দীর্ঘ, মধ্য ও স্বল্পমেয়াদি বিভিন্ন প্রকল্পে প্রশস্ত সড়ক, নির্মল বাতাস, নান্দনিক সড়কবাতি, অবকাঠামোগত উন্নয়নের পরিকল্পিত বাস্তবায়নে রাজশাহীর আমূল পরিবর্তন শুরু হয়। এতে রাজশাহীতে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়তে শুরু করে। ফলে গত ১৪ বছরে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার উন্নয়নকাজের পর এ নগরে এখন ১০ থেকে ২১ তলা পর্যন্ত বহুতল ভবনের সংখ্যা শতাধিক। তার আগে বহুতল ভবন বলতে নগরীর সিঅ্যান্ডবি মোড় এলাকায় জীবন বীমা করপোরেশনের ১০ তলা ভবনটিই শুধু ছিল।

বর্তমানে জমির মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি ফ্ল্যাটের নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। আগে ৪০-৬০ লাখ টাকার মধ্যে রাজশাহীতে ভালোমানের ফ্ল্যাট পাওয়া গেলেও বর্তমানে তা ৭০-৮০ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তারপরও এ নগরীর নানান সুবিধার কারণে এখানেই ছুটে আসছেন মানুষ। বিশেষ করে নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঢাকা, সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের মানুষ বেশি আসছেন। সবচেয়ে বেশি আসছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর লোকজন। এছাড়া ঢাকা থেকে চাকরি জীবন শেষে করে একটু শান্তিতে বসবাসের জন্য অনেক অবসরপ্রাপ্তরাও এখন বেছে নিচ্ছেন এ শহর।

Advertisement

রাজশাহী নগরীর বহরমপুর এলাকায় একটি বাড়ি কিনেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাসিন্দা সুফিয়া খাতুন। তিনি বলেন, ‘আমাদের চাঁপাইনবাবগঞ্জে তেমন ভালো স্কুল নেই। তেমন সুযোগ-সুবিধাও নেই। তাই ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে আমরা রাজশাহীতে এসেছি। এখন বেশ ভালো লাগছে। স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য এখানে বাড়ি নিয়েছি।’

নওগাঁ থেকে এসে রাজশাহীর ভদ্রা আবাসিক এলাকায় বসবাস করছেন নাসির উদ্দিন। তিনি সাবেক সরকারি কর্মকর্তা। কাজের সুবাদে এ জেলায় এসেছেন। শহরটি পছন্দ হওয়ায় শেষ জীবনটা এখানেই কাটিয়ে দিতে চান তিনি।

নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমার অবসরের টাকা দিয়ে একটি ফ্ল্যাট কিনতে চাই। তবে এখনো তেমন সুযোগ হয়ে ওঠেনি। এখনো ভাড়া বাড়িতে আছি। তবে এখানেই থেকে যাবো।’

রাজশাহীতে থেকে যাওয়ার কারণ হিসেবে সাবেক এ সরকারি কর্মকর্তা বলেন, ‘এখানে যানজট নেই। নাগরিক সুযোগ-সুবিধা আছে। নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ থাকায় শহরটি আমার কাছে বেশ ভালো লেগেছে। তাই এখানে থেকে যাবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

Advertisement

রাজশাহীর সাহেব বাজারে বসবাস করেন সিরাজগঞ্জের সুধীর বাবু। তিনিও এখানে একটি বাড়ি নির্মাণ করছেন। সুধীর বাবু বলেন, ‘ব্যবসায়িক কাজে প্রায়ই রাজশাহী আসতে হতো। সেই থেকেই এই শহরের প্রেমে পড়া। এরপর আর মায়া ত্যাগ করতে পারিনি। এখন একটি ছোট জমি নিয়ে এখানেই বসবাস করতে চাই। আশা করছি, আগামী বছর থেকে এখানেই নিজের বাড়িতে আমরা বসবাস করতে পারবো।’

আবাসন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিক্ষানগরী রাজশাহীর স্বাস্থ্যকর পরিবেশে নিজের আবাসনস্থল নির্মাণে জনগণের আগ্রহ ক্রমেই বাড়ছে। ফলে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার মানুষ পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি এ নগরীতে ফ্ল্যাট কিনতে চাচ্ছেন। ফলে আবাসন শিল্পে একটা অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজশাহীতে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৬০০ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাট বেশি তৈরি করে থাকে। আগে ৪০-৬০ লাখ টাকার মধ্যে রাজশাহীতে ভালোমানের এমন ফ্ল্যাট পাওয়া যেতো। কিন্তু বর্তমানে তা ৭০-৮০ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাড়তি দামের কারণে রাজশাহী অঞ্চলের সীমিত আয়ের মানুষদের ফ্ল্যাট কিনতে কষ্ট হচ্ছে। এছাড়া রেজিস্ট্রেশন ও অফিসিয়াল খরচও বেড়েছে।

রাজশাহীতে আবাসনের ৭০-৮০ শতাংশ কাজ করে থাকেন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড ডেভেলপার্স অ্যাসোসিয়েশনের (রেডা) সদস্যরা। তাদের প্রায় চার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে।

রাজশাহীর আবাসন ব্যবসায়ীদের এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ও আল-আকসা প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান কাজী বলেন, ‘রাজশাহী শহরে আবাসন ব্যবসা হচ্ছে রাইজিং সেক্টর। এছাড়া এই শহরে মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের বসবাস। তারা তাদের সীমিত আয়ের মধ্য থেকেই একটি ফ্ল্যাটের স্বপ্ন দেখেন। আমরাও তাদের টার্গেট করেই আবাসন ব্যবসা পরিচালনা করে থাকি। মধ্যবিত্তরা যেন কিনতে পারেন, সে অনুযায়ী ফ্ল্যাট ও প্লটের দাম নির্ধারণ করা হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘রাজশাহীতে ডাক্তার, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তারাই সবচেয়ে বেশি ফ্ল্যাট কিনছেন। বিশেষ করে রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্রেতা বেশি। তারা এই শহরে বসবাসে বেশি আগ্রহী।’

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘সবুজ, পরিচ্ছন্ন, বাসযোগ্য ও আলোকিত নগরী হিসেবে রাজশাহীর সুনাম সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বাসযোগ্য ও শান্তির শহরে বসবাস ও উন্নত নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পেতে দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ এসে রাজশাহীতে বাড়ি নির্মাণ করছেন। কেউ কেউ ফ্ল্যাট কিনছেন।’

তিনি বলেন, ‘দ্রুত নগরায়নের ফলে যাতে রাজশাহী শহরের অবস্থা ঢাকার মতো না হয়, নগরীর যানজট পরিস্থিতি বৃদ্ধি না পায়, সেই বিষয়টি আমরা খেয়াল রেখেছি। নগরীর আয়তন বর্তমানের চেয়ে প্রায় চারগুণ বৃদ্ধির কাজটি প্রক্রিয়াধীন। নগরীর বিভিন্ন রেলক্রসিংয়ে ফ্লাইওভার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পরিকল্পিত নগরায়ন ও উন্নয়নে আমরা কাজ অব্যাহত রেখেছি।’

সাখাওয়াত হোসেন/এসআর/এমএস