ছাপা বইয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ই-বুকের চাহিদা। প্রযুক্তির আবির্ভাবে পাঠকের রুচি, পাঠাভ্যাসে এসেছে পরিবর্তন। সেই সঙ্গে জনপ্রিয় হচ্ছে ই-বুক। মোবাইলে বই পড়া কিংবা বইয়ের পডকাস্ট ও অথবা অডিও বুক সব প্লাটফর্মেই বইপ্রেমীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এবার অমর একুশে বইমেলায় একাধিক ই-বুক প্ল্যাটফর্মের ৫টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেই স্টলগুলোতে সরব উপস্থিতি বইপ্রেমীদের।
Advertisement
বাংলা একাডেমী সূত্রে জানা যায়, এবার মেলার বাংলায় একাডেমী অংশে কাব্যিক, বইচিত্র, শুনবই, বইঘর, রকমারি অডিও বুক ও ই-বুকের স্টল রয়েছে।
এই স্টলগুলো ঘুরে দেখা গেছে, সাজসজ্জ্বা করে ইলেকট্রনিক বিভিন্ন ডিভাইসের মাধ্যমে অডিও বুক ও ই-বুককে পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে স্টলের দায়িত্বে থাকা লোকজন। দর্শনার্থীরা এসে ডিভাইস থেকে অডিও বই ও ই-বুক ব্যবহার করার নিয়ম সম্পর্কে জানছেন। স্টলে রাখা ডিভাইসে স্ক্রল করে বই দেখছেন তারা।
স্টলে থাকা লোকজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই স্টলগুলোতে বইয়ের অ্যাপ ডাউনলোড এবং অডিও বুক কেনার সুযোগ থাকছে। সেখানে পাঠকরা এক মাস থেকে শুরু করে বিভিন্ন মেয়াদে সাবস্ক্রিপশন করে বই পড়তে কিংবা শুনতে পারবে। অডিও বুক ও ই-বুক সব বয়সী পাঠকের বই পড়ার চাহিদা মেটাবে। এছাড়াও বইমেলা উপলক্ষে বিভিন্ন রকম ছাড়ের কথা জানিয়েছেন তারা।
Advertisement
কাব্যিক অডিও বুক স্টলের ব্র্যান্ড প্রমোটার ফিরোজ আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, কাব্যিকের যাত্রা শুরু ২০২২ সালের বইমেলা থেকে। আমরা সব বয়সী মানুষের থেকে সাড়া পাচ্ছি। মাত্র ২১ টাকা দিয়ে সাবস্ক্রাইব করে ৫০০ এর বেশি অডিও বই শুনতে পারবে। বিশেষ করে অনেক অসুস্থ মানুষ আছে পড়তে কষ্ট হয় তখন তারা শুনতো পারবে। যারা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী তারাও অনেক বেশি উপকৃত হবে।
একাডেমী চত্ত্বরের আরেকটি স্টল বইচিত্র। এটির ব্র্যান্ড পার্টনার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘টিকটক’। এখানকার দায়িত্বে থাকা ইফরান জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের এখানে সব বই ফ্রি। পাঠককে শুধু সফটওয়্যার অর্থাৎ বইয়ের অ্যাপসটি ইনস্টল করে নিতে হবে। আমাদের একশর বেশি ই-বুক ও ৩০টি অডিও বুক রয়েছে। মেলার শুরু থেকে প্রায় প্রাত ২০০০ পাঠক এটি ইনস্টল করেছেন।
তিনি বলেন, ছাপা কাগজের বইয়ের চাহিদা কিন্ত কমবে না। তবে ই-বুকের নির্দিষ্ট পাঠক বা শ্রোতা আছে। গত কয়েক বছর থেকেই মেলায় ই-বুক বা অডিও বুক স্টল দিয়ে আসছে তারা। এটি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হবে।
বইঘর স্টলের বিক্রয়কর্মী জান্নাত ফাতেমা বলেন, আমাদের অডিও এবং ই-বুক দুই ধরনের বই-ই আছে। ২০০০ এর মত বই রয়েছে যেগুলো সাবস্ক্রাইব করে পড়তে পারবে। এছাড়াও ২০০টি অডিও বুক রয়েছে সেগুলো আলাদা আলাদা কিনে পড়তে হবে। আমাদের অ্যাপসে থ্রিলার, ফ্যান্টাসি, রুপকথা, গল্প, উপন্যাস, রোমান্সসহ বিভিন্ন ধরনের বই আছে। ১৩ দিনে ৩০০ এর বেশি পাঠক আমাদের এই অ্যাপস মোবাইলে ইনস্টল করে সাবস্ক্রিপশন করেছেন।
Advertisement
তিনি আরও জানান, মেলার শুরু থেকেই অনেক সাড়া পেয়েছি। মূলত অ্যাপসকে রিপ্রেজেন্ট করছি। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০০ জন পাঠক পেমেন্ট করে বই কিনেছেন।
শুনবই স্টলের কর্মী জান্নাতুল ফেরদৌস জাগো নিউজকে বলেন, গত বছর প্রথম প্রথম মেলায় স্টল দেয় আমাদের প্রতিষ্ঠান । গতবছর ৭০০ এর মত বই ছিল। নতুন ৩০০ এর বেশি বই যুক্ত হয়েছে। আমাদের বই শুধুই শোনা যাবে । মেলায় প্রথমার্ধে ৭০০ এর বেশি পাঠক অ্যাপস ইনস্টল করে সাবস্ক্রিপশন করেছেন। মেলা উপলক্ষে আমাদের মাত্র ১০ টাকা দিয়ে এক হাজার বই শোনা যাবে। এটির মেয়াদ থাকবে এক মাস পর্যন্ত। এছাড়াও ৬০০ টাকায় এক বছরের জন সাবস্ক্রিপশন করতে পারবে পাঠকরা।
শুনবই স্টলের সামনে কথা হয় রাজধানীর সামসুল হক খান স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আশিক আল রাফির সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, অডিও বুক বা ই-বুক আগে কখনও পড়া হয়নি। যদিও মোবাইলে পিডিএফে পড়েছি অনেক বই। একটা বই দেখে পড়ার চেয়ে অডিও শুনলে অনেক বেশি প্রভাব ফেলে।
তিনি বলেন, আমি নিজের কথা যদি বলি, অনেক সময় দেখা যায় বাসায় রাতের বেলা তাড়াতাড়ি লাইট অফ করতে হয়। তখন ছাপা বই পড়ার সুযোগ নেই। দেখা গেছে তখন অডিও বুক আমি শুনতে পারবো। এছাড়া ঢাকা শহরের জ্যাম তো নিত্যদিনের। জ্যামে বসে থাকলে অনেক সময় বই থাকে না, বই থাকলেও পড়ার মত অবস্থা থাকে না। তখন অডিও বুক শোনার সেরা সুযোগ। এছাড়াও ট্রাভেল করার সময় পড়তে পারবো বা শুনতে পারবো, এটা ভালো লাগে। অন্যদিকে, ছাপা বইয়ের আবেদনও কখন ফুরাবে না। এক্ষেত্রে ব্যক্তি বা পরিস্থিতি নির্ভর করে। ই-বুক আর ছাপা বই একে অপরের পরিপূরক।
কাব্যিক স্টলের সামনে কথা হয়, অভিনেতা ও ব্যাবসায়ী তানভির আহমেদের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, 'ই-বুক বা বইয়ের পডকাস্ট এখন সব বয়সী মানুষ-ই ব্যবহার করছে। আমার ক্ষেত্রে বিশেষ করে বয়স হয়েছে তাই কাগজের বই পড়ার সেই শক্তি বা সামর্থ্য কম। তবে কাগজের বই পড়ার মধ্যে এক ধরনের স্যাটিফেকশন কাজ করে যেটা ই-বুকে আসে না। আবার ব্যস্ত থাকা অবস্থায় বই শুনতে ভালো লাগে।
অন্যদিকে, এবছর মেলার প্রাণ কাগজের বই অনেক বিক্রি হচ্ছে। বড় বড় প্যাভিলিয়ন ও প্রকাশনীগুলোতে ক্রেতাদের ভিড় লক্ষণীয়। তবে ছাপা বইয়ের চাহিদা কখনো ফুরাবে না বলে মনে করছেন মেলার অনেক পাঠক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী জোনায়েদ খান জাগো নিউজকে বলেন, সৃষ্টি আদিকাল থেকেই ছাপা কাগজ বা ছাপা বইয়ের যাত্রা শুরু। তবে এখন প্রযুক্তির যুগে মোবাইল সহজ হওয়ায় পাঠকরা খুব সহজেই মোবাইলে বই পড়ছেন। হাজার হাজার পৃষ্ঠার উপন্যাস চোখ বুলিয়ে পড়ে ফেলছেন। শুধু নাম মাত্র মূল্যে মোবাইলে হাজার হাজার বই রাখতে পারছেন। যখন খুশি তখন পড়তে বা শুনতে পারছেন৷ এতে করে ছাপা কাগজের বই তাকে বহন করা লাগছে না।
তিনি বলেন, অন্যদিকে ছাপা কগজের বইয়ের চাহিদা পাঠকের এখন পছন্দের শীর্ষে। বই পড়ার আত্নতুষ্টি এখানে৷ মেধা ও মনোযোগী হয়ে বই পড়তে ছাপা বই সেরা। এছাড়াও গবেষণা কিংবা একাডেমিক যে কোনো বিষয়ে ছাপা বইয়ের প্রয়োজনীয়তা অনবদ্য।
জানা যায়, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দেশে ই-বুকের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১১ সালে।
আরএএস/এসএনআর/জেআইএম