উদাসী সময় পার করছিলাম পড়ার টেবিলে বসে। খুব আনমনে বিচরণ করছিলাম স্মৃতির ঘরটায়। স্মৃতির শহরটাতে। এমন সময় একটা কণ্ঠ ভেসে আসে কর্ণকুহরে। যেন ভীষণ পরিচিত। সমস্ত শরীর-মন শিউরে ওঠে। বহুকাল হলো শোনা হয়নি এমন সুর। আমি তাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছি। এই সুরের কাছে মুহূর্তেই হার মানে সমস্ত উদাসীনতা, জরা-জীর্ণতা। ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ি সেই কণ্ঠকে কাছ থেকে দেখার জন্য। শোনার জন্য। তড়িঘড়ি ছুটে যাই। দূরে নয় খুব। জানালার ফাঁক গলেই আসছিল।
Advertisement
জানালার ওপাশে যেতেই চমকে যাই। চোখ ছানাবড়া হওয়ার জোগাড়। যা দেখলাম তা অবিশ্বাস্য, কিন্তু আরাধ্য। কংক্রিটের শহরে এমন দৃশ্যপট আগে কখনো চোখে পড়েনি। মনে পড়ছে না। চোখে পড়লে মনেও পড়তো। এখানে বাতাস ভারী হয় ধূলো আর গন্ধে, ফুলের গন্ধ কোথায় পাই? তাই এটা ফুলের নয়, ধূলোর শহর। এমন গান, এমন সুর আগে কখনো কানে আসেনি। যা এসেছে তা কেবলই যানবাহনের বিকট চিৎকার। তাই এটা মৌমাছি কিংবা পাখিদের নয়, যন্ত্রের শহর। অথবা যান্ত্রিক শহর। এখানে দুরন্তলোক থাকে ঘরবন্দি হয়ে। থাকে মুঠোফোনে বন্দি হয়ে। আর যেখানে দুরন্তপনা নেই; সেখানে প্রেম কোথায় পাই?
যানবাহনের কোলাহলে, এই ব্যস্ত শহরে ফুলের গন্ধে মেতে থাকা, পাখি কিংবা মৌমাছির গানে বিভোর হওয়া, কিংবা দুরন্তলোকের দুরন্তপনার দৃশ্যপট উপভোগ করাটা অনেকটা স্বর্গ দর্শনের মতোই। তাই একে স্বর্গ দর্শন বলা চলে। কারণ সেখানে যেতেই দেখি একদল দুরন্তলোক কারো মিষ্টি গানে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আছে। ওদের মাথার ওপরে বটগাছ। কী সুন্দর নতুন নরম সবুজ পাতা। দখিনা হাওয়ায় দুলছে সবকটা ডাল, পাতা। বৃষ্টির মতো ঝরছে ফুল—যেন পুষ্পবাদল। সেই বৃষ্টিতে স্নান করছে ওরা; যেন চাতক। ওদের সঙ্গে কখন যেন আমিও মিশে যাই। টের পেলাম না।
অবিরাম পুষ্পার্ঘ চলছে। বইছে দখিনা হাওয়া। হাওয়ার সঙ্গে ভেসে আসে বসন্তদূতের মিষ্টি সুর। সবকিছু মিলেমিশে একাকার। আমি টের পাই আমি হারিয়ে যাই এই সবকিছুতে। হারিয়ে যেতে যেতে খুঁজে পাই আমার চিরচেনা ‘আমি’কে।
Advertisement
ফুলের গন্ধে ভেসে যায় চারপাশ। পাখি ও মৌমাছির গানে ভেতরে কেমন একটা দহন সৃষ্টি হয়, প্রেমের দহন। দখিনা হাওয়ায় সেই দহন আরও বেড়ে যায়। বেড়ে দ্বিগুণ হয়, দ্বিগুণ থেকে বহুগুণ। সমস্ত শরীর-মন যেন তার গানের সম্মোহনে সম্মোহিত। এমন সম্মোহনের তীর আমায় পাড়াগাঁয়ের দিনগুলোয় বিঁধতো। বসন্ত এলেই ধুম পড়ে যায় পাড়াগাঁয়ে।
পাড়াগাঁয়ে বসন্তের আমেজ যেন সবার থেকে একটু ভিন্ন। যুবা কিংবা বৃদ্ধ সবাই মেতে ওঠে বসন্ত বরণে। পাড়াগাঁয়ে বসন্ত মানেই শিহরণ। কেননা ঝরাপাতার দিন ফুরিয়েই আসে বসন্ত। অতিথি পাখির বিদায় আর দেশীয় পাখির আনাগোনা নিয়েই আগমন ঘটে ঋতুরাজ বসন্তের। তরুণ-তরুণীর মাঝে রব রব সাড়া পড়ে যায়। উঠতি বয়সীরাও যেন সবুজ পত্র-পল্লবের মতোই পায় নতুন আমেজ।
বিকেলের দখিনা হিমেল হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দেয় পাড়াশুদ্ধ সকলে। ঝি-বউদের মাঝে বিয়ের আগের জীবন নিয়ে চলে আফসোসের গল্প। পুরোনো দিনের বাউল গান গাইতে গাইতে সন্ধ্যা গড়ায় যুবাদলের। নদীর ওপার থেকে ভেসে আসে বাঁশির সুর। উদোম গায়ে মনের সুখে বাঁশি বাজায় যুবক। তার বাঁশির সুরে মন্ত্রমুগ্ধ থাকে নদীর ঢেউ।
বন-বাদাড় থেকে ভেসে আসে কোকিল, ময়না, টিয়া, দোয়েল, কোয়েল, চড়ুই, বুলবুলির সুর। তাদের কিচিরমিচির ধ্বনিতে ঘুম ভাঙে প্রতিদিন। তাদের সুরে যেন শুনতে পাই বাংলা ও বসন্তের জন্য প্রবাসীর আর্তনাদ। বাংলার জন্য তাদের মন যেন হু হু করে কেঁদে ওঠে। শুনতে পাই শহরতলির ইট-বালুর মিশেলে চাপা পড়া প্রাচীন বাংলার আগেকার সেই বসন্তকথা। সবাই মিলে একইসঙ্গে যেন বাংলার সেই আগেকার বসন্তের কাছে ফিরে যেতে চায়।
Advertisement
সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে বাংলার রূপ-রেখা, আবহ যেমন ভিন্ন; তেমনই বাংলায় অন্য পাঁচটা ঋতুর তুলনায় বসন্তের রূপ-রেখা, আবহও একটু ভিন্নরকমের। তাই শীতের রিক্ততা ডিঙিয়ে বাংলায় বসন্ত এলেই মানুষ, পাখপাখালি, গাছপালা সবকিছুর মধ্যে একটা নতুন আমেজ চলে আসে। সর্বত্র মানুষের মধ্যে জেগে ওঠে মাটির প্রতি টান। অজান্তেই তাই একযোগে সবাই গেয়ে ওঠে বাংলার সেই চিরচেনা গান—‘আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাইআমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই’।
এসইউ/জেআইএম