দেশজুড়ে

রিকশাচালক স্বামী ফেরদৌসের ভালোবাসায় ধন্য শিক্ষক স্ত্রী

স্বামীর মতো স্ত্রীও অর্থ উপার্জন করবে এই বিষয়টি আমাদের সমাজে এখনও সহজভাবে নেওয়া হয় না। আবার স্বামীর চেয়ে স্ত্রীর কর্ম বা পদমর্যাদা উন্নত হলে পরিবার বা আশপাশের মানুষ সেটি সহজভাবে নিতে পারেন না। প্রতিদিনই পত্রিকার পাতা খুললে স্বামী দ্বারা স্ত্রীকে নির্যাতনের রগরগে খবর চোখে পড়ে। এতো প্রতিকূলতার মাঝে এক ব্যতিক্রমী পুরুষ বগুড়ার গাবতলী উপজেলার বাঘবাড়ি গ্রামের রিকশাচালক ফেরেদৌস।

Advertisement

ছোট থেকে ফেরদৌসের ইচ্ছা ছিল লেখাপড়া শেষ করে পুলিশ কর্মকর্তা হওয়ার। কিন্তু অভাবের কারণে নবম শ্রেণি পাসের পর সংসারের হাল ধরতে রিকশার প্যাডেল মারতে শুরু করেন তিনি। এরপর পারিবারিকভাবে ২০০৯ সালে রিকশাচালক ফেরদৌসের সঙ্গে ধুনট উপজেলার সীমানুর খাতুনের বিয়ে হয়। ওই সময় তার স্ত্রী ছিলেন এসএসসি পাস। কষ্টার্জিত আয় দিয়ে ফেরদৌস শুধু সংসারই চালাননি, স্ত্রীকে করেছেন সুশিক্ষিত। রিকশা চালিয়ে স্ত্রীর ভরণপোষণ ও লেখাপড়া চালিয়েছেন। দেখিয়েছেন এভাবেও ভালোবাসা যায়।

স্বামীর রিকশায় চড়েই স্ত্রী যাতায়াত করতেন কলেজে। সংসারে বাড়তি আয় করতে সীমানুর পড়ালেখার ফাঁকে দর্জির কাজও করেছেন। ধুনট কলেজ থেকে বিএ পাসের পর মাস্টার্স সম্পন্ন করতে ভর্তি হন বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী সরকারি আজিজুল হক কলেজে। সেখানে ইসলামের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক বিভাগ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে মাস্টার্স পাস করেন সীমানুর।

রিকশাচালক ফেরদৌস ও তার স্ত্রী সীমানুরের জীবন সংগ্রাম নিয়ে একটি সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ পেলে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর চোখে পড়ে। বিষয়টি জেনে প্রধানমন্ত্রী সীমানুরের চাকরির ব্যবস্থা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৫ জানুয়ারি (সোমবার) বগুড়া জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম সীমানুরের হাতে স্কুল শিক্ষকের নিয়োগপত্র তুলে দেন। পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে সীমানুর জেলার অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কালেক্টরেট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রাথমিক শাখার সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান করেন।

Advertisement

বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের ক্রীড়া প্রতিযোগিতার অনুশীলন শেখাতে ব্যস্ত সীমানুর। শিশুরাও তাকে অনুসরণ করে আগ্রহ নিয়ে পিটি-প্যারেড করছে। প্রতিদিন সকাল থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত বিদ্যালয়ে পাঠদান করান সীমানুর।

অনেকের কাছেই ভালোবাসার কোনো নির্দিষ্ট সংঙ্গা নেই। তবে গাবতলী উপজেলার বাঘবাড়িতে টিনের চালের আধাপাকা ওই দুই ঘরে ভালোবাসার সংঙ্গা গড়েছেন এই দম্পতি। দীর্ঘ এক যুগের সংগ্রামে সমাজের নানা মানুষের চোখরাঙানি উপেক্ষা করতে হয়েছে। রিকশার প্যাডেল ঘুরিয়ে, রোদ পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে কষ্টার্জিত আয়ে স্ত্রীকে পৌঁছে দিয়েছেন স্বপ্নের দুয়ারে।

এমন সাফল্যের পর প্রথম বসন্ত ও ভালোবাসা দিবস এই দম্পতির। ফাগুনের হাওয়ায় ভালোবাসার রঙ ডালা মেলেছে ফেরদৌস-সীমানুরের মনে। তাই এই দিনে সীমানুরের সব আবেগ ভালোবাসার মানুষ ফেরদৌসকে ঘিরে।

স্ত্রীর এমন অভাবনীয় সাফল্যে আনন্দের সীমা নেই ফেরদৌসের। তিনি বলেন, নিজে পুলিশ হওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল। তবে অভাবের জন্য লেখাপড়া করতে পারিনি। বিয়ের পর দেখলাম স্ত্রীর এসএসসিতে ফলাফল ভালো। তখনই সিদ্ধান্ত নিই যত কষ্ট আসুক তাকে পড়াশোনা করিয়ে সুশিক্ষিত করবো। এরপর রিকশা চালিয়ে সেখান থেকে টাকা বাঁচিয়ে তাকে লেখাপড়া করিয়েছি। সেও দর্জির কাজের পাশাপাশি অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করেছে।

Advertisement

তিনি বলেন, কখনোই তাকে একসঙ্গে সব বই কিনে দিতে পারতাম না। একটি একটি করে বই কিছুদিন পরপর টাকা জমিয়ে কিনতে হতো। আজিজুল হক কলেজের শিক্ষকরা অনেক আন্তরিক। স্ত্রীর ক্লাসের সময় যখন কলেজে অপেক্ষা করতাম তখন উনারা রিকশায় চড়তেন। আমার গল্প শুনে বাহবার পাশাপাশি সবরকম সহযোগিতা করতেন। স্ত্রীকে লেখাপড়া করানোর জন্য অনেকে অনেক কটুকথা শুনিয়েছেন। ওইসব কথার তোয়াক্কা করিনি।

ভালোবাসার সংঙ্গা জানতে চাইলে ফেরদৌস বলেন, অন্তর থেকে আবেগ ইচ্ছা দ্বারা কাউকে চেয়ে থাকলে সেইটা ভালোবাসা। মানুষ কী বলছে সেটা না ভেবে নিজের বিবেক দিয়ে সীমানুরের প্রতি আত্মবিশ্বাস রেখে লেখাপড়া করিয়েছি, এটাই আমার ভালোবাসা। তাই বিশ্বাস মানেই ভালোবাসা, যারা বিশ্বাস করতে পারে না তারা ভালোবাসতেও পারবে না।

সীমানুর খাতুন বলেন, আমার স্বামী আমার জন্য যা করেছে তার প্রতিদান দেওয়াই এখন জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। আমার প্রতি উনার পরিশ্রম ও ভালোবাসা এই পৃথিবী খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা দিয়ে শেষ করতে পারবো না। উনি মমতাময়ী, সৃষ্টিকর্তা প্রধানমন্ত্রীকে শতবর্ষ আয়ু দান করুন।

ভালোবাসার সংঙ্গা জানতে চাইলে সীমানুর বলেন, মনের সঙ্গে মনের মিলই ভালোবাসা। ভালোবাসা এমনই দুর্লভ, পৃথিবীতে অনেকে চেয়েও পায় না। তবে আমি ভাগ্যবতী, আমার স্বামীর ভালোবাসা পেয়েছি।

কালেক্টরেট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আল মামুন সরদার বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে জেলা প্রশাসক সীমানুরকে এই স্কুলে নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি খুবই নীবিড়ভাবে শিক্ষার্থীদের যত্ন ও পাঠদান করেন। তার স্বামীর পরিশ্রম ও স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা সত্যিই অনুকরণীয়।

এফএ/জেআইএম