দেশজুড়ে

এন্ড্রু কিশোর একুশে পদক পাওয়ায় খুশি পরিবারের সদস্যরা

রাজশাহীর সন্তান প্লেব্যাক সম্রাট এন্ড্রু কিশোরের পরপারে পাড়ি জমানোর তিন বছর হলো। রাজশাহীতে জন্ম বলেই হয়তো এত অবহলো। গত তিন বছরে এন্ড্রু কিশোরের স্মরণে তেমন কোনো আয়োজনও চোখে পড়েনি। এমনকি এই ব্যক্তির নামে তেমন কোনো স্থাপনা বা সরণিও ছিল না। এ নিয়ে বেশ অক্ষেপ ছিল রাজশাহীর সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। তবে সব জল্পনা-কল্পনা শেষ করে অবশেষে একুশে পদক পাচ্ছেন এই গুণী শিল্পী। একুশে পদক পাওয়ায় বেশ খুশি শিল্পীর পরিবার ও স্বজনরা।

Advertisement

মঙ্গলবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে একুশে পদকের জন্য মনোনীতদের নাম ঘোষণা করা হয়। কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোরসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ১৯ বিশিষ্ট ব্যক্তি ও দুটি প্রতিষ্ঠান চলতি বছর (২০২৪) একুশে পদক পাচ্ছেন। এর মধ্যে শিল্পকলার এন্ড্রু কিশোর (মরণোত্তর) পাদক লাভ করেন।

‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’- মৃত্যুর প্রায় আড়াই বছর পূর্বে হুইলচেয়ারে বসে একটি মঞ্চে উঠে গানটি গেয়ে শ্রোতাদের শুনিয়ে ছিলেন বাংলার প্লেব্যাক সম্রাট এন্ড্রু কিশোর। গাইবার সময় তিনি নিজে যেমন কেঁদেছিলেন, তেমনি কাঁদিয়েছেন শ্রোতাদেরও। মৃত্যুর আগে ওই গানটিই ছিল তার শেষ গাওয়া গান। কোটি কোটি হৃদয়ের প্রাণের মানুষ এন্ড্রু কিশোর সব ভক্ত ও শ্রোতাকে কাঁদিয়ে ২০২০ সালে ৬ জুলাই ইহলোক ত্যাগ করে চিরতরে না ফেরার দেশে চলে যান। এরপর বলতে গেলে তাকে অনেকটা ভুলেই গিয়েছিল সবাই। নামমাত্র জন্মদিন বা মৃত্যু দিবস ছাড়া তেমন কোনো কিছু চোখে পড়তো না। এরপরই এলো একুশে পদক পাওয়ার খবর। খবরে বেশ খুশি পরিবাবার ও স্বজনরা।

এন্ড্রু কিশোরের সহধর্মিণী লিপিকা এন্ড্রু বলেন, ‘একুশে পদক পাওয়ার জন্য কাউকে মনোনয়ন দিতে হবে। তারপর ফরম তুলতে হবে, ফিলআপ করতে হবে। সেই ফরমে যা চেয়েছে, পেপার্স চেয়েছে, সেগুলো প্যাকেজিং করে মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হবে। এগুলো প্রাথমিক কাজ। এই পরিশ্রমগুলো আমাকে করতে হয়েছে।’

Advertisement

আরও পড়ুন>> একুশে পদক পেলেন ২১ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান

তিনি বলেন, ‘একুশে পদকের জন্য আমাকে অনেক শ্রম দিতে হয়েছে। আপনারা হয়তো সেটা জানেন না, বুঝতে পারবেন না। আপনারা ভাবেন যে হঠাৎ করে একুশে পদক পেয়ে গেলো। আসলে এভাবে হয় না। মন্ত্রণালয় থেকে নোটিশ আসে। সেই নোটিশ অনুযায়ী অ্যাপ্লাই করতে হয়, আপিল করতে হয়। এবং যার জন্য পদক তার জীবনবৃত্তান্ত থেকে শুরু করে সব কার্যক্রমসহ একটা গোটা প্যাকেট জমা দিতে হয়। সেই সঙ্গে একজন পদকপ্রাপ্ত কারও রেফারেন্স নিয়ে দিতে হয়। তার জন্য অনেক অনেক পরিশ্রম করতে হয়। আমাকে এটার জন্য এক মাস পরিশ্রম করতে হয়েছে। আপনারা এগুলো জানেন না। আপনারা ভাবেন একজন সুপারিশ করলো অমনি সরকারি লোকজন দিয়ে দিলো, যাও একুশে পদক। আসলে ব্যাপারটা কিন্তু তা না। ব্যাপারটা অনেক অনেক পরিশ্রমের। এটা মন্ত্রণালয়ে যায়। অনেক মানুষ ওইখানে আবেদন করেছেন। তার মধ্যে তারা বাছাই করে কাকে দেবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি চেয়েছি কিশোর একুশে পদক পাক। কিশোর একটা পদক পাক। সেজন্য আমি এটার পেছনে অ্যাফোর্ড দিয়েছি। ও ডেন পদক পায়, সেজন্য আমি এক মাস অ্যাফোর্ড দিয়েছি। শিল্পকলায় গিয়েছি। সেলিনা হোসেনের রেফারেন্স নিয়েছি। এটার পেছনে আমার অনেক অ্যাফোর্ড আছে। আমি চেয়েছি কিশোর একটি পদক পাক। আমি পরিশ্রম করে সাকসেসফুল হয়েছি। আমি নিশ্চয়ই খুব হ্যাপি এখন, আমি পেরেছি কাজটা করতে। আমি সত্যি খুব হ্যাপি, খুব হ্যাপি। কারণ আমি পেরেছি। কিশোরকে পদকটা পাওয়ানোর জন্য আমার যতটুকু করণীয় ছিল আমি করেছিলাম এবং সাকসেসফুল যে আমি কিশোরকে পদকটা পাইয়ে দিতে পেরেছি।’

এন্ডু কিশোরের দুলাভাই ডা. প্যাট্রিক বিপুল বিশ্বাস বলেন, ‘এটা তো বুঝতেই পারছেন আজ সত্যি আমরা অনেব খুশি। তার একুশে পদক পাওয়ার পেছনে আমরা খুব একটা কিছু করেছি তা নয়। তার বন্ধু-বান্ধব জানাশোনা লোকজন যথেষ্ট কিছু করায় তিনি এটা পেলেন। আজ সকালে তার স্ত্রীর কাছে মেসেজ আসলো, আমরা একত্রে ছিলাম। আমাদের সত্যি খুব গর্ব হচ্ছে।’

Advertisement

এন্ড্রু ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে টানা ৯ মাস সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এরপরও শরীরের অবস্থা ভালো না হওয়ায় দেশে ফিরে আসেন। এরপর তিনি জীবনের শেষ পর্যন্ত রাজশাহী মহানগরীর মহিষবাথান এলাকায় বোন ডা. শিখা বিশ্বাসের বাসায় থেকে চিকিৎসা নেন।

অবশেষে ২০২০ সালের ৬ জুলাই পরপারে পাড়ি জমান এই গুণী শিল্পী। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। তিনি ১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। এন্ড্রু কিশোরের চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক যাত্রা হয় ১৯৭৭ সালে আলম খানের সুরে ‘মেইল ট্রেন’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। সেখানে তিনি ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানে কণ্ঠ দেন। তার রেকর্ডকৃত দ্বিতীয় গান বাদল রহমান পরিচালিত ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ চলচিত্রের ‘ধুম ধাড়াক্কা’। তবে এ জে মিন্টু পরিচালিত ১৯৭৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘প্রতিজ্ঞা’ চলচ্চিত্রের ‘এক চোর যায় চলে’ গাওয়া গান প্রথম জনপ্রিয়তা লাভ করে।

প্লেব্যাকে তার গানের সংখ্যা ১৫ হাজারের বেশি। অন্যতম জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে- জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প, হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি, আমার বুকের মধ্যখানে, আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান, ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা, সবাই তো ভালোবাসা চায় প্রভৃতি। গান গাওয়ার জন্য তিনি আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।

সাখাওয়াত হোসেন/ইএ