অর্থনীতি

চার নিত্যপণ্যে শুল্কছাড়ের পরও ঊর্ধ্বমুখী দাম

• চাল আমদানি হচ্ছে না, বাড়তি সতর্কতার জন্য শুল্কছাড়• শুল্ক কমার পরে তেলের দাম আরও বেড়েছে• চিনির শুল্ক কমেছে অতি সামান্য• খেজুরের শুল্ক কমানো যথেষ্ট নয়

Advertisement

আসন্ন রোজায় দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাল, চিনি, তেল ও খেজুরে শুল্কছাড় দিয়েছে সরকার। ঠিক এমন সময়ে এসব নিত্যপণ্যে ছাড় দেওয়া হয়েছে, যখন বাজারে পণ্যগুলোর দাম বিগত সময়ের সর্বোচ্চ। যে পরিমাণ শুল্ক ও করছাড় দেওয়া হয়েছে তা ‘যথেষ্ট নয়’ বলে মনে করছেন ব্যসায়ীরা। শুল্কছাড়ের পরে বিগত পাঁচদিনে বাজারে এসব পণ্যের দাম না কমে বরং ঊর্ধ্বমুখী। রোজায় দাম কমা নিয়েও শঙ্কায় ভোক্তা ও ব্যবসায়ীরা।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গত বৃহস্পতিবার আলাদা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এসব পণ্য আমদানিতে শুল্ক-কর কমানোর ঘোষণা দেয়া হয়। এতে সিদ্ধ ও আতপ চালের ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক পুরোপুরি তুলে নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বা রেগুলেটরি ডিউটি ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে করা হয়েছে ৫ শতাংশ। এছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে পরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলের উৎপাদন এবং ব্যবসা পর্যায়ে ভ্যাট পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হয়েছে। আর বিদেশ থেকে পরিশোধিত-অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেল আমদানিতে ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে করা হয়েছে ১০ শতাংশ।

আরও পড়ুন>> রমজান/চার নিত্যপণ্যের শুল্ক কমানো ঘোষণাতেই আটকা

Advertisement

এছাড়া প্রতি টন অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে শুল্ক দেড় হাজার টাকা থেকে কমিয়ে এক হাজার টাকা করা হয়েছে। পরিশোধিত চিনি আমদানিতে প্রতি টনে আমদানি শুল্ক তিন হাজার থেকে কমিয়ে করা হয়েছে দুই হাজার টাকা। খেজুরের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে করা হয়েছে ১৫ শতাংশ।

তবে বাস্তবে এ শুল্ক-করছাড়ে পণ্যগুলোর দাম কতটুকু কমবে সে প্রশ্ন এখন ভোক্তাদের। শুল্ক-করছাড় পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি দাম কমছে চালের। চাল আমদানিতে প্রতি কেজিতে শুল্ক কমবে সাড়ে ২৩ টাকা। এছাড়া সয়াবিন ও পাম তেলে কেজিতে সাত থেকে আট টাকা শুল্ক-কর কমবে। কার্টনে আনা সাধারণ মানের খেজুরের কেজিতে শুল্ক কমবে ৩৩ টাকা। সবচেয়ে কম, মানে কেজিতে ৭৫ পয়সা শুল্ক কমবে চিনিতে।

খেজুরে যেভাবে ডিউটি কমানোর কথা, সেভাবে তো কমেইনি, বরং আমদানির চেয়ে তিনগুণ শুল্ক ধরা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে খেজুরের দাম এবছর মানভেদে ৫০ থেকে ১০০ ডলার কমেছে। কিন্তু আমাদের দেশে সরকার এ পণ্যে কয়েকগুণ শুল্ক দিয়ে দাম বাড়িয়েছে।- বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম

এমন পরিস্থিতিতে বাজার বিশ্লেষক ও ক্রেতারা বলছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখী পরিস্থিতিতে এ শুল্কছাড় পর্যাপ্ত নয়। গত এক বছরে ভোজ্যতেল, চিনি ও খেজুরের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। অপর্যাপ্ত ছাড়ের কারণে আমদানি শুল্ক কমিয়ে আনা সত্ত্বেও এখনো বাজারে কোনো প্রভাব পড়েনি।

Advertisement

বাজারের তথ্য বলছে, গত এক বছরে চিনির দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি প্রায় ৫০ টাকা। প্রতি কেজি চিনি কিনতে হচ্ছে ১৫০ টাকায়। সেখানে শুল্ক কমেছে ৭৫ পয়সা। এদিকে প্রতি কেজি খেজুরের দাম বেড়েছে মানভেদে ২০০ টাকা পর্যন্ত। ভোজ্যতেলের দামও প্রায় ১৫ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে।

চাল আমদানি হচ্ছে না, বাড়তি সতর্কতার জন্য শুল্কছাড়

চালের ক্ষেত্রে এ শুল্কছাড় কোনো কাজে আসবে না এখন। কারণ দেশে এখন চাল আমদানির কোনো প্রয়োজন নেই। বরং ভরা মৌসুম চলছে। সরকারের কাছেও মজুত রয়েছে পর্যাপ্ত। শেষ প্রায় এক বছর চাল আমদানি করছেন না ব্যবসায়ীরা। বরং বিশ্ববাজারে চালের দাম বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি।

আরও পড়ুন>> হুঁশিয়ারি-অভিযানেও চলছে চাল ব্যবসায়ীদের ‘চালবাজি’

জানতে চাইলে রংপুরের চাল আমদানিকারক শামসুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘চাল এখন আমদানিই হচ্ছে না। তাহলে শুল্কছাড় দিয়ে লাভ কী? এমনকি শূন্য শুল্ক করে দিলেও এখন কেউ চাল আমদানি করবে না। কারণ বর্তমানে বিশ্ববাজারে চালের দাম ১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। শুল্ক ছাড়ের পরও প্রতি কেজি চাল ৬০ টাকার বেশি হবে। সবচেয়ে কম দামের চালের আমদানি খরচ এখন প্রতি টন ৫৫০ মার্কিন ডলারের বেশি। এ চাল এনে দেশের বাজারে লোকসান দিয়ে বিক্রি করতে হবে।

খেজুরের শুল্ক কমানো যথেষ্ট নয়

রোজার আগে আগে সরকার খেজুরের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ কমালেও তা ‘যথেষ্ট’ মনে করছে না ফল আমদানিকারকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার অ্যাসোসিয়েশন’। এই শুল্ক হ্রাসকে ‘অতি সামান্য’ মনে করছেন খেজুর ব্যবসায়ীরা।

ছবি: এএফপি

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘খেজুরের শুল্ক যে পরিমাণ কমানো দরকার, সে পরিমাণ কমেনি। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও সরকার কয়েকগুণ শুল্ক দিয়ে রাখায় দাম বাড়তি।’

তিনি বলেন, ‘রমজানে ৫০ থেকে ৬০ হাজার মেট্রিক টন খেজুরের চাহিদা রয়েছে। অতীতে যে শুল্ক ধরা হতো, তা আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ থাকলেও বর্তমানে যে শুল্ক, তা বাজারমূল্য থেকে অনেক বেশি। তাই চাহিদা অনুযায়ী আমদানি করা হয়নি।’

‘খেজুর আমদানিতে পিপি ব্যাগে আগের শুল্কায়ন মূল্য ছিল কেজিপ্রতি ৫ টাকা ৪৫ পয়সা, বর্তমানে করা হয়েছে ৬৫ টাকা। ড্রাই কনটেইনারে ছিল ১০ টাকা ৯৩ পয়সা, যা বর্তমানে ধরা হয়েছে ১৬৪ টাকা। এছাড়া হিমায়িত কনটেইনারে ছিল কেজিপ্রতি ১০ টাকা, যা এখন ২৬২ টাকা। রিটেইল প্যাকেটজাত কার্টন ছিল ২১ টাকা ৮৪ পয়সা, যা বর্তমানে ১৮০ টাকা। শুল্ক না কমালে খেজুরের মূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে নিম্ন আয়ের মানুষের কেনা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠবে।’

আরও পড়ুন>> রোজায় মিলতে পারে দাম উল্লেখ করা চালের বস্তা

তিনি বলেন, ‘খেজুরে যেভাবে ডিউটি কমানোর কথা, সেভাবে তো কমেইনি, বরং আমদানির চেয়ে তিনগুণ শুল্ক ধরা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে খেজুরের দাম এবছর মানভেদে ৫০ থেকে ১০০ ডলার কমেছে। কিন্তু আমাদের দেশে সরকার এ পণ্যে কয়েকগুণ শুল্ক দিয়ে দাম বাড়িয়েছে।

চিনির শুল্ক কমেছে অতি সামান্য

বাজারের তথ্য বলছে, গত একবছর আগে প্রতি কেজি চিনির দাম ছিল ৯৬ থেকে ১০০ টাকা, যা এখন ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রায় চারমাস ধরেই দেশের চিনির বাজার অস্থির। অনেক দোকানে এখনো খোলা চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। কোথাও আবার প্যাকেটজাত চিনিও নেই। কোম্পানিগুলোকে তাগাদা দিয়েও মিলছে না এ নিত্যপণ্য।

পাম তেল ও সয়াবিন তেলের দাম লিটারে দেড় থেকে দুই টাকা বেড়েছে এ শুল্কছাড়ের পরে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নতুন আমদানি শুরু হলে তেলের দাম লিটারে হয়তো কমতে পারে। যা এক মাস সময় লাগবে। তবে পাইকারি বাজারে এখন তেলের চাহিদা বেশি। যে কারণে দাম বাড়ছে।- মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ী

এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে কম শুল্কছাড় দেওয়া হয়েছে চিনিতে। মানে কেজিতে ৭৫ পয়সা শুল্ক কমবে এ পণ্যে।

এসব বিষয়ে ভোগ্যপণ্য বিক্রেতাদের সংগঠন মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও চিনি ব্যবসায়ী গোলাম মাওলা জাগো নিউজকে বলেন, ‘সব মিলিয়ে প্রতি কেজি চিনি ভোক্তার হাতে যাওয়া পর্যন্ত মোট কর আরোপিত হয় ৬০ শতাংশের ওপর। অর্থাৎ টাকার অংকে যা ৪০ থেকে ৪২ টাকা। সেখানে ৭৫ পয়সা শুল্ক কীভাবে কমানো হলো। এটা খুব কম।’

তিনি বলেন, ‘যেভাবে ডলারের রেট ও আমদানির ক্ষেত্রে জাহাজ ভাড়া বাড়ছে তাতে এ শুল্কছাড় কোনো কাজে আসবে না। বরং গত কয়েকদিন চিনির বাজার আরও বাড়তি প্রবণতায় রয়েছে।’

দেশে চাহিদার তুলনায় চিনি উৎপাদন হয় কমবেশি এক শতাংশ। এখন স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয় কমবেশি ৩০ হাজার টন চিনি। আমদানি হয় ২২ থেকে ২৪ লাখ টন, যা দিয়ে দেশের চাহিদা মেটে।

শুল্ক কমার পরে তেলের দাম আরও বেড়েছে

শুল্ক ছাড়ে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম কেজিতে সাত থেকে আট টাকা কমার কথা। গত পাঁচদিনে সেটা হয়নি। বরং দাম উল্টো বাড়ছে।’

ছবি: এএফপি

মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ী কার্তিক নন্দী জানান, পাম তেল ও সয়াবিন তেলের দাম লিটারে দেড় থেকে দুই টাকা বেড়েছে এ শুল্কছাড়ের পরে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নতুন আমদানি শুরু হলে তেলের দাম লিটারে হয়তো কমতে পারে, যা এক মাস সময় লাগবে। তবে পাইকারি বাজারে এখন তেলের চাহিদা বেশি। যে কারণে দাম বাড়ছে।’

এ নিয়ে মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. বশির উদ্দিন বলেন, ‘শুল্কছাড়ের প্রভাব পড়তে কিছুটা সময় লাগার কথা। যে হারে শুল্কছাড় দেওয়া হয়েছে, তাতে বাজারে প্রভাব পড়বে বলেও মনে হয় না।’

তিনি বলেন, ‘এমন সময়ে শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত এসেছে যখন রোজার পাইকারি বেচাকেনা অনেকটা হয়ে গেছে। পণ্য আমদানির বেশিরভাগ সম্পন্ন করেছেন আমদানিকারকরা।’

রমজানে বেশি চাহিদা থাকে এমন চার নিত্যপণ্যের ওপর শুল্ক কমানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্দেশনার দেড় সপ্তাহের বেশি সময় পর প্রজ্ঞাপন জারি করে এনবিআর।

এনএইচ/এএসএ/জেআইএম