প্রকৌশলী ম ইনামুল হক। সাবেক মহাপরিচালক, নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট। হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর এবং পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থায় মহাপরিচালকের দায়িত্বও পালন করেছেন। লিখছেন, গবেষণা করছেন নদী ও পরিবেশের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে।
Advertisement
তিস্তা মহাপরিকল্পনা ও পরিস্থিতি নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ: আগের পর্বে ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’ নিয়ে আলোচনা করছিলেন। আপনি বলছিলেন, এ পরিকল্পনা তিস্তা নিয়ে তৃতীয় ষড়যন্ত্র। কেন মনে করছেন?
ম ইনামুল হক: নদী একটা সিস্টেমের মধ্য দিয়ে চলে। এক জায়াগায় উৎপত্তি, আরেক জায়গায় গিয়ে মিলছে। উজান ও ভাটিতে নদী ঘিরে যারা বসবাস করেন, তারাও এই সিস্টেমের মধ্যে পড়ে। সব নদীর বেলায়ই তাই।
Advertisement
তাহলে তিস্তার বেলায় তো ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়। ভারতের নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র ‘জল’ নামে একটি বই লিখলেন। অনেকের কাছেই এ বই আছে। বইয়ের মধ্যে তিনি তিস্তা নদীর ছবি দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ অংশে তিস্তার দুই পাড়ের বাঁধের ছবি দিয়ে তিস্তার সিস্টেম বুঝিয়েছেন। এটি ছিল তার সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র। কল্যাণ রুদ্র বোঝাতে চেয়েছেন তিস্তা আমাদের নদী না। তিস্তা তাদের নদী। তিনি আমাদের বাঁধটুকুর মধ্যকার নদী দেখিয়েছেন।
আরও পড়ুন>>‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা হচ্ছে তৃতীয় ষড়যন্ত্র’
আমি বোঝালাম, তোমাদের বিশেষজ্ঞরাই তিস্তার রূপ দেখিয়েছে। উত্তরবঙ্গে একটি হচ্ছে কোশী নদী, আরেকটি তিস্তা নদী। গত তিনশ বছরে নানা জায়গা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে কোশী নদী। ফ্যানের পাখার মতো। তিস্তাও তাই। তিস্তারও ফ্যান আছে। তিস্তার মধ্যে মহানন্দা, আত্রাই, ঘাঘট নদী পড়তো। এগুলো তিস্তার অববাহিকার নদী।
আমার এ কথার প্রমাণ মেলে বন্যার সময়। বন্যা হলে দিনাজপুরে তিস্তার পানি আসে কেন? পুরো উত্তরাঞ্চল তিস্তার পানিতে প্লাবিত হয় কেন? তাহলে অবশ্যই এ এলাকা তিস্তার।
Advertisement
কল্যাণ রুদ্রের বইতে এ বিষয়গুলো দেখানো হয়নি। আমি তো অবাক হয়ে গেছি, তার মতো একজন এক্সপার্ট এমনভাবে উপস্থাপন করে কী করে! এটি ছিল ভারতের প্রথম ষড়যন্ত্র, যেটি বিশেষজ্ঞ দিয়ে করলো।
দ্বিতীয় ষড়যন্ত্র ছিল আরেকটি আন্তর্জাতিক সংগঠনের মাধ্যমে। তারাও কল্যাণ রুদ্রের বইয়ে দেখানো ম্যাপ উপস্থাপন করলো। এটি ভারত টাকা ব্যয় করে করিয়েছে। সম্ভবত, তিন বছর আগে বনানীতে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সব এক্সপার্ট এলেন। আমি তখন তিস্তার ম্যাপ নিয়ে প্রশ্ন করলাম। জবাব দিতে পারেননি কেউই। তৃতীয় ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এই তিস্তা মহাপরিকল্পনা।
জাগো নিউজ: এ পরিকল্পনায় তো ড্রেজিং, নদীশাসনের মতো বিষয় গুরুত্ব পাচ্ছে…
ম ইনামুল হক: কোথায় করবে সেটা, এটি আপনাকে বুঝতে হবে। বাঁধের মধ্যে যেটুকু দেখানো হচ্ছে সে টুকুর মধ্যে করার কথা বলছে। তিস্তার বিস্তার দু-তিন কিলোমিটার প্রশস্ত। মহাপরিকল্পনায় তিস্তাকে আধা কিলোমিটারের মধ্যে আনা হবে। এটি কি সম্ভব! বর্ষাকালে তিস্তার কী রূপ তা তো জানার কথা। সব তো উড়িয়ে নিয়ে যাবে।
চীন তো ঋণ দিয়ে সরকারকে আটকে দিচ্ছে। চীন গোটা বিশ্বে এভাবে ঋণ দিয়ে জাল ফেলছে। আমেরিকাও চীনের এই ঋণের জালে আটকে আছে। তাদের কাজই হচ্ছে ঋণগ্রস্ত করে রাখা। চীনের মতো আর কেউ ঘুসও দেয় না। তারা ঘুস দিয়ে সব কিনে ফেলছে। এটি চীনের লাভ।
আরও পড়ুন>> ‘বাংলাদেশ আমাদের বন্ধু, তিস্তার পানি দেব কোথা থেকে’
একটি নদীর তিনভাবে জায়গা লাগে। বন্যাপ্রবাহের সময় তার অনেক জায়গা লাগে। বর্ষাকালীন প্রবাহ। নদীর গতি সচল রাখে। আরেকটি হচ্ছে শীতকালীন প্রবাহ। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে তো পরিকল্পনা নিতে হয়। বন্যা তো কোনো পরিকল্পনায় আটকে থাকবে না। বন্যা ঠেকাতে গিয়ে সব শেষ হয়ে যাবে।
আমি বলেছি, এ পরিকল্পনা আনা হয়েছে কিছু মানুষের সুবিধার জন্য। কিছু ঠিকাদারের লাভ হবে। এর সঙ্গে আরও পক্ষ সুবিধা নেবে। কাজের কাজ কিছুই হবে না। কোনো সুস্থ চিন্তা থেকে এমন পরিকল্পনা হতে পারে না।
আমি ১৯৮২ সালে ফরিদপুরে এসডিও ছিলাম। পাঁচ হাজার টন গম চলে এলো পদ্মা নদীর খনন প্রকল্পে। কোন আক্কেলে এমন প্রকল্প নেওয়া হয় বুঝতে পারি না।
জাগো নিউজ: সরকার তো তিস্তা পাড়ের মানুষের উন্নয়ন নিয়েও কথা বলছে।
ম ইনামুল হক: সরকার যা বলছে তার মূলে ক্ষমতায় থাকা। আর এর সঙ্গে আছে কিছু সুবিধাভোগী, যারা এমন বাইনারি প্রকল্প আনছেন।
জাগো নিউজ: চীনের কী লাভ তাতে?
ম ইনামুল হক: চীন তো ঋণ দিয়ে সরকারকে আটকে দিচ্ছে। চীন গোটা বিশ্বে এভাবে ঋণ দিয়ে জাল ফেলছে। আমেরিকাও চীনের এই ঋণের জালে আটকে আছে। তাদের কাজই হচ্ছে ঋণগ্রস্ত করে রাখা। চীনের মতো আর কেউ ঘুসও দেয় না। তারা ঘুস দিয়ে সব কিনে ফেলছে। এটি চীনের লাভ।
জাগো নিউজ: আর ভারতের স্বার্থ?
ম ইনামুল হক: ভারত তো নিয়ন্ত্রণে রাখছেই। একবার না বললেই সব বন্ধ। ভারত এমন নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে পানিটা সরিয়ে নিতে পারছে। ভারত তো আর আমাদের কান্না শুনবে না।
জাগো নিউজ: তিস্তা মহাপরিকল্পনায় চীনের যুক্ত হওয়া ভারত নিজেদের নিরাপত্তার হুমকি মনে করছে। অন্তত ভারতের মিডিয়া তাই বারবার বলতে চাইছে। এ অভিযোগের কোনো বাস্তবতা আছে?
ম ইনামুল হক: তিস্তা মহাপরিকল্পনা ভারতের জন্য হুমকি, এটি ফালতু কথা। ভারতে আন্তঃনদী সংযোগ কোথাও বাস্তবায়ন করতে পারেনি একমাত্র তিস্তা ছাড়া। আর কোথাও ক্যানেলও করতে পারেনি। শিপ্রা নদীতে করার চেষ্টা করেছিল। পারেনি। কারণ সেখানে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হয়। তিস্তায় পেরেছে। কারণ বাংলাদেশের মানুষ তো প্রতিবাদ করতে পারলো না। এদেশে যারা বিশেষজ্ঞ তারা নিজেদের সুবিধার বণ্টন নিয়েই ব্যস্ত।
জাগো নিউজ: কী ঘটছে বাংলাদেশের কপালে?
ম ইনামুল হক: বাংলাদেশ হলো বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ। হাজার বছর ধরে এখানকার সম্পদ শুধু লুটপাটই হয়েছে। এখন দেশীয় দালালরা লুটপাট করছে। বাংলাদেশের মানুষের জন্য এ সম্পদ রক্ষা করা খুবই কঠিন ব্যাপার। হিন্দুরা বলবে এই ভূখণ্ড তাদের বাপ-দাদার। মুসলমানরা বলবে আমরা ইরাক-ইরানের বা সৌদির অনুসারী। এই মাটি কেউ অনুভব করে না। মাটির সঙ্গে মানুষের যে অধিকার তা কজনে বুঝি?
জাগো নিউজ: উপায় কী?
ম ইনামুল হক: উপায় জনগণকে বের করতে হবে। এক ব্যক্তি বা দলের কাছে এই দেশ জিম্মি হতে পারে না। রাষ্ট্র জনগণের হলে জনগণকে ক্ষমতা দিতে হবে। তারাই সিদ্ধান্ত নেবে তাদের প্রাণ-প্রকৃতি কীভাবে রক্ষা হবে।
আমরা বিশাল এক গ্যাঁড়াকলে পড়ে গেছি। তাই বলে হাল ছাড়লে চলবে না। আমাদের সত্য কথাগুলো বলে যেতে হবে। সবই তো শেষ হয়ে গেলো। মানুষ তো পণ্য হয়ে গেছে।
এএসএস/এএসএ/এমএস