মতামত

কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ও প্রতিবন্ধকতার ছায়া

বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিসরে অনেক কথাই হচ্ছে অহরহ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ নিয়ে যেমন আশার আলো দেখা যায়, তেমনি নিরাশার ছায়াও হয় দৃশ্যমান। বাংলাদেশ এরই মধ্যে স্বাধীনতার ৫২ বছর অতিক্রম করেছে। বিভিন্ন গবেষণা-সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিগত পাঁচ দশকে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ অনেক বেড়েছে। এর মধ্যে যেমন আছে আনুষ্ঠানিক খাত, তেমনি আছে অনানুষ্ঠানিক খাত। দেশের অর্থনৈতিক পটপরিবর্তনে নানাভাবে কিংবা নানা স্তরে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে, এর মধ্যে অন্যতম মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের সফলতায় নারীর অবদান।

Advertisement

যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এই রাষ্ট্রের অভ্যুদয়, বিগত ৫২ বছরে দেশটির অর্থাৎ বাংলাদেশের অর্জনের খতিয়ান অনেক বিস্লৃত। তবে বিষয়কেন্দ্রিক এই আলোচনায় যেহেতু প্রসঙ্গ নারী, সেহেতু এই নির্দিষ্ট দিকটিতে আলোকপাত করলে দেখা যায়, পাকিস্তানকে যেসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পেছনে ফেলেছে এর একটি হলো কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ।

নিকট অতীতে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৮ শতাংশ, যা পাকিস্তানে ২৩ শতাংশ। স্বাধীনতা অর্জনের তিন বছর পর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে উঠে এসেছিল কর্মক্ষেত্রে নারীর হার ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। তবে ১৯৮০ সাল থেকে এই হার ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং বর্তমানে তা বলা যায় উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে নিয়েছে।

শুধু দেশের শ্রমবাজারের নানা স্তরেই নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে না; লক্ষণীয় আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারেও বাংলাদেশের নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। কিন্তু দেশে-বিদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর জন্য পরিবেশ কতখানি অনুকূলে, এ নিয়ে প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে সরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মজীবী মানুষের হার ৫ শতাংশ এবং বেসরকারি ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ। এর বাইরে ৮৫ শতাংশ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতের সঙ্গে যুক্ত। কর্মে যুক্ত এই বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারীর হার উল্লেখযোগ্য।

Advertisement

সরকারি পর্যায়ে এখন নারীর অংশগ্রহণ প্রতিরক্ষা খাত পর্যন্ত দৃশ্যমান। বেসরকারি পর্যায়ে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারীর অংশগ্রহণ রয়েছে তৈরি পোশাক শিল্প খাতে। বলা যায়, বাংলাদেশের বিকাশমান এই খাতটি নারীর কর্মদিগন্ত বিস্লৃত করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। আশার কথা হলো, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এর বাইরে অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির এ দেশে কৃষি খাতেও নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।

যেকোনো ক্ষেত্রে কাজের অন্যতম শর্ত সুষ্ঠু পরিবেশ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এত আশাব্যঞ্জক খবরের পরও হতাশাজনক চিত্র কম দেখা যায় না। শুধু সরকারি-বেসরকারি কর্মক্ষেত্রেই নয়, অনানুষ্ঠানিক ক্ষেত্রেও নারীর নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে এখনও। একই সঙ্গে জিইয়ে আছে বৈষম্যও। আমরা যদি কর্ম কিংবা সামাজিক ক্ষেত্রে নারীর জন্য অনুকূল পরিবেশের উপযুক্ততার নিরিখে বিষয়গুলো পর্যালোচনা করি, তাহলে যেদিকগুলো উঠে আসে তা যেমন বহুলাংশেই বৈষম্যজনিত কারণে সৃষ্ট, তেমনি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাও কম দায়ী নয়।

আমরা জানি, কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এরই আলোকে নতুন কিছু আইনও করা হয়েছে, যেখানে নারীবান্ধব নীতিমালার প্রতিফলন লক্ষ করা গেছে। কিন্তু তারপরও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কর্মক্ষেত্রে নারীর পরিবেশ ও নিরাপত্তা অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে আছে সমাজের সর্বস্তরে একশ্রেণির মানুষের মানসিকতায় পরিবর্তন না আসায় এবং নারীর কাজের স্বীকৃতি ও সমতার বিষয়টি নিশ্চিত না হওয়ায়।

বিভিন্ন সেমিনারে গোলটেবিল কিংবা সামাজিক পরিসরে আলোচনায় এবং সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকেও নারীর জন্য হয়রানিমুক্ত কর্মক্ষেত্র সৃষ্টির তাগিদ এসেছে। অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছে। কিন্তু এর পরও বিস্তৃত পরিসরে কর্মক্ষেত্রে নারীবন্ধব পরিবেশ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নিশ্চিত করা যায়নি। কর্মক্ষেত্রে হয়রানি ও সহিংসতার বিষয়গুলো শনাক্ত করে কাজের পরিবেশ উন্নয়নে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) সনদ বাস্তবায়নের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কিংবা বেসরকারি নানা পর্যায়ে একই সঙ্গে সরকারি পর্যায়ের নানা ক্ষেত্রে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিয়ে একটি রোডম্যাপ তৈরির তাগিদও কম শোনা যায়নি।

Advertisement

আমরা দেখছি, শিল্প-কারখানায় যারা নারী নির্যাতন কিংবা হয়রানি করেন, তারা কর্মজীবী নারীর মানবিক বোধ, অধিকার ও মর্যাদার বিষয়গুলো আমলে রাখেন না বলেই তাদের মনোজগতে পরিবর্তন আসছে না। আর এরই বিরূপ ফল দেখা যাচ্ছে সমাজে। কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ সংবেদনশীলতার প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং তা চলমান রাখার গুরুত্ব কতটা জরুরি, বিদ্যমান পরিস্থিতিই এর সাক্ষ্যবহ। সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই উঠে আসছে, কর্মক্ষেত্রে নারীরা বয়স ও বৈবাহিক অবস্থাভেদে নানা রকম হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান নানা রকম প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও নারীর অংশগ্রহণ একই সঙ্গে অগ্রগতির সাফল্য অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক হলেও পরিবেশের প্রতিকূলতার কারণে আমাদের এই গর্বের জায়গাগুলো কখনও কখনও বিবর্ণতায় ঢেকে যাচ্ছে। যৌন নিপীড়ন সমাজের নানা ক্ষেত্রে তো বটেই, কর্মক্ষেত্রের বিভিন্ন স্তরেও ব্যাধি হিসেবে জিইয়ে আছে।

 

কর্মক্ষেত্রে নারীর উদ্দীপনা বাড়াতে হলে কিংবা অবস্থানভেদে নিজ নিজ ক্ষেত্রে নারীর সৃজনশীলতা-সৃষ্টিশীলতা পরিপূর্ণ বিকাশে প্রশ্নমুক্ত কর্মক্ষেত্রের কোনো বিকল্প নেই। কর্মক্ষেত্রে নারীর জন্য কাজের ধরন, পরিবেশ, স্থান বা দূরত্ব কোনো কিছুই নারীর সামনে বাধা হয়ে থাকবে না- যদি সব মাধ্যম কিংবা ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়।

 

উল্লেখ্য, শিক্ষাক্ষেত্র বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে তা বেশি পরিলক্ষিত হয়। আমরা দেখছি, নারী শিক্ষার্থীরা তো বটেই, প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষিকাদেরও কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে এবং হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি যেখানে বিদ্যমান, সেখানে নানা অর্জনের বিসর্জনের পথও তো খোলাই রয়েছে। এক কথায় বলা যায়, এই পথ যদি রুদ্ধ করা না যায়, তাহলে কর্মক্ষেত্রের নানা স্তরে নারীর অংশীজনের সংখ্যা কিংবা হার যতই বাড়ুক সমাজ বিনির্মাণের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাবের আশা দুরাশা হয়েই থাকবে।

কর্মক্ষেত্র তা যে পর্যায়েই হোক, বিকাশের অন্যতম একটি মাধ্যম। কিন্তু আমরা দেখছি বিকাশের এই মাধ্যমটিরই সামনে রয়েছে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ। আমরা যখন দেখি, উদ্যোক্তার কাতারেও নারী অংশীজনের সংখ্যা বাড়ছে, তখন নারীর অগ্রগতি নিয়ে যতই আমরা আশান্বিত হই না কেন, বৈষম্য এবং নিরাপত্তাজনিত নানা সমস্যা, একই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তিতে অনেক ক্ষেত্রেই নারীকে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। নারীর কর্মসংস্থানের হার যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে উপযুক্ত কর্মপরিবেশ। জনসংখ্যার অর্ধেক অংশকে যথাযথ চজোগান দিতে না পারলে, উন্নয়নের ধারা চাঙ্গা রাখতে না পারলে এবং উন্নয়নের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ত করে এগিয়ে যাওয়ার পথ কণ্টকমুক্ত করতে না পারলে প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে না। এমন নজির তৃতীয় বিশ্বের কোনো কোনো দেশে রয়েছে।

আমরা জানি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪১ সাল নাগাদ কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ৫০-৫০-এ উন্নীত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। এর আগে তিনি নারীর সমতা, ক্ষমতায়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত করার তাগিদও দিয়েছেন। আমরা জানি, আয় এবং কর্মসংস্থানই ক্ষমতায়নের ভিত মজবুত করে। আমরা স্মরণ করতে পারি, লিঙ্গসমতা নারীর ক্ষমতায়নে ১৯৯৫ সালের বেইজিং ডিক্লারেশন অ্যান্ড প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশন বড় ধরনের রোডম্যাপ তৈরি করে দিয়েছে।

সন্দেহ নেই, এটি নারীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেওয়ার ক্ষেত্রে এবং ইতিবাচক উন্নয়নের অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। তখন থেকেই প্রায় সব দেশ নারীর সুরক্ষায় আইনি কাঠামো গঠন করে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু আমাদের বাস্তবতা কিছুটা হলেও ভিন্ন। সর্বত্র নারীর শুধু অংশগ্রহণ বাড়িয়েই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সব কাজ শেষ হয়ে গেছে বলে মনে করা হলেও গুণগত মান উন্নয়নের মতো জরুরি বিষয়টি উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। কর্মক্ষেত্রে যে পর্যন্ত না লিঙ্গ সংবেদনশীল পরিবেশ নিশ্চিত রাখা ও বৈষম্যের ছায়া দূর করা না যাবে এবং নারীবান্ধব আইনগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব না হবে, ততক্ষণ আমাদের সমাজে নারীর প্রতি পরিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির ঘাটতি থেকেই যাবে। এই ঘাটতি কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধক।

কর্মক্ষেত্রে নারীর উদ্দীপনা বাড়াতে হলে কিংবা অবস্থানভেদে নিজ নিজ ক্ষেত্রে নারীর সৃজনশীলতা-সৃষ্টিশীলতা পরিপূর্ণ বিকাশে প্রশ্নমুক্ত কর্মক্ষেত্রের কোনো বিকল্প নেই। কর্মক্ষেত্রে নারীর জন্য কাজের ধরন, পরিবেশ, স্থান বা দূরত্ব কোনো কিছুই নারীর সামনে বাধা হয়ে থাকবে না- যদি সব মাধ্যম কিংবা ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়। একই সঙ্গে যেসব সামাজিক কারণ আমাদের সমাজে নারীর সামনে প্রতিবন্ধক হিসেবে জিইয়ে আছে, সেসব নিরসনে সরকারি-বেসরকারি এবং সামাজিক পর্যায়ে যূথবদ্ধ ভূমিকা পালন করতে হবে।

বাংলাদেশে নারীর তাৎপর্যপূর্ণ উন্নয়ন হয়েছে, নারী নেতৃত্বের ক্ষেত্রে আগের তুলনায় সচেতনতা বেড়েছে, সরকারি নানা রকম সুযোগ-সুবিধার পথ প্রশস্ত করে দিয়েছে, শুধু এমন ইতিবাচক ভাবনার মাঝেই স্বস্তি খুঁজলে চলবে না। সরকারের গৃহীত নারীনীতিসহ অন্য নীতিমালা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যদি অসংগতি থাকে, তাহলে আমাদের সামনে বিপুল সম্ভাবনার যে ক্ষেত্র রয়েছে, তা সংকুচিত হয়ে যাবে; কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।

লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক।

এইচআর/জিকেএস