মতামত

মিয়ানমার বিদ্রোহে ঝুঁকিতে আমাদের ভূরাজনৈতিক নিরাপত্তা

মিয়ানমারের সাম্প্রতিক সংঘাতের প্রভাব বাংলাদেশেও এসে পড়েছে। কোনো প্রতিবেশী দেশে বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকায় কোনো কোনো সহিংস ঘটনা ঘটলে এবং সে সংঘাত উক্ত অঞ্চল তথা রাষ্ট্রজুড়ে বিস্তৃত হলে তা নিকটবর্তী প্রতিবেশী দেশেও নানা প্রভাব ফেলতে পারে। প্রতিবেশী দেশের এসব ঘটনার কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাবের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক ও আর্থসামাজিক প্রভাবও পড়তে পারে। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী তাই আমাদের দেশের ওপর নানাভাবেই প্রভাব ফেলছে।

Advertisement

২০১৭ সালে মিয়ানমারের সরকার ও সামরিক বাহিনীর যৌথ নির্যাতনের ফলে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত আশ্রয় নিয়েছে ১২ লাখ রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী আরাকান রাজ্যে সহিংসতা ও জাতিগত নির্মুল তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু সে ঘটনার ফলে আমাদের সীমান্ত পার হয়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গা এদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের সামরিক অভিযানের কারণেই রোহিঙ্গারা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়ছে। আর মিয়ানমার সামরিক বাহিনী ও বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপের সঙ্গে সাম্প্রতিক সংঘর্ষের ফলেও বাংলাদেশ পালিয়ে আসতে শুরু করেছে সৈন্য ও বেসামরিক নাগরিকরা।

রোহিঙ্গাদের আগমন আমাদের রাজনৈতিক তথা আর্থসামাজিক জীবনে যে নানা প্রভাব ফেলেছে তা বলাই বাহুল্য। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রভাবও আমাদের দেশের ওপর পড়তে শুরু করেছে। ৭ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সীমান্তবর্তী তুমব্রু ও ঘুমঘুম এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে ৩২৭ জন সামরিক বাহিনীর সদস্য। বাংলাদেশ সরকার দাবি করেছে, মিয়ানমার তাদের ফিরিয়ে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তারা হয়তো ফিরে যাবে। কিন্তু সংঘর্ষ যদি আরও ব্যাপক আকারে ছড়িয় পড়ে এবং তাদের আগমন যদি আরও বেড়ে যায় তবে সেক্ষেত্রে পরিস্থতি সামলানো আমাদের জন্য বেশ কঠিন হবে। কয়েক দফা রোহিঙ্গা আগমনের পর নতুন করে আবার তাদের আগমন হলে তা হবে আমাদের জন্য এক কঠিন চ্যালেঞ্জ।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, মিয়ানমারের এ সহিংসতা আরও দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশে আবারও মিয়ানমারের বিভিন্ন গ্রুপ বা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা ঢুকে পড়তে পারে এবং সহিংসতা আরও বাড়লে এ আগমন ব্যাপকভাবেই হতে পারে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ এ আগমন কতটুকু প্রতিরোধ করতে পারবে সেটি প্রশ্ন সাপেক্ষ।

Advertisement

বাংলাদেশ বাস্তবসম্মত কারণেই সীমান্তে সহিংসতার প্রশ্নে এক ধরনের নমনীয়তা দেখিয়েছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এ নমনীয়তার নীতি অনুসরণ করা যাবে কিনা সেটিও ভেবে দেখার মতো। ২০১৭ সালে নমনীয়তার কারণে ১২ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা আমাদের ঘাড়ে। ভবিষ্যতে এ বোঝা আরও বাড়লে বাংলাদেশের পুরো আর্থসামাজিক তথা রাজনৈতিক অবস্থার এক দৃশ্যত পরিবর্তন ঘটবে যা আমাদের জন্য কোনোভাবেই ইতিবাচক কিছু বয়ে আনবে না।

মিয়ানমার বর্তমানে এক দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সেখানে চলমান সংঘর্ষের কারণে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে খাদ্য ও চিকিৎসার সংকট দেখা দিয়েছে। সেনাবাহিনী খাদ্য ও রসদ সরবরাহে বাধা দিচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে সশস্ত্র গোষ্ঠী তথা সাধারণ নাগরিকরাও সীমান্ত অতিক্রম করে এদেশে চলে আসবে। এছাড়া নিরাপদ ভূমি থেকে সশস্ত্র সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে যে কোনো একটি পক্ষ এখানে ঢুকে পড়ে এখান থেকেই তৎপরতা চালাতে পারে। ইতোমধ্যে এটি আমাদের জন্য এক বড় নিরাপত্তা সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় আমরা আর ক'দিন গা বাঁচিয়ে চলতে পারবো সেটি ভেবে দেখার মতো।

মিয়ানমারে বর্তমানে সামরিক সরকার ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। এসব গ্রুপের সঙ্গে কোথাও কোথাও জনগণও যোগ দিচ্ছে। ফলে অনেক জায়গায় সরকারি বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে। আরাকানের অধিকাংশ জায়গায় সামরিক বাহিনী পিছু হটছে। এ অবস্থায় জনগণ তথা সশ্রস্ত্র বিদ্রোহীরা সহসা পিছু হটবে বলে মনে হয় না। সামরিক বাহিনীও যদি পিছু না হটে তবে আপাতত সেখানে বেসামিরক সমাধানের কোনো ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে না। সামরিক সমাধান হলে তা হবে দীর্ঘস্থায়ী এবং তার প্রভাব বাংলাদেশে আরও ব্যাপকভাবে পড়বে। সেখানে যে কোনো দীর্ঘ মেয়াদী সামরিক সংঘাত আমাদের জন্য নেতিবাচক ফল বয়ে আনবে। তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফলে নির্যাতিত রোহিঙ্গা ঘরছাড়া হয়ে আমাদের দেশে আশ্রয় নিয়েছে। এ জাতীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমরা চাই না।

রোহিঙ্গাদের ওপর জান্তা বাহিনীর নিধনযজ্ঞের পেছনে শুধু রোহিঙ্গামুক্ত আরকান গঠন নয়; এর পেছনে ছিল তাদের দীর্ঘমেয়াদী উগ্রজাতীয়তাবাদী চেতনা ও বাণিজ্যিক স্বার্থ। রোহিঙ্গা বিতাড়ণে চীন পেছন থেকে মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনেও মিয়ানমার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের পেছনেও চীনের প্রচ্ছন্ন মদদ ও ভূমিকা রয়েছে এটি স্পষ্ট। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে তারা সামরিক বাহিনীকে মদদ দিয়েছে আর এখন তারা সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহী দলগুলোকে সাহায্য করছে।

Advertisement

যে সামরিক বাহিনীর আক্রমণে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে এদেশে পালিয়ে এসেছে, মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের আক্রমেণ সেই সেনাবাহিনীর সদস্যরাও দেশ ছেড়ে এদেশে আসতে বাধ্য হয়েছ। আজ রোহিঙ্গা ও সেনারা উভয়েই বাংলাদেশে আশ্রিত। শুধু তা-ই নয়, সামরিক জান্তার মদদে অং সান সুচির দল ক্ষমতায় থাকা কালেই রোহিঙ্গাদের ওপর আক্রমন হয়েছিল। ২০২১ সালে অং সান সুচি ক্ষমতা হারায়। বছর না যেতেই (২০২২ সাল থেকে) সুচির দল পিডিএফ নিজেই সামরিক বাহিনীর আক্রমনের শিকার হয়। ২০১৭ সালে স্থানীয় রাখাইন ও সেনাবাহিনী মিলে রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করে ঘরছাড়া করেছে। কিন্তু আজ সেই স্থানীয় জনগণ, সশস্ত্র গোষ্ঠী মিলে তথা ব্রাদারহুড আলায়েন্স মিলে সেনাবাহিনীকে শায়েস্তা করার মিশনে নেমেছে। সবার হাতে মার খাচ্ছে অং সান সুচির দল। ক্ষমতার রদবদলের সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যপটেরও পরিবর্তন ঘটেছে।

যুক্তরাষ্ট্র গত কয়েক বছরই মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধেও তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। সাম্প্রতিক বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে জান্তা সরকারের ভূমিকার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত তাদের কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। আবার যুক্তরাষ্ট্র যে বিদ্রোহীদের সাহায্য করেছে তাও নয়। এর ফলে বিদ্রোহীরা চীনের সাহায্য চেয়েছে। চীন এখন বিদ্রোহীদের অস্ত্র সহায়তা দিচ্ছে। চীন এভাবেই মিয়ানমারের ওপর তার প্রভাব বজায় রাখতে চাইছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র কি দীর্ঘমেয়াদে মিয়ানমারে ওপর চীনের আধিপত্য মেনে নেব। যুক্তরাষ্ট্রের মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিস নীতি সে কথা বলে না। ফলে মিয়ানমার প্রশ্নে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র মুখোমুখি। বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ গ্রুপ ও আন্তর্জাতিক পক্ষ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ায় এ অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা অনেকটাই আজ চ্যালেঞ্জের মুখে।

মিয়ানমারের এ অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমার প্রশ্নে এখনও যদিও তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি। যদিও তারা গণতন্ত্র বা মানবাধিকার ইত্যাদি ইস্যু দিয়ে বিষয়টিকে এড্রেস করতে চায়। কিন্তু তাতে অবস্থান পরিষ্কার হয় না। হয়তো সময় হলেই তারা এ বিষয়ে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করবে। তবে (৬ ফেব্রুয়ারি) যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমার ইস্যুতে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কিন্তু এ সহায়তা কী ধরনের সেটা পরিষ্কার নয়। সাম্প্রতিক সহিংসতার ফলে মিয়ানমারের আরও নাগরিকরা এখানে ঢুকে পড়লে তাদের জন্য আর্থিক সহায়তা নাকি মিয়ানমারের নাগরিকরা এখানে যাতে না আসে সেজন্য কৌশলগত সহায়তা-সেটি পরিষ্কার নয়। রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে যেমন আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছিল পরে আবার তা কমিয়েও দেয়া হয়েছে-সে রকম সহায়তা আকাঙ্ক্ষিত নয়। বরং রোহিঙ্গাদের বোঝাই আমাদের জন্য অনেক বেশি। তাদের বার্মা অ্যাক্ট বা ভিসা নিষেধাজ্ঞার কোনো কার্যকারিতা দেখা যাচ্ছে না। এখানে রোহিঙ্গাদের আগমন ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিবাচক ভূমিকা কাম্য।

মিয়ানমারের একটি পক্ষ (ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট) রোহিঙ্গাসহ মিয়ানমারের সব সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীকে নাগরিকত্ব প্রদানের জন্য সংবিধান প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। এটি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য ইতিবাচক। এছাড়া আরাকান আর্মিও রোহিঙ্গা তথা অপরাপর জাতি-গোষ্ঠী ও ধর্মালম্বীদের সহাবস্থানের পক্ষে। এটিও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য ইতিবাচক। বাংলাদেশকে এ সুযোগুলো কাজে লাগাতে হবে।

সশস্ত্র লড়াই চলাকালেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশকে কাজ করতে হবে। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর উত্থান রোহিঙ্গাদের বাড়ি ফিরতে উৎসাহ যোগাবে। বাংলাদেশ যেহেতু লড়াইরত কোনো পক্ষকেই সমর্থন দেয়নি তাই ভবিষ্যতে যেকোনো বিজয়ী পক্ষের সঙ্গে কাজ করা সহজ হবে।

ভূ-কৌশলগত কারণেই রাখাইন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে ভারত, চীন, জাপানের বিভিন্ন প্রকল্প রয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে বৃহত্তর আঞ্চলিক ও কৌশলগত অবস্থান। বাংলাদেশকে এখানে সতর্ক অবস্থানেই থাকতে হবে।

রোহিঙ্গা বিতাড়নের কিছু দিন পর স্থানীয় রাখাইন ও সেনাবাহিনীর মধ্যে শান্তি বিরাজ করেছিল। কিন্তু সে শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে রাখাইনের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয় যা আজ সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে। এর আগে রাখাইন ও কট্টর বৌদ্ধরা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়েছিল। সে ঘৃণায় এখন পুরো সেনাবাহিনী, রাখাইন অঞ্চল, আরাকান বাহিনী তথা পুরো মিয়ানমারই জ্বলছে। কট্টর সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্র জাতীয়তাবাদের ফলে রাখাইন রাজ্য সেদিন রোহিঙ্গামুক্ত হলেও মিয়ানমার আজও সে আগুনে জ্বলছে। হয়তো আগুন সহসা নিভে যাবে বলে মনে হয় না।

লেখক: আইনজীবী ও প্রাবন্ধিক।

এইচআর/এএসএম