জাতীয়

আন্দোলনের মুখে হাসপাতাল সরলেও মেলার দখলে সিআরবি

 

দীর্ঘ দেড় বছর আন্দোলনের পর চট্টগ্রামের সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং (সিআরবি) এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণ থেকে সরে আসে সরকার। ওই আন্দোলনের মূল দাবি ছিল চট্টগ্রামের ফুসফুস খ্যাত সিআরবি যেন উন্মুক্ত থাকে। আন্দোলনকারীদের দাবির মুখে হাসপাতাল নির্মাণ বন্ধ হলেও মূল বিষয়টি এখনো উপেক্ষিত। সিআরবিতে বসছে একের পর এক মেলা। শত বছরের এই সবুজ প্রকৃতির অভয়ারণ্য মাসের পর মাস মেলার দখলে থাকা নিয়ে আপত্তি তুলেছেন পরিবেশবিদ ও সংস্কৃতিকর্মীরা।

Advertisement

আগামীকাল শুক্রবার (৯ ফেব্রুয়ারি) সিআরবি শিরীষতলায় শুরু হচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে অমর একুশে বইমেলা। গতকাল বুধবার বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, সিআরবির শিরীষতলার পুরো মাঠ ঘিরে চলছে মেলার স্টল তৈরির কাজ। মাঠে বিছানো হয়েছে ইট। উপরে দেওয়া হয়েছে ত্রিপল। ২৩ দিনব্যাপী এ বইমেলা শেষ হবে ২ মার্চ। পাশেই মেলাকে কেন্দ্র করে বসেছে ৫০টির বেশি অস্থায়ী দোকান।

গত বছরের আগস্টে এই স্থানে আয়োজিত হয় তিন সপ্তাহব্যাপী বৃক্ষমেলা। জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় মেলার আয়োজন করে চট্টগ্রাম বন বিভাগ (উত্তর)। পরের মাস সেপ্টেম্বরে ছিল বাণিজ্যিক মেলার আদলে মাসব্যাপী জামদানি মেলা।

আরও পড়ুন: সিআরবি রক্ষা, শেষ হচ্ছে দেড় বছরের আন্দোলন

Advertisement

সিআরবিতে একটু স্বস্তির নিশ্বাস নিতে আসা নগরবাসী বলছেন, মেলার জন্য মাসব্যাপী হাজার হাজার মানুষের আনাগোনা হয় এখানে। এর সঙ্গে রয়েছে উচ্চশব্দে মাইক ব্যবহার। এতে প্রতিবেশের ক্ষতির পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে বন্দরনগরীতে বসবাসকারীদের বিনোদনের একমাত্র উন্মুক্ত জায়গাটি।

সিটি করপোরেশনকে বলেছিলাম এখানে মেলা করলে পরিবেশবাদীরা আমাদের প্রশ্ন করবেন। কিন্তু তারা আগে যেখানে মেলা করতো, সে মাঠটি না পাওয়ায় একেবারে শেষ মুহূর্তে অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

কথা হয় অ্যাডভোকেট নাজনিন সুলতানার সঙ্গে। সিআরবিতে নিয়মিত হাঁটতে আসেন নাজনিন। মেলার বিষয়ে জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘শহরের আর কোথাও এমন খোলামেলা পরিবেশ নেই। নগরীর বাতাস যখন শ্বাস নেওয়ার অনুপযুক্ত, তখন বুক ভরে নিশ্বাস নিতে আমরা এখানে ছুটে আসি। এখন মাসের পর মাস যদি জায়গাটা মেলার দখলে থাকে, তাহলে মানুষ যাবে কোথায়?’

এসময় প্রশ্ন তুলে নাজনিন বলেন, ‘খেলার মাঠগুলো সব তো মেলার দখলে চলে গেছে। শহরের এই একটি জায়গা কি রক্ষা (ছাড়) দেওয়া যায় না?’

Advertisement

শিরীষতলার মাঠে প্রতিদিন খেলতে আসে কয়েকশ কিশোর-যুবক। পাঁচ থেকে সাতটি দলে ভাগ হয়ে ক্রিকেট-ফুটবলসহ বিভিন্ন খেলায় মাতে তারা। বুধবার বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, শিরীষতলায় যখন মেলার স্টল তৈরির কাজ চলছে, তখনও কিছু তরুণ মাঠের একপাশে মেতে উঠেছেন ফুটবল নিয়ে। কিন্তু আগামীকাল শুক্রবার থেকে তাদের আর এখানে খেলা হবে না।

আরও পড়ুন: চট্টগ্রামের সিআরবি ধ্বংস অপরিণামদর্শী হবে

চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থৗ মোহাম্মদ আরমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আশপাশে খেলার কোনো মাঠ নেই। তাই আমরা অনেকদূর থেকে এই মাঠে খেলতে আসি। কিন্তু কিছুদিন পরপর মেলার কারণে আমাদের খেলা বন্ধ হয়ে যায়। মাঠে যখন মেলা বসে তখন ইট, বালু আর অস্থায়ী স্থাপনার কারণে মাঠ ক্ষতবিক্ষত হয়। মেলার পরেও দীর্ঘদিন মাঠে খেলার পরিবেশ থাকে না।’

একসময় ডিসি হিলে, পরে আউটার স্টেডিয়ামে বইমেলা হতো। কিন্তু খেলার মাঠে শুধু বইমেলাই নয়, কোনো মেলা করতে দেবে না। তাহলে করবো কোথায়? বাধ্য হয়ে সিআরবিতে এসেছি।

তিনি বলেন, ‘মাঠের খেলা বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের বন্ধুরা মোবাইল গেম নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এ কারণে অনেকেই বিপথগামীও হচ্ছে। আমরা চাই অন্তত এই মাঠটি খেলার জন্য উন্মুক্ত থাকুক।’

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মাহফুজুল হক বলেন, ‘সবুজ প্রকৃতি ঘেরা সিআরবিতে মাসব্যাপী মেলার অনুমতি দেওয়ার আগে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের ভাবা উচিত ছিল। বিগত বছরগুলোতে আমরা কখনোই সিআরবি শিরীষতলায় মেলার আয়োজন দেখিনি। সিআরবি মেলার জায়গা না। এখানে শুধু পহেলা বৈশাখ আর বসন্ত উৎসব হয়।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা (পূর্ব) সুজন চৌধুরী বলেন, ‘সিটি করপোরেশনকে বলেছিলাম এখানে মেলা করলে পরিবেশবাদীরা আমাদের প্রশ্ন করবেন। কিন্তু তারা আগে যেখানে মেলা করতো, সে মাঠটি না পাওয়ায় একেবারে শেষ মুহূর্তে অনুমতি দেওয়া হয়েছে।’

আরও পড়ুন: সিআরবি শুধু চট্টগ্রামের নয়, সারা দেশের সম্পদ

সিআরবিতে হাসপাতাল না করতে আন্দোলন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান মাকসুদ আহমেদ। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘এই জায়গাটি হচ্ছে চট্টগ্রামের মানুষের নিশ্বাসের ভূমি। এক অসাধুচক্র সিআরবিতে হাসপাতাল করতে চেয়েছিল। আমরা যারা চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক কর্মী ও সুশীলসমাজ- আমরা আন্দোলন করে তা করতে দেইনি।’

মাঠের একপাশে যখন চলছে মেলার স্টল তৈরির কাজ, অন্যপাশে ফুটবল খেলছেন কয়েকজন তরুণ/ ছবি- জাগো নিউজ

তিনি বলেন, ‘একসময় ডিসি হিলে আমরা পহেলা বৈশাখ উদযাপন করতাম, প্রশাসন বন্ধ করে দিলো। স্টেডিয়ামের বাইরে বইমেলা হতো, প্রশাসন বন্ধ করে দিলো। আউটার স্টেডিয়ামে মুক্তিযুদ্ধ বিজয়মেলা হতো, সেটিও বন্ধ হয়ে গেছে। মূলত আমলাদের প্রাধান্য ও চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতাদের দূরদর্শিতার অভাবে আমাদের এই দুর্গতি। চট্টগ্রামে সাংস্কৃতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য একটি স্থায়ী জায়গা প্রয়োজন।’

এভাবে খেলার মাঠ বেদখল হয়ে থাকলে একটি প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যাবে। শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হলে বড় ক্ষতি হবে জাতিরই। এ ক্ষতির প্রভাব হবে দীর্ঘমেয়াদি।

এই যখন পরিস্থিতি তখন প্রতিবছর সিআরবি মাঠেই বইমেলা করতে চান চট্টগ্রামের মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী। বইমেলার প্রস্তুতি নিয়ে বুধবার সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, যদি প্রতিবছর সিআরবিতে বইমেলা হয় তাহলে তা হবে আকর্ষণীয়।’

নাগরিক সমাজের আপত্তির কথা জানিয়ে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় চসিক মেয়রের কাছে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘একসময় ডিসি হিলে, পরে আউটার স্টেডিয়ামে বইমেলা হতো। কিন্তু খেলার মাঠে শুধু বইমেলাই নয়, কোনো মেলা করতে দেবে না। তাহলে করবো কোথায়? আছে লালদীঘির মাঠ। সেখানেও ছেলেরা খেলাধুলা করে। তাই বাধ্য হয়ে সিআরবিতে এসেছি।’

রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘বাকলিয়ায় চসিকের মাঠ আছে। কিন্তু সেটি একটু দূরে হয়ে যায়, সবার জন্য যাতায়াত সহজ নয়। শুধু মাঠের অভাবে এবার বিজয়মেলা করতে পারিনি।’

আরও পড়ুন: তথ্যগত ভুলে সিআরবি আন্দোলন কি-না, খতিয়ে দেখা হচ্ছে

শিশু-কিশোরদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ মাথায় রেখে নগরীর ১০ শতাংশ জায়গা উন্মুক্ত রাখার বিধান রাখা হয়েছিল ১৯৯৫ সালে করা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) মহাপরিকল্পনায়। অথচ ওইসময়ে যতগুলো মাঠ ছিল, এখন তাও নেই। গত কয়েক দশকে নগরীতে জনসংখ্যা বাড়লেও খেলার স্থান সংকুচিত হয়েছে। এভাবে খেলার মাঠ হারিয়ে যেতে বসায় চট্টগ্রাম থেকে আগের মতো খেলোয়াড় উঠে আসছে না।

চট্টগ্রাম শহরে একসময় ছিল লালদীঘি মাঠ, কলেজিয়েট স্কুল মাঠ, পলোগ্রাউন্ড, জাম্বুরি মাঠ, আউটার স্টেডিয়াম মাঠ, চট্টগ্রাম সরকারি স্কুলের মাঠ, প্যারেড মাঠ, শহীদ শাহজাহান মাঠ, সেন্ট প্লাসিডস স্কুলের মাঠ, নাসিরাবাদ স্কুল মাঠ, জামিয়াতুল ফালাহ মসজিদ মাঠ, হালিশহর আবাহনী মাঠ প্রভৃতি। এগুলো নগরীতে খেলাধুলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মাঠ হিসেবে চিহ্নিত ছিল। তাছাড়া ছোট–বড় আরও অনেক খেলার মাঠ ছিল, যার অনেকগুলোই এখন সংকুচিত হয়ে গেছে বা হারিয়ে গেছে।

পার্ক তৈরি করায় হারিয়ে গেছে জাম্বুরি মাঠ। বাকি মাঠগুলোও বছরের বিভিন্ন সময় মেলার কারণে বন্ধ থাকে। কার্যত চট্টগ্রাম নগরীতে এখন মাত্র দুটি খেলার মাঠ আছে। একটি চকবাজারের প্যারেড মাঠ, অন্যটি কাজীর দেউড়ির আউটার স্টেডিয়াম।

খেলার মাঠে মেলা আয়োজন না করতে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করতে সব জেলায় খেলার মাঠ তৈরির ঘোষণাও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। খেলার মাঠ মেলামুক্ত রাখা চট্টগ্রামবাসীরও দীর্ঘদিনের দাবি। এ দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করে খেলার মাঠে মেলা না করার বিষয়ে উদ্যোগও নেয় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। প্রথম উদ্যোগ হিসেবে চট্টগ্রাম আউটার স্টেডিয়াম অংশে মেলা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও সমাজবিজ্ঞানী ড. ইফতেখারুল ইসলাম চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘এভাবে খেলার মাঠ বেদখল হয়ে থাকলে একটি প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যাবে। শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হলে বড় ক্ষতি হবে জাতিরই। এ ক্ষতির প্রভাব হবে দীর্ঘমেয়াদি।’

এএজেড/কেএসআর/এএসএম