পার্কের গাছের ডালে বসে আপন মনে পাকা আতাফল খাচ্ছে সবুজ টিয়া পাখি। চড়ুই, দোয়েল, শালিকসহ হরেক পাখির কিচিরমিচির। বকুল ফুল গাছের নিচে সবুজ ঘাসে আসন পেতে নীরব পরিবেশে পড়াশোনায় ব্যস্ত একটি মেডিকেল কলেজের দুই শিক্ষার্থী। পাতা-ফুলের ফাঁক গলে শীতের মিষ্টি রোদ তাদের ছুঁয়ে দিচ্ছে আলতো করে। ওপাশে বাবা-মা যখন হাঁটায় ব্যস্ত সন্তানরা তখন সবুজ ঘাসে খেলছে আপন মনে। বাইরে অসংখ্য গাড়ি-মানুষ চলাচল করলেও স্বচ্ছ কাচসদৃশ নয়েজ ব্যারিয়ার বা শব্দনিরোধক থাকায় তার তেমন প্রভাব নেই পার্কের অন্দরে।
Advertisement
জার্মানির আধুনিক প্রযুক্তির নয়েজ ব্যারিয়ার ব্যবহার করে ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানে সংস্করণ করা হয়েছে শহীদ ডা. ফজলে রাব্বি পার্ক। শব্দদূষণের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রাখা দেশের প্রথম এ পার্কটির সংস্করণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৩ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন>> প্রায় ১৭০০ বৃক্ষের সন্নিবেশে সজ্জিত বিচারপতি শাহাবুদ্দিন পার্ক
গত ১ ফেব্রুয়ারি সংস্কারকাজ শেষে জনসাধারণের জন্য পার্কটি উন্মুক্ত করে দেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। সংস্থাটির দাবি, প্রায় ১২ কোটি ৭১ লাখ টাকা ব্যয়ে পার্কটি আধুনিক ও ব্যতিক্রমী করা হয়েছে। শব্দদূষণ রোধে পার্কের চারপাশে স্থাপন করা হয়েছে স্বচ্ছ শব্দরোধক (Transparent Noise Barrier) সীমানাপ্রাচীর। ফলে বাইরের চেয়ে পার্কের ভেতরে শব্দ ৫০ শতাংশ কম।
Advertisement
সিটি করপোরেশনের দাবির সঙ্গে একমত পার্কে আগত দর্শনার্থীরা। তারা জানান, ডিএনসিসির এ উদ্যোগ সত্যিই ব্যতিক্রম। পার্কের চারপাশে সড়কে যানবাহন চললেও ভেতরে তেমন শব্দ নেই, যা দেশের অন্য পার্ক থেকে আলাদা। এছাড়া পার্কটির প্রাকৃতিক পরিবেশ ও নান্দনিক নকশা সবার পছন্দ হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, পার্কের চারপাশে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে হাঁটাচলার পথ তৈরি করা হয়েছে। এ হাঁটাচলার পথ তৈরিতে কোনো গাছ কাটা হয়নি। গাছ বাঁচাতে হাঁটাচলার পথই কিছুটা ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার কিছু গাছ রাখা হয়েছে হাঁটাচলার পথেই। দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে কৃত্রিম লেকের ওপর করা কয়েছে স্টিলের সেতু। পার্কের দক্ষিণ পাশে প্রায় ১০০ ফুট উঁচু টিলা তৈরি করা হয়েছে। সবুজ এ টিলায় উঠতে রয়েছে সিঁড়ি। অনেক শিশু-কিশোর ঘাসের ওপর দিয়েই টিলায় উঠছে, খেলা করছে।
আরও পড়ুন>> অরক্ষিত পান্থকুঞ্জ পার্ক, ৩ বছর ধরে বন্ধ
অনেকে বেঞ্চে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন, পড়ছেন দৈনিক পত্রিকা ও প্রিয় লেখকের বই। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন খেলছে শিশু-কিশোররা। অনেকে পার্কের নান্দনিক পরিবেশ, মাটির টিলা এবং ঔষধি, ফল, ফুল গাছের কাছে গিয়ে ছবি তুলছেন।
Advertisement
পার্কের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রয়েছে একটি আতাফল গাছ। এ গাছে শতাধিক ফল রয়েছে। গাছের সামনে দাঁড়িয়ে অনেকেই ছবি তুলছেন। হাতের নাগালে পাকা ফল পেলে পেড়েও খাচ্ছেন কেউ কেউ। আবার একটি টিয়া পাখিকেও দেখা গেলো আতাফল খেতে। এছাড়া পার্কে আম, জাম, কলা, তাল, খেজুর, নারিকেল, আমলকী, পেয়ারাসহ হরেক রকমের ফল গাছ দেখা গেছে।
শহীদ ডা. ফজলে রাব্বি পার্কে নীরব পরিবেশে নিয়মিত গ্রুপ স্ট্যাডি করেন তেজগাঁওয়ের এম এইচ শমরিতা মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সানজিদা ও ইশতিয়াক আহমেদ আপন। আলাপকালে ইশতিয়াক আহমেদ আপন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা অনেকদিন ধরেই এমন একটা পরিবেশ খুঁজছিলাম, যেখানে আমরা নিরিবিলি পড়াশোনা করতে পারবো। মেডিকেলে অনেক পড়া, একটা পড়তে গেলে অনেক সময় বোরিং হয়ে যাই। কিন্তু পার্কে আমরা সকাল থেকে পড়াশোনা করছি। দু-তিন ঘণ্টা পর পর উঠে প্রাকৃতিক পরিবেশে হাঁটাচলা করি। আবার পড়তে বসি।’
তিনি বলেন, ‘কলেজের গ্রন্থাগারে পড়তে গেলে কলহের একটা ব্যাপার আছে। এটা একটা পার্ক হওয়া সত্ত্বেও খুবই সুন্দর পরিবেশ। এজন্য আমরা দূর থেকে হেঁটে পার্কে পড়তে যাই। দেখা যায়, আমরা খুব সকালে আসি, সন্ধ্যায় অন্ধকার হওয়ার আগ পর্যন্ত থাকি। এজন্য মেডিকেল কলেজে ক্লাস বন্ধ থাকলে এ পার্কে চলে আসি।’
পার্কে ব্যবহৃত স্বচ্ছ শব্দরোধক সাধারণ দরজা-জানালার কাচ নয়, বরং অতি উচ্চমানের স্বচ্ছ এক্সট্রুডেড অ্যাক্রেলিকজাতীয় পদার্থ। এটা সুনির্দিষ্টভাবে স্বচ্ছ শব্দরোধক হিসেবে এবং পরিবেশ সংক্রান্ত যাবতীয় বিধিমালা অনুসরণ করে জার্মানিতে তৈরি। এমনকি পাখির নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোড মেনে নির্দিষ্ট দূরত্বে বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত কিছু সমান্তরাল রেখা দেওয়া রয়েছে, যা বার্ড সেফটি স্ট্রিপ নামে পরিচিত।–মেয়র আতিকুল ইসলাম
এসময় তার সহপাঠী সানজিদা বলেন, ‘এই পার্কের নীরব পরিবেশটাই আমাদের সবচেয়ে বেশি পছন্দ হয়েছে। আমাদের পড়াশোনা দেখে মায়ের বয়সের অনেক নারী এগিয়ে আসেন, তাদের শিক্ষাজীবন নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন। আমাদের পড়াশোনার জন্য উৎসাহ দেন, যা অন্য পার্ক থেকে ব্যতিক্রম এবং আনন্দের।’
ডিএনসিসির প্রকৌশল বিভাগ সূত্র জানায়, পার্ক ‘নীরব এলাকা’ হিসেবে গণ্য। সরকারের ‘শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬’ অনুযায়ী শহীদ ডা. ফজলে রাব্বি পার্কে দিনে ও রাতে সর্বোচ্চ অনুমোদনযোগ্য শব্দমাত্রা হওয়া উচিত যথাক্রমে ৫০ ও ৪০ ডেসিবেল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখা যায়, এই পার্কে শব্দদূষণ মাত্রা বিধিমালায় অনুমোদনযোগ্য মাত্রা থেকে অনেক বেশি।
পার্কের ভিতরে ক্রিটিক্যাল ডিজাইন অ্যাভারেজ শব্দদূষণ মাত্রা প্রায় ৭৫ ডেসিবেল। এমনকি এই মাত্রা কখনো কখনো ৮৬ ডেসিবেল ছাড়িয়ে যায়। অথচ পার্কে থাকা পাখি, ছোট জীব-জন্তু ও পোকা-মাকড়ের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার জন্যও এই শব্দদূষণ মাত্রার নিচে রাখা জরুরি। তাই স্বচ্ছ শব্দরোধক ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয় ডিএনসিসি, যা শব্দের এ মাত্রা অর্ধেকে নামিয়েছে।
পার্কে ফুটপাত সংলগ্ন খোলা জায়গা ও বসার ব্যবস্থা, গাড়ি ড্রপ-অফ ও সাইকেল পার্কিং ব্যবস্থা, গাছপালা ও সবুজায়ন, হাঁটাপথ, হাঁটাপথের ছাউনি, লাইটিং, বসার বেঞ্চ, স্প্রিঙ্কলার ও অন্যান্য সুবিধা, সার্ভিস ব্লক, মাটির টিলা, গ্রিন ওয়াল, বাচ্চাদের খেলার ব্যবস্থা, ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজের ব্যবস্থা, পানি শোষণ চ্যানেল ও ড্রেনেজ, রেইন গার্ডেন ও জলাধার, সেতুসহ নানান ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফলে ঢাকা শহরসহ সারাদেশের অন্য পার্ক থেকে এটা ব্যতিক্রম।
গুলশান নিকেতন আবাসিক এলাকা সংলগ্ন ডা. ফজলে রাব্বি পার্ক। ফলে নিকেতনের অনেকেই সকাল-বিকেল এই পার্কে হাঁটাচলা, বাচ্চাদের নিয়ে বেড়াতে চলে আসেন। তাদেরই একজন জেসমিন আক্তার। আলাপকালে জেসমিন আক্তার বলেন, ‘পার্কটি অনেক সুন্দর, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বাচ্চা নিয়ে প্রায়ই আমরা ঘুরতে আসি। আগে যে এখানে পার্ক ছিল, সেটা বোঝা যায় না। মনে হয় নতুন পার্ক করেছে। এখানে হাঁটার পথ, বসার বেঞ্চ, লেক, সেতু, টিলা সৌন্দর্য বাড়িয়েছে।’
মধ্য বাড্ডার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম। গুলশান-১ এর একটি বেসরকারি অফিসের গাড়িচালকের চাকরি করেন তিনি। মঙ্গলবার (৬ জানুয়ারি) দুপুরে কাজের ফাঁকে কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে পার্কে বেড়াতে যান জাহাঙ্গীর। আলাপকালে বলেন, ‘আগের তুলনায় এখন বিকেলে অনেক মানুষ পার্কে বেড়াতে আসে। পার্কের চারপাশের সড়কে যানবাহন চললেও ভেতরে তেমন কোনো শব্দ নেই। তবে পার্কের দক্ষিণ পাশে টিলার পাশে ময়লা রাখার ঘর (এসটিএস) রাখায় পার্কে কিছুটা দুর্গন্ধ ছড়ায়। এটি সরিয়ে নিলে পার্কটি আরও আকর্ষণীয় হবে।
গুলশান-১ এর পুলিশ প্লাজার ঠিক বিপরীত পাশে চারদিকে স্বচ্ছ কাচের শব্দরোধক দিয়ে ঘেরা ডা. ফজলে রাব্বি পার্ক। পার্কের উত্তর পাশে মূল ফটক। এ ফটকে ইংরেজি বর্ণ ‘এস’ এর আদলে তৈরি করা হয়েছে প্রবেশপথ। ফলে ফটক দিয়েও ভেতরে তেমন শব্দ ঢোকে না। অন্য পাশ দিয়েও শব্দ তেমন আসে না। তবে পার্কের বাইরে চারপাশের সড়কে যে শতশত যানবাহন হর্ন দিচ্ছে, তা বোঝা যায়।
জানতে চাইলে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ফজলে রাব্বি পার্কটি একটি আধুনিক ব্যতিক্রমধর্মী পার্ক। এ পার্কের চারদিকে শব্দদূষণ রোধে জার্মানি থেকে আমদানি করা দৃষ্টিনন্দন ট্রান্সপারেন্ট নয়েজ ব্যারিয়ার দেওয়া হয়েছে। ফলে বাইরের তুলনায় পার্কের ভিতরে ৫০ শতাংশ কম শব্দ থাকবে। যদিও বাংলাদেশে এটা নতুন কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশেই পার্ক, পাবলিক স্পেস, এমনকি রাস্তার পাশের বনাঞ্চলগুলো শব্দদূষণ মুক্ত রাখতে এই শব্দরোধক সীমানাপ্রাচীর ব্যবহার করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘পার্কে ব্যবহৃত স্বচ্ছ শব্দরোধক সাধারণ দরজা-জানালার কাচ নয়, বরং অতি উচ্চমানের স্বচ্ছ এক্সট্রুডেড অ্যাক্রেলিকজাতীয় পদার্থ। এটা সুনির্দিষ্টভাবে স্বচ্ছ শব্দরোধক হিসেবে এবং পরিবেশ সংক্রান্ত যাবতীয় বিধিমালা অনুসরণ করে জার্মানিতে তৈরি। এমনকি পাখির নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোড মেনে নির্দিষ্ট দূরত্বে বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত কিছু সমান্তরাল রেখা দেওয়া রয়েছে, যা বার্ড সেফটি স্ট্রিপ নামে পরিচিত।’
ডা. ফজলে রাব্বি পার্কসহ ডিএনসিসির অন্য পার্ক দেশের সেরা স্থপতি ও প্রকৌশলীদের দিয়ে ডিজাইন করিয়েছেন জানিয়ে আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মতামত নিয়ে ডিজাইন করা হয়েছে। আমরা নারী, পুরুষ, যুবক, শিশুসহ সব বয়সের মানুষের সঙ্গে আলাপ করে পার্কের ডিজাইন করেছি। এক্ষেত্রে মানুষের সুবিধার বিষয় যেমন বিবেচনা করা হয়েছে তেমনি পাখিদের কথাও বিবেচনা করা হয়েছে।’
এমএমএ/এএসএ/জেআইএম