জাতীয়

হুঁশিয়ারি-অভিযানেও চলছে চাল ব্যবসায়ীদের ‘চালবাজি’

>> ৬ টাকা বেড়ে কমেছে ২ টাকা>> দুই অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা দুষছেন একে অপরকে>> মিলগেটের দামের সঙ্গে মিল নেই খুচরায়>> মন্ত্রীর হুঁশিয়ারি, ভোক্তার অভিযানেও কমছে না দাম

Advertisement

গত মাসে ভোটের সময় বাজারে হু হু করে বাড়ে চালের দাম। বাড়তে বাড়তে খুচরা পর্যায়ে চালের দাম বাড়ে ছয় টাকা পর্যন্ত। খাদ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের ডেকে দাম কমানোর জন্য চারদিন সময় দেন। ব্যবসায়ীরা তাতে সম্মতি দিলেও কথা রাখেননি। চালভেদে খুচরা পর্যায়ে সর্বোচ্চ কমেছে দুই টাকা। মন্ত্রীর হুঁশিয়ারি, ভোক্তা অধিকারের নিয়মিত অভিযানেও নিয়ন্ত্রণে আসছে না চালের বাজার। ব্যবসায়ীদের চালবাজিতে ধরাশায়ী ক্রেতা।

খাদ্যমন্ত্রীর নির্দেশনার (১৭ জানুয়ারি) পর থেকেই ঢাকাসহ সারাদেশে মজুতবিরোধী অভিযান শুরু করেছে খাদ্য অধিদপ্তর। প্রতিদিন শতাধিক প্রতিষ্ঠানকে লাখ লাখ টাকা জরিমানা করা হচ্ছে। অবৈধ মজুত করা ধান-চাল জব্দ করে নিলামে বিক্রি করে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। মাঝে মধ্যে খোদ খাদ্যমন্ত্রী নিজে অভিযানে যাচ্ছেন। কিন্তু তারপরেও এসব তোড়জোড়ের সুফল পাচ্ছে না সাধারণ ভোক্তারা। খুচরায় আগের দামে চাল কিনে খেতে হচ্ছে।

দাম আগের মতো নেই। অনেক কমেছে। তবে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা সেই তুলনায় দাম কমাচ্ছেন না। তাদের অধিক মুনাফার প্রবণতা বেশি।- বাংলাদেশ অটো, মেজর ও হাস্কিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি সহিদুর রহমান পাটোয়ারী

Advertisement

আরও পড়ুন>> সব পর্যায়ে চালের দাম কমেছে: খাদ্যমন্ত্রী

যদিও ব্যবসায়ীদের দাবি, এ অভিযানের ফলে কোথাও কোথাও ধান ও চালের দাম কিছুটা কমেছে। তবে প্রকৃতপক্ষে আগেই উচ্চমূল্যে থাকা চালের দাম কমেছে সামান্যই। অর্থাৎ, ভোটের সময় ও পরের কয়েকদিন চালের দাম ছয় টাকা বাড়লেও অভিযানের পর মোকাম ও পাইকারি বাজারে কমেছে দেড় থেকে দুই টাকা কেজিপ্রতি। সামান্য এ দরপতনের খুচরায় প্রভাব নেই।

মালিবাগ বাজারে সোহাগ হোসেন নামে এক শিক্ষার্থী এসেছেন চাল কিনতে। তিনি যে মেসে থাকেন সেখানে খাবারের খরচ ও বাজার করার দায়িত্ব তার। যে কারণে কয়েকমাস ধরে নিয়মিত তিনি চাল কিনছেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেখুন, বাজারে চালের দাম কমাটা সিনেমার একটি গল্পের মতো অবস্থা হয়েছে। প্রথমে ব্যবসায়ীরা ৫-৬ টাকা দাম বাড়ালো। এরপর সরকার নানা তোড়জোড় দেখালো। এরপর দাম ১/২ টাকা কমলো। তাতে ব্যবসায়ীও খুশি, বোকা ক্রেতারাও খুশি।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের এমন বোকা বানিয়ে ব্যবসায়ীরা ফায়দা লুটে যাচ্ছে, যার প্রশ্রয় তারা সরকারের কাছে পায়। কারণ সঠিকভাবে বাজার মনিটরিং হয় না, যা হয় সেটা লোক দেখানো। যখন অভিযান হয় তখন কমে, শেষ হলে আগের অবস্থা।’

Advertisement

ওই বাজারে চাল ব্যবসায়ী কুমিল্লা রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী খালেদ বলেন, ‘পাইকারি চালের বাজার এখনো চড়া। আমরা শুনেছি মোকামে দাম কমেছে। কিন্তু বাস্তবে ভোটের সময় দাম বেড়ে যেখানে উঠেছিল, সেখানেই আছে বলা চলে। তাই খুচরা বাজারে দাম কমেনি। পাইকারিতে দাম কমলে খুচরায় কমবে।

চালের দাম ছয় টাকা বেড়ে দুই টাকা কমেছে

ঢাকার বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, আগেই উচ্চমূল্যে থাকা চালের দাম কমেছে সামান্যই। বাজারে মিনিকেট চাল কেজিতে ছয় টাকা বাড়লেও খুচরা পর্যায়ে কমেছে সর্বোচ্চ দুই টাকা।

বড় বাজারে এখন প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৮ থেকে ৭২ টাকায়, যা একমাস আগে বিক্রি হয়েছে ৬৫-৬৬ টাকায়। আর ভোটের পরে ৭১ থেকে ৭২ টাকা বিক্রি হয়েছিল। খুচরা বাজারে এখনো মিনিকেট ৭২ থেকে ৭৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে।

আরও পড়ুন>> বেশি দামে পণ্য বিক্রি করলে ব্যবস্থা: হুঁশিয়ারি র‌্যাবের

এভাবে ব্রি-২৮ জাতের চালের কেজি ৫৫ থেকে বেড়ে ৬০ টাকা হলেও সবশেষ এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৮ টাকায়, স্বর্ণা ৫০ থেকে বেড়ে ৫৫ টাকা হলেও এখন ৫৩-৫৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

যদিও চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিল মোকাম ও পাইকারি বাজারে চালের দাম কমতে শুরু করেছে। কয়েক দিনের মধ্যে খুচরা বাজারেও এর প্রভাব পড়বে।

বাংলাদেশ অটো, মেজর ও হাস্কিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি সহিদুর রহমান পাটোয়ারী জাগো নিউজকে বলেন, ‘দাম আগের মতো নেই। অনেক কমেছে। তবে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা সেই তুলনায় দাম কমাচ্ছেন না। তাদের অধিক মুনাফার প্রবণতা বেশি।’

কুষ্টিয়ার ব্যবসায়ীরাই বাজার বেশি অস্থির করেছেন। যে কারণে খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে তারা দাম কমানোর বিষয়ে ইয়েস স্যার উত্তর দিয়েছেন। কিন্তু তাদের মোকামে এখনো ঠিকভাবে চালের দাম কমেনি।- নওগাঁ জেলা ধান-চাল আড়তদার সমিতির সভাপতি নিরোধ বরণ সাহা

তিনি বলেন, ‘ভরা মৌসুম হলেও এখন কৃষকের কাছে ধান নেই। মৌসুমের শুরুতে এক শ্রেণির মজুতদার ধান কিনে মজুত করেছেন। তারা সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ায় বাজারে দাম বাড়িয়েছিল। কিন্তু গত তিন সপ্তাহ ধরে সারাদেশে নানা অভিযানের কারণে বাজারে ধানের সরবরাহ বেড়েছে।

চালের দাম নিয়ে চালবাজি দুই অঞ্চলের মধ্যে

দেশের বাজারে যে পরিমাণ চাল বিক্রি হয় এর অধিকাংশ আসে কুষ্টিয়া ও উত্তরাঞ্চল থেকে। এখন চালের দাম বৃদ্ধি নিয়ে দুই অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা একে অপরকে দুষছেন। কুষ্টিয়া অঞ্চলের চালকল মালিক ও ব্যবসায়ী আবদুর রশিদ অভিযোগ করেন, ‘কুষ্টিয়ার চালকল মালিকেরা খেয়ালখুশি মতো চালের দাম বাড়ান না। উত্তরবঙ্গের কিছু করপোরেট চাল ব্যবসায়ী চালের দাম বাড়িয়েছিলেন। এ অঞ্চলের কোনো চালকল মালিক কেজিপ্রতি এক টাকাও লাভ করেন না।’

এদিকে উত্তরাঞ্চলের নওগাঁ জেলা ধান-চাল আড়তদার সমিতির সভাপতি নিরোধ বরণ সাহা জাগো নিউজকে বলেন, ‘কুষ্টিয়ার ব্যবসায়ীরাই বাজার বেশি অস্থির করেছে। যে কারণে খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে তারা দাম কমানোর বিষয়ে ইয়েস স্যার উত্তর দিয়েছেন। কিন্তু তাদের মোকামে এখনো ঠিকভাবে চালের দাম কমেনি।’

আরও পড়ুন>> চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাইস মিলে অভিযান, নেতৃত্বে খাদ্যমন্ত্রী

তিনি বলেন, ‘অঞ্চলভেদে চালের দামের কমবেশি হতে পারে পরিবহন খরচ বাবদ। তবে এ বিষয়টি সেভাবে বাজার প্রভাবিত করে না। কারণ পাইকারি বাজারে যে ব্যবসায়ীরা মোকাম থেকে চাল কেনেন, তারা সে খরচ বিবেচনা করে করেই যেখানে সস্তা পাবেন সেখানে কেনেন।

বাজারে চালের মূল্যবৃদ্ধির জন্য ব্যবসায়ীদের মধ্যেও একপক্ষ অন্যপক্ষকে দায়ী করার প্রবণতা চলছেই। চালকল মালিকেরা ধান ব্যবসায়ীদের দুষছেন। আর চাল ব্যবসায়ীরা এই দায় চাপাচ্ছেন মিলমালিকদের ওপর। করপোরেট কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধেও চালের মূল্যবৃদ্ধির অভিযোগ করছেন কেউ কেউ।

এত অভিযান-জরিমানা কাজে আসছে না সেভাবে

গত ১৮ জানুয়ারি দিনাজপুরের বিরল উপজেলায় ওরিয়েন্টাল অ্যাগ্রো প্রোডাক্ট নামে এক মিলে অভিযান চালায় উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এসময় সেখানে অনুমোদিত মজুতের থেকে অতিরিক্ত ২২৫ টন ধানের মজুত পাওয়া যায়। এসব মজুত করা ধান ওই সময় জব্দ করে সরকার।

১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের মিল মালিকের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করে উপজেলা প্রশাসন। পাশাপাশি জব্দ ধান সরেজমিনে উন্মুক্ত নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করে দেওয়া হয়।

এমন ঘটনা শুধু দিনাজপুরে নয়, প্রতিদিন সারাদেশে এমন অবৈধ মজুত জব্দ, ফুড গেইন লাইসেন্সসহ অন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকা, মূল্যতালিকা না থাকা এবং বেশি দামে ধান-চাল বিক্রির জন্য মামলা-জরিমানা করা হচ্ছে সারাদেশে। খাদ্য মন্ত্রণালয় প্রতিদিন কয়েকশ প্রতিষ্ঠানকে লাখ লাখ টাকা জরিমানার তথ্য দিচ্ছে। তারপরেও স্থিতিশীল হচ্ছে না চালের বাজার।

মন্ত্রী বলেছেন চালের দাম কমেছে

অবৈধ মজুতবিরোধী অভিযানের ফলে মিলগেট থেকে খুচরা সব পর্যায়ে চালের দাম কমেছে বলে দাবি করেছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। গত মঙ্গলবার বিকেলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে এ দাবি করেন তিনি। এসময় কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুস শহীদ ও বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু ছিলেন।

তবে তিনি এ-ও বলেন, এখন সব পর্যায়ে ব্যবসায়ীদের লাভ করার প্রবণতা খুব বেশি। খুচরা বিক্রেতা কেজি প্রতি ৪-৫ টাকা লাভ করতে চায়। মিলগেট আর খুচরা বাজারে দামের বিস্তর ফারাক।

তিনি ওই বৈঠকে জানান, মজুত বাড়িয়ে কৃত্রিম দাম বাড়ানোর প্রবণতা ঠেকাতে বস্তার গায়ে চালের মূল্য লেখা থাকতে হবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বস্তার গায়ে মিলগেটের দাম, ধানের জাত এবং উৎপাদন তারিখ উল্লেখ করতে হবে। এতে মিলগেটের দর জানতে পারবেন ক্রেতারা।

সাধন চন্দ্র মজুমদার আরও বলেন, খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন (ক্ষতিকর আইন প্রতিরোধ) আইন ২০২৩ এর বিধি প্রণয়নের কাজ চলছে। শিগগির এটি বাস্তবায়ন হবে। এতে চালে বাড়তি মুনাফা করার প্রবণতা কমে আসবে ব্যবসায়ীদের।

এনএইচ/এএসএ/জেআইএম