মতামত

ধর্ষককে ধর্ষক বিবেচনা করুন, ছাত্রলীগ-ছাত্রদল নয়

এমন ভাবনা কতখানি ন্যায্য হবে আমার জানা নেই যে, ক্ষমতা থাকলেই সবাই সব কিছু করে বা করবে। আমি যদি খুব স্বাভাবিক যুক্তিতে যাই, রাজনৈতিক ক্ষমতার কথাও বলি, তাহলে কি বলা সম্ভব সকল রাজনীতিবিদ একই। অথবা সকল রাজনৈতিক ক্ষমতার ‘প্রকার বা প্রকাশ’ একই ধরনের? তা যদি না হয়, তবে ধর্ষকের ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্তে কেন আসতে চাই যে, দলীয় ক্ষমতার কারণেই কেউ ধর্ষণ করছে বা করেছে? অথবা দলীয় ক্ষমতা ধর্ষণে সহায়ক এমন উপসংহারেও কী আসা খুব যৌক্তিক?

Advertisement

আমার তো মনে হয় সব কিছুই ব্যক্তির নিজস্ব রুচি, ধরন, আচরণ-মানসিকতার উপর নির্ভর করে।

যৌন আচরণ বা যৌন মনস্তত্ত্ব নিয়ে আমার অনেকদিন ধরে যে কাজের অভিজ্ঞতা, গবেষণা তা যদি বিবৃত করি তবে দেখব, ধর্ষণ কোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয়। এমন কি ধর্ষণকে কোনো স্বাভাবিক যৌন আচরণের মধ্যে ফেলা যাবে না; নেহাত মনোযৌন বিকৃতি ভিন্ন। সহজ করে বললে, ধর্ষণ এক ধরনের মনোযৌন বিকৃতি।

আরও সহজ করে বললে, ধর্ষণ আর স্বাভাবিক রতিক্রিয়া বা যৌনকর্ম এক নয়। স্বাভাবিক রতিক্রিয়ায় যে আনন্দ তা এখানে অনুপস্থিত। বরং ধর্ষকের আনন্দ বা পুলক অন্য জায়গায়। তা হলে আনন্দ বা পুলকটি কোথায়? যে জায়গায় তার অবস্থান তা বড় ভয়ংকর। অনেকটা রীতিমত আঁতকে উঠার মতো। আর সেই জায়গাটি হলো- নির্যাতন। ধর্ষক ধর্ষিতাকে শিকার মনে করে। শিকারকে ঘায়েল করতে পশু যেমন দাঁতে, নখে আচঁড়ে, কামড়ে বিপর্যস্ত করে তোলে, ধর্ষকের ক্ষেত্রেও তাই। ফলে লক্ষ্য করলে দেখবেন, ধর্ষিতার গায়ে বিচিত্র ধরনের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। কেউ কেউ ধর্ষিতার গোপনাঙ্গে বা শরীরের বিভিন্ন স্থানে নানা কিছু ঢুকিয়ে দিয়ে পুলক বা আনন্দ পায়। এখানে ফোর প্লে, লাভ মেকিং বা সেক্স কখনোই ধর্ষকের যৌন আচরণে লক্ষ্যণীয় নয়। চুমুর চেয়ে কামড়ই বরং তার যৌনক্রিয়ার অভীষ্ট লক্ষ্য। যৌন নির্যাতন তার আকাঙ্খিত। আর নির্যাতনের এই আকাঙ্খাই বিকৃতি। ফলে ধর্ষক একেবারেই বিকৃতমন ও বিকৃতকাম একজন ব্যক্তি। সে কোনো স্বাভাবিক ব্যক্তি নয়, একথা বলা যায় নিঃসন্দেহে।

Advertisement

গত ক’দিন ধরে সোস্যাল মিডিয়া তোলপাড় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের ঘটনায়। ক্যাম্পাসে দম্পতিকে ডেকে এনে স্বামীকে আবাসিক হলে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগ নেতাসহ ক’জনের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী নারীর পক্ষ থেকে জানা যায়, গত শনিবার সন্ধ্যায় তার স্বামীকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে নিয়ে আসেন মামুন নামে একজন। যে কিনা ভুক্তভোগীর বাড়িতে একসসময় ভাড়া থাকতেন। স্ত্রীকে নিয়ে দোকানে যাওয়ার কথা ছিল তার স্বামীর। তাই ফোন করে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে বলেন। পরে মোস্তাফিজ ও মামুন মিলে তার স্বামীকে মীর মশাররফ হোসেন হলের একটি কক্ষে আটকে রাখেন। হলসংলগ্ন জঙ্গলে নিয়ে মোস্তাফিজ ও মামুন ধর্ষণ করেন ঐ মহিলাকে। পরে ধর্ষিতা থানায় মামলা করেন ধর্ষক চক্রটির বিরুদ্ধে।

ধর্ষকের সঙ্গে ছাত্রলীগ পরিচয় যুক্ত থাকার কারণে তার প্রতি এবং এই ঘটনাটির প্রতি লোকের ধিক্কারের মাত্রা বেশ কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সাদা চোখে মনে হতে পারে আমরা সামাজিকভাবে বেশ সচেতন হয়েছি, আমাদের অগ্রসরতা প্রকাশ পাচ্ছে। আমরা যে কোনো যৌন নির্যাতনে অসম্মতি উৎপাদন করি। আমরা অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদ করি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যটি হলো, মোটেও তা নয়। আমরা আমাদের রাজনৈতিক জায়গা থেকে, বিবেচনা থেকে অপরাধকে দেখতে চাচ্ছি।

ফলে ধর্ষকের এমনকি ধর্ষণের ঘটনার পক্ষ-বিপক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে ইতোমধ্যে। ফলে একদল তার পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে অন্যদল নিচ্ছে বিপক্ষে অবস্থান, যা পুরোপুরি রাজনৈতিক। তার বড় কারণ আমরা রাজনৈতিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত অনেককাল আগেই।

আমার কথা হলো অপরাধকে অপরাধ এবং অপরাধীকে অপরাধী হিসেবেই দেখা উচিত আমাদের। এখানে ছাত্রদল বা ছাত্রলীগ ইস্যু নয়; ইস্যু হচ্ছে ধর্ষণ কাণ্ডটি ছাত্রলীগ কোনোদিন বলেছে কাউকে ধর্ষণ করতে? কোনো ছাত্রদল বলেছে কাউকে ধর্ষণ করতে? আমার জানা মতে, অবশ্যই না। তাহলে দলীয় পরিচয় কেন টেনে আনা হচ্ছে? জাহাঙ্গীরনগরের ঘটনায় ধর্ষককে দলীয়ভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। আমার বিশ্বাস বিএনপি যদি ক্ষমতায় থাকতো, ছাত্রদলের পরিচয়ে যদি কেউ ধর্ষণের ঘটনায় যুক্ত থাকতো তার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতো। তাহলে কেন আমরা ধর্ষকের রাজনৈতিক পরিচয়কে ইস্যু করবার চেষ্টা করছি? বরং এই চেষ্টার ফলে ধর্ষকের যে অপরাধ, ঘটনার যে ফোকাস বিন্দু তা থেকে আলো সরে যায় অন্যদিকে। ফলে ধর্ষণের চেয়ে ধর্ষক কতবড় ছাত্রদল বা ছাত্রলীগ সেটি প্রধান হয়ে উঠে।

Advertisement

ধর্ষক একজন বিকৃত ব্যক্তি। ধর্ষককে আমি আর দ্বিতীয় কোনো পরিচয়ে দেখতে চাই না। চাই অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হোক। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। সমাজ ধর্ষকশূন্য হোক। বিকৃতি শূন্য হোক। তা না করে ধর্ষক কোন গোত্রের, কোন দলের, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের, কে তার আত্মীয়, কোথায় চাকরি করেন, কত বড় পদে এসবকে-গুরুত্ব, প্রাধান্য দিতে গিয়ে ধর্ষণের ঘটনাটি অপ্রধান হয়ে উঠে।

আমাদের দার্শনিক দারিদ্র্য গভীরে যেতে, নিবিড়ভাবে ভাবতে দেয় না। উপরিকাঠামো থেকে সবকিছু দেখতে উৎসাহ যোগায়। ফলে বড় বড় দালান কোটা, ব্রিজ কালভার্টকে আমরা ‘উন্নয়ন’ জ্ঞান করি। উচ্ছ্বাসের ঢেঁকুর তুলে আরাম বোধ করি। কিন্তু বুঝতে হবে মানবিক উন্নয়ন ছাড়া এসব উন্নয়ন অর্থহীন, স্থাপনা মাত্র। কেননা মানুষের জন্যই তো সব, দেশ-রাষ্ট্র-সমাজ।

ভুলে গেলে চলবে না উন্নতির সূচক উপরের দিকে, কিন্তু অগ্রগতির সূচক সামনের দিকে। উন্নয়ন হচ্ছে, উন্নতি হচ্ছে অবকাঠামোগত।কিন্তু অগ্রগতির খবর কী?মানবিক উন্নয়ন, অগ্রগতির?

লেখক: সম্পাদক আজ সারাবেলা। সদস্য ফেমিনিস্ট ডট কম যুক্তরাষ্ট্র।

এইচআর/জেআইএম