প্রায় তিন যুগ আগের ঘটনা সগিরার মোর্শেদ সালাম হত্যা। সগিরার কাজের মেয়েকে মারধর করেন তার ভাসুর (স্বামীর বড় ভাই) ডা. হাসান আলী চৌধুরী। এ নিয়ে পারিবারিক বৈঠকে সগিরাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন হাসান আলী চৌধুরীর স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহীন। এরপর তারা নিজেদের বাসায় সগিরাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী হাসান আলী তার চেম্বারে আসা পূর্বপরিচিত মারুফ রেজার সঙ্গে ২৫ হাজার টাকায় হত্যার চুক্তি করেন। চুক্তি করা ২৫ হাজার টাকার মধ্যে তিনি মারুফ রেজাকে ১৫ হাজার টাকা দেন। ১০ হাজার টাকা পরে দেওয়ার কথা বললেও আর দেননি। মামলার চার্জশিটে এসব কথা উল্লেখ করেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।
Advertisement
মামলা সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৩৫ বছর আগে ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই সগিরা মোর্শেদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় সগিরার স্বামীর করা মামলায় মারুফ রেজা ও আনাস মাহমুদকে (হাসান আলীর শ্যালক) আসামি করা হয়। এ মামলার রায় ঘোষণার জন্য বৃহস্পতিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) দিন ধার্য করেছেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩ এর বিচারক মোহাম্মদ আলী হোসাইনের আদালত। গত বৃহস্পতিবার (২৫ জানুয়ারি) রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে এ দিন ধার্য করেন আদালত।
আরও পড়ুন>> সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলার রায় ৮ ফেব্রুয়ারি
রায়ে আসামিদের মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাশা করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। আসামিপক্ষের আইনজীবী বলছেন, আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। তাই খালাস পাবেন আসামিরা।
Advertisement
এ বিষয়ে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩ এর রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি রফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। রায়ে আসামিদের মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাশা করছি।
আসামিপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়নি। আদালতের কাছে আমরা ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করছি। আশা করছি, রায়ে খালাস পাবেন আসামিরা।
সগিরা মোর্শেদকে হত্যার চুক্তি হয় ২৫ হাজার টাকায়আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে আসামি হাসান আলী চৌধুরী বলেছেন, তিনি ইস্কাটনে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতেন। আসামি মারুফ রেজা তার রোগী ছিলেন। সে শহরে মাস্তানি করতেন। সগিরা মোর্শেদকে শায়েস্তার জন্য তিনি তাকে ঠিক করেন। তার সঙ্গে ২৫ হাজার টাকায় চুক্তি হয়। কিন্তু সে সগিরা মোর্শেদকে চিনতেন না। এ জন্য তার শ্যালক আনাস মাহমুদকে দায়িত্ব দেন সগিরা মোর্শেদকে চিনিয়ে দিতে।
ঘটনার দিন, ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই১৯৮৯ সালের ২৪ জুলাই সগিরা মোর্শেদের মেঝবোন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢাকায় আসেন। এ জন্য সগিরা মোর্শেদ ও আব্দুস সালাম তাদের রাজারবাগের বাসায় অনুষ্ঠানে সগিরা মোর্শেদের ভাই ডা.গওজ নেওয়াজ অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি। গওজ নেওয়াজকে খাবার পৌঁছে দেওয়ার জন্য সগিরা মোর্শেদ পরদিন ২৫ জুলাই বড় মেয়েকে ভিকারুননিসা নূন স্কুলে নামিয়ে দিয়ে মেঝ মেয়ে ও ছোট মেয়েকে নিয়ে ধানমন্ডি বাবার বাসায় যান।
Advertisement
আরও পড়ুন>> সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলা: সাক্ষ্য দিলেন মেয়ে সাদিয়া
সেখান থেকে বিকেল ৪টার দিকে সগিরা মোর্শেদ রাজারবাগে স্বামীর বাসায় ফিরে আসেন। সগিরা মোর্শেদের বড় মেয়ে সিদ্ধেশ্বরী ভিকারুননিসা স্কুলের ডে শিফটে (দুপুর) দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়তো। তার স্কুল ছিল দুপুর সোয়া একটা থেকে। তিনি বড় মেয়েকে রিকশায় আনা-নেওয়া করতেন। বিষয়টি হাসান আলী চৌধুরী, তার স্ত্রী শাহীন ও শ্যালক আনাস মাহমুদ জানতেন। সেই অনুযায়ী হাসান আলী চৌধুরী দুপুর দেড়টা থেকে দুইটার মধ্যে আনাসকে মৌচাকে গিয়ে মারুফ রেজাকে যেন সগিরা মোর্শেদকে চিনিয়ে দেন সে বিষয়ে অবহিত করেন। হাসান আলী চৌধুরীর কাছ থেকে বিস্তারিত টেলিফোনে জেনে মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে বের হয়ে প্রথমে বাসে, পরে টেম্পুতে করে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে মৌচাক পৌঁছান আনাস। সেখানে পৌঁছানোর প্রায় ১৫/২০ মিনিট পর মারুফ রেজা মোটরসাইকেলে পৌঁছান। মোটরসাইকেলে করে তারা দুইজনে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের দিকে যান। তারা ভিকারুননিসা নূন স্কুলের গেটের একটু দূরে মোটরসাইকেলে বসে সগিরা মোর্শেদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।
এরপর বিকেল পৌনে ৫টার দিকে বড় মেয়েকে স্কুল থেকে আনার জন্য বাসা থেকে বের হন সগিরা মোর্শেদ। চার টাকা ভাড়ায় ছালাম মোল্লা নামে একচালকের রিকশা নিয়ে স্কুলের দিকে রওনা দেন। মালিবাগ মোড় পেট্রোল পাম্পের সামনে দিয়ে মৌচাকের গলির ভেতরে দিয়ে রিকশাটি সিদ্ধেশ্বরীর মাঝামাঝি অতিক্রমকালে ওত পেতে থাকা আনাস মাহমুদ আঙুল দিয়ে সগিরা মোর্শেদকে চিনিয়ে দেন। মারুফ রেজা তাৎক্ষণিকভাবে মোটরসাইকেলে কিছুক্ষণ রিকশা ফলো করেন। পরে রিকশার সামনে গিয়ে মোটরসাইকেল দাঁড় করান। এসময় তারা মোটরসাইকেল থেকে নেমে পড়েন। মারুফ রেজা সগিরা মোর্শেদের হাতের ব্যাগ ছিনিয়ে নেন। সঙ্গে থাকা স্বর্ণালংকার টানা-হেঁচড়া করতে থাকেন। এসময় সগিরা মোর্শেদ সামান্য চিৎকার-চেঁচামেচি করেন এবং আনাস মাহমুদকে চিনে ফেলেন। বলেন, ‘তুমি তো রেজওয়ান, তোমাকে আমি চিনি। তুমি এখানে কেন?।’ এই কথা বলার পরপরই মারুফ রেজা রিভলবার বের করে এক রাউন্ড গুলি করেন। প্রথম গুলিটি সগিরা মোর্শেদের ডান হাতের কনুইয়ের নিচে লাগে। এরপর মারুফ আরেক রাউন্ড গুলি করেন। দ্বিতীয় গুলি সগিরা মোর্শেদের বুক ভেদ করে পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায়।
বুকে গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে রিকশা থেকে পড়ে যান সগিরা মোর্শেদআদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে আনাস মাহমুদ বলেন, বুকে গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে রিকশার বাম দিকে হেলে পড়েন সগিরা মোর্শেদ। পুরো রিকশা রক্তাক্ত হয়ে যায়। সগিরা মোর্শেদকে দ্বিতীয় গুলি করার পর আনাস মাহমুদ মারুফ রেজাকে বলেন, চলো পালাই। এসময় ভীতি ছড়ানোর জন্য মারুফ রেজা ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এরপর হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের সামনে দিয়ে পালিয়ে যায়। এসময় সগিরা মোর্শেদকে বহনকারী রিকশাচালক ছালাম মোল্লা ইট হাতে হাইজ্যাকার, হাইজ্যাকার বলে ধাওয়া করতে থাকেন। শান্তিনগরের কাছে হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের সামনে আনাস মাহমুদকে মারুফ রেজা মোটরসাইকেল থেকে নামিয়ে দেন। রিকশাচালক ফিরে এসে দেখেন সগিরা মোর্শেদ নেই। রক্তাক্ত রিকশা পড়ে আছে। পরে তিনি বিষয়টি রমনা থানায় জানান।
আরও পড়ুন>> সগিরা মোর্শেদ হত্যা: নির্ধারিত সময় শেষ না হওয়ায় মামলা বদলি
দেওয়া হয়নি চুক্তির বাকি ১০ হাজার টাকা১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই সগিরা মোর্শেদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় সগিরার স্বামীর করা মামলায় মারুফ রেজা ও আনাস মাহমুদকে আসামি করা হয়। ২০২০ সালের ১৬ জানুয়ারি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম আদালতে চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন, সগিরা মোর্শেদের পরিবারের সঙ্গে আসামি শাহীনের বিভেদ তৈরি হয়েছিল। এছাড়া শাশুড়ি সগিরাকে অপছন্দ করতেন এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে সগিরা-শাহীনের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। বিয়ে নিয়েও ছিল পারিবারিক দ্বন্দ্ব।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, সগিরার কাজের মেয়েকে মারধর করেন আসামি ডা. হাসান আলী চৌধুরী। এ নিয়ে পারিবারিক বৈঠকে সগিরাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন শাহীন। আসামিরা নিজেদের বাসায় বসে সগিরাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ডা. হাসান আলী তার চেম্বারে অন্য আসামি মারুফ রেজার সঙ্গে ২৫ হাজার টাকায় হত্যার চুক্তি করেন। চুক্তি করা ২৫ হাজার টাকার মধ্যে মারুফ রেজাকে ১৫ হাজার টাকা দেন হাসান আলী। ১০ হাজার টাকা পরে দেওয়ার কথা বললেও আর দেননি।
২০২১ সালের ২ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কেএম ইমরুল কায়েশের আদালত সগিরা মোর্শেদের ভাসুরসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এর মধ্যদিয়ে দীর্ঘ ৩১ বছর পর এ মামলার আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ শুরু হয়। এরপর গত বছরের ১১ জানুয়ারি মামলার বাদী ও সগিরা মোর্শেদের স্বামী আব্দুস সালাম চৌধুরী আদালতে সাক্ষ্য দেন। এর মধ্যদিয়ে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।
মামলার আসামিরা হলেন- সগিরা মোর্শেদের ভাসুর ডা. হাসান আলী চৌধুরী ও তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহীন, শ্যালক আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ান ও হাসান আলীর পূর্বপরিচিত মারুফ রেজা। গ্রেফতার চারজনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ মামলায় আদালতে ১৭ জন সাক্ষ্য দেন।
জেএ/এমএএইচ/এমএস