ব্লগার হত্যা। সমস্যাটা ধর্মের সাথে দ্বন্দ্ব, ধর্ম অবমাননা, আস্তিকতার বিপরীতে নাস্তিকতার যুদ্ধের খুব সরল আপাত রূপ পেলেও সমস্যাটা আপাদমস্তক “সামাজিক”।আমি সমাজবিদ নই। এই বিষয়ে কোনরকম বিশেষজ্ঞ জ্ঞান রাখিনা। কলামে কিংবা টক শোতে টেবিল চাপড়ে এই সমস্যা নিয়ে কোন বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন, সমস্যা নিরসনের উপায় উদ্ঘাটন আমার expert area র আলোকবর্ষ দূরে বাস করে। তাই তেমন কিছুর ধৃষ্টতাই আমি করবো না । শুধু একজন সচেতন মানুষ , সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে সরল কিছু জিনিস আলোকপাত করে সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে চাই। একজন খুন হওয়া, আর একজন খুনি হওয়া। দুটি তাজা প্রাণই কিন্তু শেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, খুনি তো দিব্যি বেচে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ধরা পড়ছে কারা আর বিচার হচ্ছে কই? আপনি নিজে বুকে হাত দিয়ে বলুন, একজন মানুষ খুন করার পর তার কি কোন মানসিক অবস্থা থাকে, নাকি মানুষের জীবন থাকে? সে হয়ে যায় পশু, তার চেতনা, অনুভূতি, ধরা পরার ভয় বা ধরা পড়লে সাজাপ্রাপ্তির ভয় তাকে করে ফেলে পাশবিক। কোন সুস্থ মানুষিক অবস্থাতে সে থাকতেই পারে না। তরতাজা সদ্য তৈরি যুবকগুলি ঝড়ে যাচ্ছে! কেউ চাপাতির এপ্রান্তে, কেউ ওপ্রান্তে! সমস্যাটা এখন বৈশ্বিক, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে। সংগত কারণেই আমি আমার দেশের সমস্যাটাতেই গুরুত্ব দিচ্ছি। আমাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। আল কোরআনে, হাদিস-শরীফে বারবার সতর্ক করা হয়েছে “পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়।” আমাদের ধর্মরক্ষাকারীরা কিন্তু এই সুমহান বাণী মনে রাখছেন না। তারা পাপীকে ঘৃণা করছে; ঘৃণা এতোটাই যে ব্লাসফেমি বা ধর্ম অবমাননার দায়ে তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলার ধারই ধারছেন না। কোরআনে উল্লেখিত এতদসংস্লিষ্ট অপরাধীদের জন্য প্রতিপালকের যে বিচার পরকালে অপেক্ষমান তা দুনিয়ার বুকেই সরাসরি নিজের হাতেই তুলে নিচ্ছেন! অন্যদিকে যারা ধর্ম অবমাননা করছেন ( *যদি এবং শুধুমাত্র যদিঃ তাদের মৃত্যুর পর প্রকাশিত লেখাগুলি তাদেরই হয়ে থাকে, ফেব্রিকেটেড নয়।) তারা স্রেফ পায়ে পা বাধিয়ে ঝগড়া করে যাচ্ছেন। তাদের ধর্মে বিশ্বাস নেই, তো নেই! কেউ তাদের দিন- রাত্রি সামাজিক মাধ্যমে বা সমাজে-লৈকিকতায় কটাক্ষ, হেয় প্রতিপন্ন করছে না। তবে সে কেন অন্যের বিশ্বাসকে কটাক্ষ এবং অশ্রদ্ধা করছে? খুব সুনিপুণভাবে তার লেখনির ক্ষমতা ক্রমাগত কাউকে আঘাত করতে, খোচাতেই অপব্যবহার করে যাচ্ছে? বিষয়টা কি এটাই ইংগিত করেনা, যে তার অবদমিত বা অচেতন মন জানে সে যা করছে তা ধর্ম-সমাজের চোখে নেতিবাচক, তাই “ধ্ব্নিটিরে প্রতিধ্বনি সদা ব্যাংগ করে”? ব্যাপারটা সাদা চোখে এমন, আমার বাবার কোন একটা বিষয় তিনি ধর্ম বা সমাজ কর্তৃক আদিষ্ট যা আমার পরিচিত কারো ভাল লাগে না বা তার মতাদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক। এখন তার সেই ভাল না লাগাতে কারো কিছু যায় আসে কিনা তার ধার না ধেরে আমাকে এসে বাবার সেই বিষয়টা নিয়ে নানাভাবে কটাক্ষ করে যাচ্ছে। এতে আমার কি প্রতিক্রিয়া হবার কথা? অবশ্যই পুলকিত হবার কোন কারণ নাই! আমি তার কথার প্রতিবাদ করবো। ব্যর্থ হলে মুরুব্বীদের কাছে নালিস জানাবো যে সে অহেতুক আমার অভিভাবককে অপমান করছে। এটাই কাংখিত। অন্যথায়, রাগে অন্ধ হয়ে কটাক্ষকারীকে তত্ক্ষণাৎ আঘাত করে বসবো। এখন আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, কেন এই অহেতুক খোচানো এবং কেন এই অসহিষ্ণুতা? আমার এর প্রধান কারণ মনে হয়েছে, একে অপরকে খাটো করে নিজের প্রাধান্য, নিজের মতামতকে ব্যতিক্রম, শ্রেষ্ঠতর কিছু প্রমাণের মাধ্যমে নিজেকে উন্নততর প্রমাণের চেষ্টা এবং এর জন্য এমনই মরিয়া যে একের পর এক লাশের সমুদ্রও তাদের ভাবিত করেনা। এসব হ্ত্যাকাণ্ডে অনেকে মনে মনে “বেশ হয়েছে” ভেবেও হাততালি দিচ্ছেন! আবার অন্যদিকে বীরের সন্মান দেয়া হচ্ছে অকালপ্রয়াত এসব তরুণদের যা আরো হাজার হাজার তরুণকে হয়তো এই ভুল পথে আকৃষ্ট করছে। অন্যদিকে চরম পথভ্রষ্ট ঘাতকেরা ফেরার, আত্মগোপনে থাকা গর্তের অন্ধকারের নিজেদের বোকার স্বর্গে ইদুরের জীবন বরণ করছে। কারণ, তাদের জীবনশৈলিতে তারাও বীরের সন্মান পাচ্ছে! কাফের হত্যার পারলৌকিক প্রাপ্তির স্বপ্ন তো আছেই! উল্লেখ্য, আজকে যারা এসবে জড়িয়ে যাচ্ছে, তাদের মত অগ্রসরদের কাছে পরাজাগতিক প্রাপ্তির ভিত্তি কতটুকু এটাও জানার বিষয়! কারণ, বিদেশী জার্নালে নজরে আসে, আইএস এ জড়িত অনেক তরুণ নাকি ফরয পাঞ্জেগানা নামাজও পড়েনা! কিন্তু দেশ হারাচ্ছে প্রতিশ্রুতিশীল অগণিত তাজা প্রাণ। আর তাদের ফেলে যাওয়া সংসার যে কি হারাচ্ছে তা আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চের নিষ্পাপতম বলী প্রকাশক ফয়সল আরেফীন দীপন ভাইয়ের বিধ্বস্ত পরিবারকে আর আমার শ্রেণিশিক্ষক প্রফেসর অজয় রায় স্যারের ছেলে অভিজিতদার অকাল প্রয়াণে স্যারের জীবন যন্ত্রণাকে! দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণে দুরূহ সমীকরণে এসব খুনের তালিকা প্রস্তূত করা হয়। ঘাতকেরা কার্যসিদ্ধি করে নির্বিঘ্নে ফিরে যায় তাদের নিয়মিত জীবনে। আমরা আম জনতা রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্লিপ্ততার পাশাপাশি “বিচারহীনতার সংস্কৃতি” নামক এক নতুন টার্মের সাথে পরিচিত হচ্ছি। যত্ন করে হিসেব মেলাচ্ছি, “এসবই কি খুনের বদলা খুন”! যুদ্ধ অপরাধীদের বিচার ত্বরান্বিত হয়- জ্বালাও পোড়াও করে দেশ অচল করে দেবার বদলে এক একজন ধর্ম অবমাননাকারীকে (!) সরিয়ে ফেলো। যেন দুপক্ষের মাঝে অলিখিত কোন বাণিজ্যিক চুক্তি! কাকতালীয়ভাবে মাত্র গেল সোমবারই আমার এক ছোট ভাইকে এইসব তত্ত্ব বিষয়ক তার হাজারো প্রশ্নের সহজীয়া উত্তর দিচ্ছিলাম, দেশ থেকে সে জানতে চেয়েছিল নিজামীর ফাঁসির আগেও কি তাহলে এমন বদলি খুনের ঘটনা হতে পারে নাকি? আমি জবাব দিয়েছিলাম, “Wait & See”! দেখলাম! এখন আর সেই সময় নেই যে ভেবে নেব মাদ্রাসার ধর্মীয় শিক্ষার আবৃত ছেলেরাই তাদের হুজুরদের নির্দেশে অন্ধ আফিমের নেশায় এসব ঘটাচ্ছে। নাম আসছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তথ্য প্রযুক্তিতে পড়া বিত্তবান সন্তানদের। জগতের সকল দিক যাদের কাছে উন্মোচিত; অন্ধত্বের কোন সুজোগই নাই! সমস্যা এখানে সহিষ্ণুতা হারাবার, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের চূড়ান্ত অব্ক্ষয়ের। একের অপরের বিশ্বাস, মূল্যবোধের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা নাই । আছে অবজ্ঞা, ঘৃণা- যার ন্যূনতম ছাড় কেউ দিতে রাজী নয়! পাছে সে দুর্বল প্রমাণিত হয়! আমার দৃষ্টিতে এটি বর্তমানের তীব্রতম সামাজিক সমস্যা, ক্ষেত্রভেদে মানসিক সমস্যাও। সুতরাং , আমাদের শ্রদ্ধেয় সমাজবিদ, মনস্তত্ত্ববিদ, এতদসংস্লিষ্ট শিক্ষক গবেষকগণ একে সর্বাধিক গুরুত্বের সাথে গবেষণার বিষয় হিসেবে নিলে গবেষণাটির বৈশ্বিক স্বীকৃতি প্রাপ্তির সম্ভাবনাও আছে। কারণ, এই সমস্যায় এখন আমাদের দেশ বা মুসলিম দেশই নয়; গোটা বিশ্ব জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে এই একই বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত। হতাশার বিষয় রাষ্ট্রযন্ত্র এই বিষয়ে আশ্চর্য নির্বিকার থেকে আমাদের “খুনের বদলা খুন” ধারণাকেই পোক্ত করছে। কিন্তু প্রজন্ম আমার-আপনার নয়- গোটা জাতিরই নষ্ট হচ্ছে। অত্যাবশ্যকীয় সামাজিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বার বার আমার ক্ষুদ্র লেখনীতে অনুরোধ জানিয়ে আসছি, সমাজপতি সমাজবিদেরা একটু দৃষ্টিদান করুন এই ভয়ানক সামাজিক ব্যাধির দিকে যা সর্বগ্রাসী নদী ভাঙ্গনের মতো সব গ্রাস করে নিতে ধেয়ে আসছে। লেখক : কলামিস্ট; প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপানএইচআর/এমএস
Advertisement