রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ১৭টি আবাসিক হলের টিউবওয়েল ও ট্যাপকলের পানি দুগর্ন্ধ ও আয়রনযুক্ত। বিকল্প হিসেবে আবাসিক হলগুলোতে সাবমারসিবল পাম্প থাকলেও পানি সরবরাহের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকায় নিয়মিত নিরাপদ পানি পান করতে পারছেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ফলে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিনিয়ত বাড়ছে পানিবাহিত রোগ জন্ডিস তথা হেপাটাইটিস ‘এ’ ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা।
Advertisement
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১৭টি আবাসিক হলে বিশুদ্ধ পানি খেতে শিক্ষার্থীদের জন্য টিউবওয়েল রয়েছে প্রায় ১১২টি। যার অধিকাংশ মরিচা ধরে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। যেসব টিউবওয়েল সচল তাতেও বিশুদ্ধ পানির দেখা মিলছে না। সেখানে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন এবং ময়লা। এছাড়া শিক্ষার্থীদের রান্না বা গোসলের জন্য রয়েছে ট্যাপকল। এতেও আসছে দুর্গন্ধযুক্ত লালচে পানি।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি আবাসিক হলেই বিশুদ্ধ পানির জন্য রয়েছে সাবমারসিবল পাম্প। কিন্তু দিনে তিনবার নির্দিষ্ট সময় তথা ২০-২৫ মিনিটের জন্য চালু করা হয় এসব সাবমারসিবল পাম্প। ফলে এসময় যারা হলে থাকেন, তারাই শুধু নিরাপদ পানি সংরক্ষণ করতে পারেন। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষার্থী ক্লাস-পরীক্ষা, টিউশন ও ক্যাম্পাসে থাকায় সাবমারসিবলের পানি সংগ্রহ করতে পারেন না। ফলে হলে এসে টিউবওয়েলের পানি সংগ্রহ করেই খেতে হয় তাদের।
এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের হোটেলগুলোতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার পরিবেশন এবং একই পানি দিয়ে একাধিক প্লেট পরিষ্কার ও একটি গ্লাস দিয়ে অনেকেই পানি পান করায় ছড়াচ্ছে এসব রোগ। এছাড়াও হোটেলগুলোর রান্নাবান্নার কাজে নিরাপদ পানি ব্যবহার করা হচ্ছে না। ট্যাপকল বা টিউবওয়েল থেকে পানি নিয়ে রান্নার কাজ করছেন দোকানিরা এবং একই পানি পান করাচ্ছেন শিক্ষার্থীদেরকেও। ফলে জন্ডিস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে প্রতিনিয়ত।
Advertisement
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, হলের টিউবওয়েলগুলোর গভীরতা ১০০-১৫০ ফুট হওয়ায় বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছেন না তারা। টিউবওয়েল থেকে ময়লা ও লালচে রঙের পানি বের হয়। মাঝে মাঝে পানিতে দুর্গন্ধ থাকে। টিউবওয়েল ছাড়া ট্যাপকলের পানিতে আরও বেশি ময়লা ও দুর্গন্ধ থাকে। পানি সরবরাহ করা ট্যাংকিগুলো খুবই অপরিষ্কার, যার ফলে সবসময় সেখানে ময়লা জমে থাকে।
এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল, একাডেমিক ভবন ও ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও ক্যাম্পাসের হোটেলগুলোর আশপাশে সাবমারসিবল পাম্পের ব্যবস্থা করার দাবি জানান শিক্ষার্থীরা। এছাড়াও বর্তমানে যেহেতু পানিবাহিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে ফলে আবাসিক হলগুলোতে যেন দিনে তিনবেলা না করে সারাদিনের জন্য সাবমারসিবল পাম্পের পানি চালু রাখা হয়। ক্যাম্পাসের হোটেলগুলোর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে প্রশাসন থেকে অভিযান পরিচালনা করা এবং নিয়মিত ট্যাপকলের ট্যাংকি পরিষ্কার করার দাবিও জানান তারা।
শেরেবাংলা হলে থাকেন নৃবিজ্ঞান বিভাগে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী খালিদ। তিনি বলেন, আমি আজ সকালেও খাবারের জন্য টিউবওয়েল থেকে পানি নিয়েছি। পানিতে খুবই ময়লা এবং দুর্গন্ধ থাকছে যার ফলে পানি খাওয়া যাচ্ছে না। সাবমারসিবল পাম্পের পানি না পাওয়ায় এসব পানি মাঝে মাঝে খেতে হয় আমাদের। যার ফলে অনেকেই পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। শীতের কারণে পানির লেয়ার নিচে নেমে যাওয়ায় অনেক সময় পানি পেতেও আমাদের কষ্ট হয়।
অর্থনীতি বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী নাসির বলেন, নিরাপদ পানি পান করার জন্য হলগুলোতে সাবমারসিবল পাম্প বসানো হয়েছে, কিন্তু সেখান থেকে অনেক সময় আমরা পানি সংগ্রহ করতে পারি না। দিনে তিনবেলা চালু করা হয় এসব পাম্প। অনেক সময় আমরা বিভিন্ন কাজে হলের বাহিরে থাকি। হলে ফিরে টিউবওয়েল থেকে আয়রনযুক্ত পানি খেতে হয় আমাদের। এসব দূষিত পানি পান করার ফলেই হেপাটাইটিস ‘এ’ ভাইরাস ছাড়াও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
Advertisement
বিশ্ববিদ্যালয়ের মন্নুজান হলে থাকেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী সুমাইয়া। তিনি বলেন, আমরা যারা হলে অবস্থান করছি এবং খাবারের দোকানে পানি পান করছি সেটি আসলে আমাদের জন্য নিরাপদ নয়। এখানে বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়াও মানা হচ্ছে না। আমরা প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করছি। এরজন্য আমাদের আবাসিক হল, একাডেমিক ভবনগুলোতে সাবমারসিবল পাম্পের ব্যবস্থা করতে হবে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান চিকিৎসক ডা. তবিবুর রহমান শেখ বলেন, শীতকালে ঠান্ডার কারণে মানুষ চলাচল কম করে, যার ফলে রক্ত চলাচলও কম করে। হেপাটাইটিস ‘এ’ ভাইরাসের কারণেই জন্ডিস হচ্ছে। এটি মূলত একটি পানিবাহিত রোগ। এ রোগ থেকে নিরাময় পেতে হলে সবার আগে প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের সচেতনতা। যেসব শিক্ষার্থী হলে থাকে তাদের সাবমারসিবলের পানি খেতে হবে। ক্যাম্পাসে হোটেল ও ক্যান্টিন মালিকদের উচিত টিউবওয়েল বা সাবমারসিবলের বিশুদ্ধ পানি দিয়ে রান্নার কাজ করা।
বিশুদ্ধ পানির জন্য সাবমারসিবল পাম্প স্থাপনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুমোদনক্রমে প্রতিটি হলেই আমরা সুপেয় পানির জন্য সাবমারসিবল পাম্পের ব্যবস্থা করেছি। যদি হলে দূষিত পানির দেখা মেলে তাহলে হল প্রভোস্ট আমাদেরকে অবহিত করলে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে ছাত্রদের জন্য তা সমাধান করার চেষ্টা করবো।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল প্রাধ্যক্ষ পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, অনেকগুলো হলে সাবমারসিবল কল নেই। বিশ্ববিদ্যালয় পানির মূল ট্যাংকিতে ময়লা জমে থাকায় আমাদের হলগুলোর ট্যাংকিতেও ময়লা পানি আসে। পানি আসার লাইনগুলোতেও আয়রন জমে আছে যার ফলে নিরাপদ পানি পাওয়া দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা প্রতিটি ব্লকে ব্লকে সাবমারসিবলের লাইন দেওয়ার চেষ্টা করছি। এ বিষয়ে আলোচনা করতে হল প্রভোস্টদের নিয়ে ৮ ফেব্রুয়ারি মিটিং আছে আমাদের। পানিবাহিত রোগ নিরসনে আমরাও কাজ করছি।
এফএ/জেআইএম