মতামত

টিআই’র সব স্বচ্ছতা আমেরিকার কাছে বাধা

‘টিআই সব সময় যুক্তরাষ্ট্রের কথায় পরিচালিত হয়’ ২০০৮এ ভেনেজুয়েলা এবং ২০২২এ হাঙ্গেরি নিয়ে টিআই’র দুর্নীতির ধারণা সূচক নিয়ে দেয়া রিপোর্ট দেয়ার পর এই কথাটিই বার বার এসেছিল সারা বিশ্বের গবেষকদের লেখায় এবং কথায়। এনিয়ে বিশ্ব নন্দিত পত্রপত্রিকায় বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছিল। ফলে প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল টিআই’র গ্রহণযোগ্যতা। সমালোচকরা তখন বেশ জোরে সোরেই তথ্য উপাত্ত দিয়ে বলছিলেন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ট্রান্সপারেন্সি বা স্বচ্ছতা আসলেই প্রশ্নবিদ্ধ।

Advertisement

২০০৮ সালে ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল সংস্থা পিডিভিএসএ’র রাজস্ব এবং রয়্যালিটি সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে টিআই। তাদের মতে প্রতিষ্ঠানটি মৌলিক আর্থিক তথ্য প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং তারা ঠিকঠাক নিরীক্ষিত অ্যাকাউন্ট তৈরি করেনি। এখানে তারা পিডিভিএসএকে ৪২ টি দেশের তেল সংস্থাগুলির মধ্যে সর্বনিম্ন র্যাংঙ্কিং দিয়ে একটা ধারণা সূচক প্রকাশ করে।

তেল যুদ্ধ বিষয়ক নিউ ইয়র্ক-ভিত্তিক ব্লগার ড্যান বার্নেট টিআই প্রকাশিত রিপোর্টটি দেখে বিস্মিত হন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে তিনি বলেন, বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি পিডিভিএসএ’র অ্যাকাউন্ট বিশ্লেষণ করছেন। প্রতিষ্ঠানটির অ্যাকাউন্টগুলো আন্তর্জাতিক অ্যাকাউন্টিং মান অনুযায়ী প্রস্তুত করা হয়েছিল। এর আর্থিক বিবৃতিগুলো হার্ড কপিতে প্রকাশ হয়। এগুলো বিশ্লেষণ করে রিপোর্ট করে বেশিরভাগ দেশি সংবাদপত্র এবং টেলিভিশন। তিনি আরও বলেন, ডানপন্থী বা মার্কিনপন্থী কিছু গণমাধ্যম টিআই-এর ‘জঘন্য’ প্রতিবেদনটি লুফে নেয়। তারা এই রিপোর্টটি ভেনেজুয়েলার সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রপতি হুগো শ্যাভেজকে পরাজিত করার জন্য অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে।

এই প্রতিবেদন বিশ্বের দুর্নীতি পরিস্থিতি দেয়ার চেয়ে দুর্নীতিকে বেশি প্রশ্রয় দেয়। কারণ টিআই-এর প্রতিবেদনগুলো বাস্তবতার সাথে মেলে না। প্রকৃতপক্ষে এটি কারো না কারো পক্ষে যায়। যারা পক্ষে নেয় তারাই শুরু থেকে এখানে টাকা ঢালতে থাকে। টিআই তাদের কাছ থেকেই তথ্য নেয় যারা তাদের উদ্দেশ্য পূরণের তথ্য দেবে।

Advertisement

এনিয়ে ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় রিপোর্ট করেন বিখ্যাত রিপোর্টার কেলভিন টাকার। রিপোর্টে তিনি বলেন, 'টিআইয়ের ভেনেজুয়েলা ব্যুরোতে কাজ করতো ওই সময়ের সরকারের বিরোধীরা। সেখানে ছিলেন, কট্টর সরকার বিরোধী সাময়িকী ভেনেকোনোমিয়ার প্রকাশক রবার্ট বটম এবং মার্কিন সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত রক্ষণশীল থিংক ট্যাংক, সেন্টার ফর দ্য ডিসেমিনেশন অব ইকোনমিক নলেজের অরেলিও কনচেসো। কনচেসো এর আগে ফেডেকামারাস নামের একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান পেদ্রো কারমোনা ২০০২ সালের ভেনেজুয়েলায় অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং ভেনেজুয়েলার স্বৈরশাসক হিসাবেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন।

রিপোর্টে বলা হয়, টিআইয়ের প্রতিবেদনে তথ্য সংগ্রহ করেছেন তাদের কারাকাস ব্যুরোর প্রধান এবং ভেনেজুয়েলার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজের দীর্ঘদিনের বিরোধী মার্সিডিজ ডি ফ্রেইটাস। তিনি আগে মার্কিন সরকারের অর্থায়নে দেশটির বিরোধী নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের গ্রুপ ‘ফান্ডাসিওন মোমেন্টো দে লা জেন্তে’ -তে কাজ করতেন। এই সংস্থা পরিচালনা করা হয় মার্কিন সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল এনডাওমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি দ্বারা।

সব মিলিয়ে প্রমাণ হয় প্রকৃতপক্ষে ভেনেজুয়েলার তেল কোম্পানি নিয়ে টিআই-এর দেয়া প্রতিবেদনটি অসত্য ছিল। এর বিপক্ষে সমস্ত তথ্যই প্রমাণিত ছিল। যে কারণে প্রতিবেদন দেয়ার আগে চতুরতার আশ্রয় নেয় টিআই। পরে এই পক্ষপাতিত্বের কারণ জানতে চাওয়া হলে, টিআই এর ভেনেজুয়েলা কর্তৃপক্ষ দাবি করে, প্রতিবেদন প্রকাশের সময় তথ্য পাওয়া যায়নি। তাদের এই দাবিও ছিল মিথ্যা। কারণ তাদের প্রতিবেদনে অভিযুক্ত তেল কোম্পানির কোন বক্তব্য ছিল না।

ভেনেজুয়েলার ঘটনার ১৬ বছর পর ২০২২ সালে আবার হাঙ্গেরিতে চরম বিতর্কিত হয় টিআই। এরমধ্যে যে সমালোচনা ছিলো না তা নয়। কিন্তু হাঙ্গেরির বিষয়টি একটু আলাদা করে দেখেন সমালোচকরা। কারণ ওইবার তাদের ধারণা সূচকের দোহাই দেয়া প্রতিবেদনে দাবি করে হাঙ্গেরি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্র।

Advertisement

পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অর্থনীতির দেশ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। এই প্রতিবেদনের পর হাঙ্গেরি সরকার দুর্নীতির উপর নজরদারি করে এমন একটি সংস্থা তৈরি করতে বাধ্য হয়। না হলে তাদের ইউরোপীয় ইউনিয়নের তহবিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়।

এক পর্যায়ে ইউরোপীয় কমিশনের সাথে হাঙ্গেরি সরকারের চুক্তির অংশ হিসাবে দুর্নীতিবিরোধী বিধিগুলির একটি সেট অনুমোদন করে তাদের পার্লামেন্ট। গঠন করে ইনটিগ্রিটি অথরিটি নামে একটি জাতীয় কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে তাদের জনপ্রিয় পত্রিকা হাঙ্গেরিয়ান কনজারভেটিভ ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি গবেষক এডাম ব্রাদারের একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, টিআই শূন্য থেকে ১০০ এর স্কেলে দেশগুলেকে রেট দেয়। এটি ব্যক্তিগত লাভের জন্য ক্ষমতার অপব্যবহার।

সেখানে আরও বলা হয় এই প্রতিবেদন বিশ্বের দুর্নীতি পরিস্থিতি দেয়ার চেয়ে দুর্নীতিকে বেশি প্রশ্রয় দেয়। কারণ টিআই-এর প্রতিবেদনগুলো বাস্তবতার সাথে মেলে না। প্রকৃতপক্ষে এটি কারো না কারো পক্ষে যায়। যারা পক্ষে নেয় তারাই শুরু থেকে এখানে টাকা ঢালতে থাকে। টিআই তাদের কাছ থেকেই তথ্য নেয় যারা তাদের উদ্দেশ্য পূরণের তথ্য দেবে। তথ্য সংগ্রহের আগেই তারা সিদ্ধান্ত নেয় এর ফলাফল কী হবে। যে কারণে বার বার এর অসঙ্গতি প্রমাণ হয়।

এডাম ব্রাদার ওই নিবন্ধে আরও উল্লেখ করেন, অনেকে টিআই প্রকাশিত তথ্য সত্য বলে মনে করেন। কিন্তু ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সূচকে অনেক সমস্যা রয়েছে। উদার গণতন্ত্রের নামে একটি পশ্চিমা মডেলকে তারা সুশাসনের মডেল হিসাবে নিশ্চিত করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে চালু করা সংজ্ঞাকে তারা দুর্নীতি মোকাবেলার একমাত্র উপায় বলে বিশ্বাস করে। আন্তর্জাতিক সমালোচকদের বরাত দিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, টিআই এর সূচক সবসময়, নেতিবাচক স্টেরিওটাইপ ধারণাগুলো শক্তিশালী করার একটি হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

এবারও সিপিআই সূচক প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল। এতে দেখা গেছে পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ, সব সূচকে যার উন্নতি হয়েছে। অথচ জন্ম থেকে এই দেশটি কোনো না কোনো ভাবে সেনা সমর্থিত সরকার পরিচালিত। জঙ্গিবাদ যে দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সব সময় মৌলবাদী ভাবধারায় পরিচালিত দেশটি এবার টিআইএর ধারণা সূচকের স্কোর ২ পয়েন্ট উন্নতি হয়েছে।

পাশাপাশি ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী অবস্থান উন্নতি হয়েছে সাত ধাপ। আরেকটি জায়গায় অবশ্য তারা দীর্ঘদিন স্থিতিশীল আছে। সেটি হচ্ছে মার্কিন অনুকম্পা। কোনো গণতান্ত্রিক আচরণ না থাকা সত্ত্বেও তারা দিনের পর দিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেসি কনফারেন্সে প্রতিনিধিত্ব করছে। সুতরাং টিআই তাদের দুর্নীতির সূচক নামানোর সাহস কে দেখাবে?

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।

এইচআর/এএসএম