অর্থনীতি

পোশাক খাতে বেড়েছে নতুন বিনিয়োগ, রপ্তানি কমেছে প্রধান বাজারে

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের সময়ে থমকে যায় বিশ্ব অর্থনীতি। বন্ধ হয়ে যায় নামি অনেক কোম্পানি। ছাঁটাই হন অসংখ্য কর্মী। যার আঁচ লাগে দেশের পোশাক খাতেও। সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয় রপ্তানি আদেশ। এরপর করোনার প্রকোপ কিছুটা কমায় ঘুরে দাঁড়ায় পোশাক খাত। তবে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ফের থমকে যায় অর্থনীতি। বেড়ে যায় জ্বালানি ও গ্যাস-বিদ্যুতের দাম। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সংকটে পড়ে দেশের রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশের নেতৃত্ব দেওয়া পোশাক খাত। দেখা দেয় বহুমুখী সংকট।

Advertisement

তবে বৈরী পরিবেশেও বিনিয়োগ আসে দেশে। গড়ে ওঠে কারখানা। গত দুই বছরে ছয় শতাধিক নতুন কারখানা গড়ে উঠেছে। যদিও নতুন বেতন কার্যকর, ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ায় বন্ধও হয়েছে বেশকিছু কারখানা। তৈরি পোশাক শিল্প খাতের প্রধান কিছু বাজারে রপ্তানি কমে যাওয়ায় বাড়ছে উদ্বেগ।

আরও পড়ুন>> বাংলাদেশের কর্ম পরিবেশ যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে উন্নত

দেশের তৈরি পোশাকের একক বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ২২ শতাংশ আসা এ বাজারে গত ১১ মাসে কমেছে ২৫ শতাংশ রপ্তানি। ইউরোপের বাজারেও রপ্তানি কমেছে। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে রপ্তানিতে সংকট দেখা দেবে- এমনটাই বলছেন উদ্যোক্তারা। যদিও এর সঙ্গে রাজনৈতিক কোনো বিষয় দেখছেন তারা।

Advertisement

তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফেকচার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) ও বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সূত্রমতে, ২০২৩ সালে নতুন করে ২৬৪ কারখানায় বিনিয়োগ এসেছে। ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩৩০টি। তথ্য বলছে, গত দুই বছরের দেশে নতুন করে বিনিয়োগ এসেছে ৫৯৪টি কারখানায়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, গত বছরে পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৭৩৯ কোটি ডলার। যেটা ২০২২ সালে ৪ হাজার ৫৭১ কোটি ডলারে নামে। সে হিসাবে ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে ১৬৮ কোটি ডলার বেশি পোশাক রপ্তানি হয়েছে।

আরও পড়ুন>> গার্মেন্টস সেক্টর নিয়ে অযথা পানি ঘোলা করার কারণ নেই: কাদের

সাম্প্রতিক সময়ে আবার একাধিক কারখানা বন্ধও হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, উৎপাদনের তুলনায় খরচ বেশি হওয়ায় ছোট অনেক কারখানা টিকতে পারছে না। বাধ্য হয়ে বন্ধ করতে হচ্ছে কারখানা। ডলার সংকটের কারণে এলসি খুলতে পারছে না, ব্যাংকগুলোও এলসি নিষ্পত্তি দিতে পারছে না। অনেকেই আবার বড় পরিসরে কারখানা করার জন্য ছোট কারখানা সরিয়ে নিচ্ছেন।

‘ব্যবসায়ীরা বলছেন, উৎপাদনের তুলনায় খরচ বেশি হওয়ায় অনেক ছোট কারখানা টিকতে পারছে না। বাধ্য হয়ে বন্ধ করতে হচ্ছে। ডলার সংকটে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না, ব্যাংকগুলোও এলসি নিষ্পত্তি দিতে পারছে না। অনেকে আবার বড় পরিসরে কারখানা করার জন্য ছোট কারখানা সরিয়ে নিচ্ছেন।’

Advertisement

পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অনেক ক্রেতাই পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। এ কারণে বিশ্ববাজার কিছুটা খারাপ অবস্থায় রয়েছে। এ পরিস্থিতি হয়তো খুব বেশি দিন থাকবে না। বাংলাদেশসহ সব দেশে রপ্তানি কমছে। দেশে সবুজ কারখানা, আধুনিক প্রযুক্তি আর পোশাকের নতুন বাজার তৈরি হওয়ায় বাড়ছে বিনিয়োগ।

তবে, এসবের মধ্যেও উদ্বেগের কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে প্রধান কিছু বাজারে রপ্তানি কমে আসা। বিশেষ করে দেশের তৈরি পোশাকের একক বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্রে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে পোশাক রপ্তানি। ইতালিতে রপ্তানি কমেছে ৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ। গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে ইউরোপের ২৭ দেশে কমেছে এক দশমিক ২৪ শতাংশ।

আরও পড়ুন>> বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত এলসির বিষয়ে ব্যাখ্যা দিলো বিজিএমইএ

তথ্য বলছে, মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ২০ থেকে ২২ শতাংশ আসে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর (১১ মাস) পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ৬৭৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যা ২০২২ সালের জানুয়ারি-নভেম্বর সময়ে ছিল ৯০৪ কোটি ডলার। সেই হিসাবে ১১ মাসে দেশটিতে পোশাক রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে কমেছে ২৫ শতাংশ।

‘উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বিশ্ববাজার কিছুটা খারাপ অবস্থায় রয়েছে। এ পরিস্থিতি হয়তো খুব বেশি দিন থাকবে না। বাংলাদেশসহ সব দেশে রপ্তানি কমছে। দেশে সবুজ কারখানা, আধুনিক প্রযুক্তি আর পোশাকের নতুন বাজার তৈরি হওয়ায় বাড়ছে বিনিয়োগ।’— বিজিএমইএ সভাপতি

চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) পোশাক রপ্তানি ১১ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এক দশমিক ২৪ শতাংশ কমেছে। ইইউর বৃহত্তম রপ্তানি বাজার জার্মানিতে এ সময়ে রপ্তানি ২০২২-২৩ জুলাই-ডিসেম্বরের তুলনায় ১৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ কমে ২ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাাঁড়িয়েছে। কানাডায় পোশাক রপ্তানি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ৭৪১ দশমিক ৯৪ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। দেশটিতে এক বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি কমেছে ৪ দশমিক ১৬ শতাংশ।

আরও পড়ুন>> পোশাক শ্রমিকদের ‘রক্তচোষা বায়ার-ব্র্যান্ড’

ফারুক হাসান বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র নানান পদক্ষেপ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভসহ অনেক দেশ নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতির চাপে সংকট তৈরি হয়েছে। তবে সহসাই কেটে যাবে এ পরিস্থিতি। সবকিছু আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরলে পোশাকের বিশ্ববাজার চাঙা হবে।

এসবের মধ্যে সুখবর দিচ্ছে অপ্রচলিত বাজার বা নতুন বাজার। অপ্রচলিত বাজারে আমাদের পোশাক রপ্তানি ক্রমেই বাড়ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর মাসে অপ্রচলিত বাজারে পোশাক রপ্তানি ১২ দশমিক ২৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে ৪ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল।

আরও পড়ুন>> অস্থিরতা লোহিত সাগরে, প্রভাব বাংলাদেশের ব্যবসায়

এ বিষয়ে ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অনেক দেশকেই এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে। অনেক বড় বড় বাজারে রপ্তানি কমে এসেছে। নতুন বাজার বা অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানি বাড়ছে। এটি দেশের তৈরি পোশাক খাতের জন্য ইতিবাচক দিক।

তিনি বলেন, অর্থবছরের ছয় মাসে দেশের পোশাক রপ্তানির প্রধান অপ্রচলিত বাজারগুলোর মধ্যে জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় রপ্তানি যথাক্রমে ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ, ২৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং ১৯ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ বেড়েছে। তবে, ভারতে আমাদের পোশাক রপ্তানি কমেছে ১৭ দশমিক ২৭ শতাংশ।

ইএআর/এমএএইচ/জেআইএম