আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে এ দুজন দার্শনিক যেহেতু দর্শনের দু’ভুবনের মানুষ তাই এঁদের মাঝে কোন মিল নেই। কিন্তু সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে তাঁদের চিন্তার মাঝে দারুণ সাজুয্যতা পাওয়া সম্ভব। মোটাদাগে বলা যায়, পপার ছিলেন বিশ্লেষণী দার্শনিক আর দেরিদা কন্টিনেটাল বা মহাদেশীয় ঘরানার। সাধারণত অ্যানালিটিক বা বিশ্লেষণী ধারার দার্শনিকের সাথে কন্টিনেন্টালের চিন্তার বিষয়বস্তু ও ধরনের একটা বিরাট গ্যাপ আছে। গণিত আর যুক্তিবিজ্ঞানের কঠোর দর কষাকষির মাধ্যমে ভাষার কাটাছেঁড়ার মধ্য দিয়ে অনুপুঙ্খ মূল্যায়ন করাটা বিশ্লেষণী দর্শনের একমাত্র কাজ। সে ক্ষেত্রে একটা আদর্শ ভাষা বা আইডিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ গঠন করাটা তাঁদের কাছে জরুরি। বিশ্লেষণী দর্শনের শুরুতে এই আইডিয়াল ল্যাংগুয়েজ নিয়ে রাসেল ভিটগেন্সটাইনের মতো পপারও চিন্তিত ছিলেন। তবে এটা ঠিক তরুণ পপার সেসময় সমাজতন্ত্র নিয়ে খুব ব্যস্ত। যাই হোক, পপার পুরোপুরি না হলেও প্রায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিশ্লেষণী ধারার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন। অন্যদিকে কন্টিনেন্টাল ধারার বিষয়বস্তু মানুষের অস্তিত্বের নানাবিধ অনুষঙ্গ। এমনকি ভাষাও। ভাষার বহুবিধ ব্যঞ্জনা কীভাবে মানুষের মনে অভিঘাত জাগায় তার নানান প্রকরণ নিয়েও কন্টিনেন্টালে আলোচনা হয়। তবে মুখ্যত, ভাবনাকে আপন ভাবরসে জাড়িত করে মানুষের আবেগ, অনুভুতি, প্রেম, বিরহ, হতাশা, ভালোবাসা, তথা ব্যক্তি অস্তিত্বের প্রতিটা কর্মধারার সাথে কন্টিনেন্টাল দর্শন ভীষণভাবে যুক্ত। সোজা কথায়, গণিত আর যুক্তিবিজ্ঞানের ছকবাঁধা কাঠামোর বাইরে যে বিরাট জগৎ বাহু মেলে আছে তার খবর নিতে এই দর্শন রীতিমত গলদঘর্ম। এই ছোট্ট নিবন্ধে এ দুজন আপাত বিরোধী মানুষ নিয়ে আলোচনা করবো, বিশেষ করে তাঁদের চিন্তার মিল অমিল।
Advertisement
আমরা শুরুতেই যেভাবে আলোচনার সূত্রপাত ঘটালাম তাতে মনে হতে পারে আমরা এ দুজনকে দারুণভাবে চিনে রেখেছি। আসলে এ দুজন যে খুব বেশি মানুষের কাছে পরিচিত এটা বলা যাবে না। কারণ দুজনই অতিমাত্রায় একাডেমিশিয়ান, সে কারণে উচ্চশিক্ষার গবেষণা কক্ষ ছাড়া সাধারণের কাছে খুব বেশি প্রবেশ করা তাঁদের পক্ষে সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। তবে এটা ভুললে চলবে না, তাঁদের আলোচনার বিষয়বস্তু কিন্তু সব ধরনের মানুষের মনের গভীর তলদেশ স্পর্শীত। এবং সেটা ঠিক কোথায় কোথায় তা নিয়েই আজকের আলোচনা। মাঝখানে বলে রাখি, পাশ্চাত্যের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দেশে পপার ও দেরিদা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ভাষা দর্শনে তাঁদের চিন্তা নিয়ে অন্তহীন গবেষণার খবর আমাদের কাছে আছে।
কার্ল রেইম্যন্ড পপার (১৯০২-১৯৯৪) ছিলেন অস্ট্রিয়-বৃটিশ দার্শনিক। সম্পূর্ণ ভিন্ন স্রোতের দিকে তিনি চলেছেন গোটা সময়জুড়ে। বিশ শতকে দর্শনের খুব পরিচিত স্কুল যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদের বিপরীতে ছিল তাঁর অবস্থান। প্রত্যক্ষবাদকে বিজ্ঞানের দার্শনিক অবস্থান হিসেবে মনে করা হয়, সেজন্য যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদ হচ্ছে বিজ্ঞান বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞানের এক অফিশিয়াল ব্র্যান্ড নেইম। অবশ্য শুধু পদার্থবিজ্ঞানই নয় যে কোনো ধরনের ভৌতবিজ্ঞানের মূলকথা হচ্ছে যা কিছু দেখতে পারো তাকেই গ্রহণ করো আর ইন্দ্রিয়াতীত বিষয় বাদ দেও জ্ঞানতাত্ত্বিক আবর্জনা মনে করে। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়গুলো ভাষায় প্রকাশিত হলে তাকে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে গ্রহণ করা আবশ্যক। আর এ ক্ষেত্রে যেসব বিষয়বস্তু ইন্দ্রিয়াতীত ও অধিকমাত্রায় অধিবিদ্যা ভারাক্রান্ত সেসব বাক্যগুলো বর্জন করতে হবে কোন দ্বিধা না রেখে। এ ধরনের অবস্থান তৈরি করতে হিউমের অবদান ছিল সাংঘাতিক। তিনিই পরবর্তী অভিজ্ঞতাবাদীদের অনুপ্রাণিত করেন এই বলে যে, শুধু যেসব বিষয় ‘ঘটনা সংক্রান্ত’ ও ‘ধারণার সম্বন্ধ’ বিষয়ক তা বাদে অন্যগুলো অর্থহীন। যাই হোক, প্রত্যক্ষবাদীরা এ কথায় ভীষণ অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এবং আরও এক ধাপ এগিয়ে তাঁরা বলেন, ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণ ছাড়া কোনকিছু মেনে নেওয়া সম্ভব না। অর্থাৎ, তাঁদের মগজের ভেতর এটা পরিপুষ্ট হয়েছিল যে, সব ধরনের অধিবিদ্যক ভাষাই কোন না কোনভাবে অর্থহীন। সব ধরনের বলছি এই জন্য যে, অধিবিদ্যার সাথে সাথে কবিতা, গান, এমনকি নীতিবিদ্যা, মূল্যবোধ সংক্রান্ত সবকিছুই অধিবিদ্যার মতো অর্থহীন, অন্তত জ্ঞানের সুকঠিন জালে এরা ধরা পড়বেই। আবেগীয় মূল্য যাই থাক না কেন জ্ঞানের রাজ্যে এটা অনাহূত! মোটকথা, পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে এগুলোকে যাচাই যোগ্য হয়ে উঠতে হবে। তাই প্রত্যক্ষবাদীরা একটা যুতসই অস্ত্র বের করলেন যার নাম দিলেন পরখনীতি। পপার তাঁদের এই অবস্থানের ঘোরতর বিরোধিতা করে বসলেন। বললেন, বিজ্ঞানের সবকিছুকে কোনদিন চূড়ান্তভাবে পরীক্ষা করা সম্ভব নয়। যা করতে হবে তা হলো মিথ্যা প্রতিপাদন। বিজ্ঞানের নির্বাচিত বিষয়কে চূড়ান্তভাবে পরখ করা সম্ভব নয় বরং সেটাকে মিথ্যা প্রতিপাদন করা যায়। আর এই মিথ্যা প্রতিপাদনের বিকল্প একটা নাম দিয়ে বসলেন থিওরি অব ফলসিফিকেশন। তাছাড়া পপারের পুরো দর্শনকে বলা হয় ক্রিটিক্যাল রেশনালিজম বা বিচারমূলক বুদ্ধিবাদ। মনে রাখা জরুরি, পপারের পুরো দর্শনটাই দাঁড়িয়ে আছে এই ক্রিটিক্যাল রেশনালিজম ওপর। ক্রিটিক্যাল রেশনালিজম গতানুগতিক বুদ্ধিবাদের মতো না; বরং যে কোন জ্ঞানকে গভীরভাবে ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যাচাই করে এগোতে হবে যেখানে বিজ্ঞানের কোনকিছুই নমস্য ভাবার কারণ নেই। আমরা যে বিজ্ঞানকে একদম ধোয়া তুলসীপাতা হিসেবে জানতাম পপারের কাছে তা এসে একদম হোচট খেলো। ইতিহাসের পুনর্পাঠের মাধ্যমে তিনি বাতিল করলেন বিজ্ঞান সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা। শুরু হলো, জ্ঞানের এক নব অভিযাত্রা।
অন্যদিকে জ্যক দেরিদা (১৯৩০-২০০৪) ছিলেন আলজেরিও-ফরাসি দার্শনিক। উনিশ বছরের ছাত্র হিসেবে তিনি ফ্রান্সে আসেন। এরপর ১৯৫৬/৫৭ সালে হাবার্ডে স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৬০ এর দশকে তিনিই একমাত্র তরুণ বুদ্ধিজীবী যিনি ফ্রান্সের সবচেয়ে নামকরা জার্নাল “টেল কুয়েল”-এ লেখার সুযোগ পান। দেরিদা ৪০টিরও বেশি বই লিখেছেন। এবং লিখেছেন শত শত মূল্যবান প্রবন্ধ। এগুলো যে সবই দর্শন সম্বন্ধীয় তা নয় বরং ইতিহাসতত্ত্ব, মানববিদ্যা, সামাজিক বিজ্ঞান, আইন, নৃতত্ত্ব, ভাষাবিজ্ঞান, মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ, রাজনৈতিক বিষয়াদি এবং মিউজিক বিষয়ক। তাঁর বিপুল কর্মধারা ইউরোপ ছেড়েও আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গবেষণার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৬৭ সালে ফরাসি ভাষায় অব গ্রামাটলজি লিখে ব্যাপক সাড়া ফেলেন। পরবর্তীতে গায়ত্রি চক্রবর্তী স্পিভাক ইংরেজি অনুবাদ করে বিশ্ব দরবারে দেরিদাকে পরিচয় করিয়ে দেন। এখানে তিনি ভাষার উৎস সন্ধানে একটা কার্যকরী পদ্ধতি অনুসন্ধান করতে চেয়েছেন যার প্রেক্ষিতে লিখনীর ধারণা আমাদের কথ্য ধারণার মতোই ব্যাপক হয়ে ওঠে। তবে সামগ্রিকভাবে তাঁর এই সুবিশাল কর্মভান্ডার ঘেঁটে একটা জিনিস পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে এবং সেটা হচ্ছে আধুনিকতার বিপরীতে উত্তর-আধুনিকতার যাত্রাপথ। উত্তর-আধুনিক দার্শনিক কাঠামোর মজবুত এক ভিত তৈরিতে দেরিদার নাম সবার আগে উচ্চারণ করা হয়। দেরিদার দার্শনিক তত্ত্বের নাম থিওরি অব ডিকন্সট্রাকশান বা বিনির্মাণবাদ। তিনি ফারডিন্যান্ড ডি সুস্যুরের স্ট্রাকচারালিজম, হাইডেগারের ফেনমনলজি কিংবা হুসার্লের অবভাসিক ক্রমহ্রাসমানতার তত্ত্বগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ ধারণার রসদ জোগাড় করে নিজে এই বিনির্মাণতত্ত্ব নির্মাণ করেছিলেন। মোটা দাগে বলতে গেলে, উত্তর-আধুনিকতা হচ্ছে আধুনিকতার বিরুদ্ধে এক বিশেষ অভিযাত্রা। বলতে হবে, একটা তীব্র প্রতিক্রিয়া।
Advertisement
দেরিদাকে ঠিক দার্শনিক বলতে হবে এটা অনেকেই মেনে নিতে দ্বিধা করেছেন। তবে তাঁর মৃত্যুর পর ২০০৪ সালে “জ্যাক দেরিদা, দুর্বোধ্য তাত্ত্বিক, মারা গেলেন ৭৪ বছরে” শিরোনামে জোনাথন ক্যান্ডেল নিউইয়র্ক টাইমস-এ লিখেছেন, “Mr. Derrida was known as the father of deconstruction, the method of inquiry that asserted that all writing was full of confusion and contradiction, and that the author's intent could not overcome the inherent contradictions of language itself, robbing texts—whether literature, history or philosophy—of truthfulness, absolute meaning and permanence. The concept was eventually applied to the whole gamut of arts and social sciences, including linguistics, anthropology, political science, even architecture”. এক সময়ে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু অধ্যাপক দেরিদাকে সম্মানসূচক ডিগ্রি প্রদানের বিরোধিতা করেছিল। তাঁরাই দেরিদার মৃত্যুর পর তাঁকে দার্শনিক উপাধি দেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধা করেননি। যা-ই হোক, নিউইয়র্ক টাইমস তাঁর সম্পর্কে মূল কথাটা বলে দিয়েছে, তিনি ছিলেন বিনির্মাণবাদের জনক। যদিও মারটিন হাইডেগার প্রথমে এ ধরনের এক দার্শনিক অভিযাত্রার সূত্রপাত ঘটান তবুও দেরিদাকেই বিনির্মাণবাদের জনক বলা হয়ে থাকে। অনেকেই মনে করেন, দেরিদা আধুনিকতা বিরুদ্ধে উত্তর-আধুনিকতার বীজ বপন করেছিলেন। কাজেই উত্তর-আধুনিকতার মূলসূত্র অনুসন্ধানের ভেতরেই দেরিদার নাড়ির খবর পাওয়া যাবে।
আধুনিকতা নিয়ে আমাদের যে ধারণা সেটা বেশ পাকাপোক্ত। শিল্প, সাহিত্য, দর্শন, সমাজবৈজ্ঞানিক ধ্যান ধারণা, ইতিহাস, নৃবিজ্ঞান, কিংবা মানববিদ্যা সংক্রান্ত চিন্তাধারার একটা কাঠামোভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে আধুনিকতা। কাঠামোভিত্তিক শব্দের অর্থ হচ্ছে ভাষা, সাহিত্য এবং সমাজ সংক্রান্ত নানাবিধ বিপরীত বিষয়গুলো একটা সামগ্রিক কাঠামোর সাথে কীভাবে মিলিত হয়, তার একটা গ্র্যান্ড নেরেশন। উনিশ-বিশ শতকের অতি ব্যাপক শিল্পোন্নয়ন মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের ওপর দারুণ প্রভাব ফেলে। এর ফলে তৈরি হয় সম্পর্কের নতুন বাতাবরণ যার প্রভাব গিয়ে পড়ে দর্শনের ওপর, পড়ে সাহিত্য ও শিল্পকলার বিচিত্র অনুষঙ্গের কুলে। আধুনিকতা জ্ঞানের সামগ্রিকতার ওপর জোর দেয়, জোর দেয় অন্তর্নিহিত সরলমুখীনতাকে। যেমন ধরুন, আপনি গত এক সপ্তাহে পৃথিবীর সাতটা বড় বড় শহরে ভ্রমণ করলেন। যেখানেই যাচ্ছেন, সেখানেই একই ধরনের বিমান, বিমানবালাগুলোর আচরণ পোশাক-আশাক একই রকম, যে পথ দিয়ে হোটেলে যাচ্ছেন সেগুলোতে একই রকম রাস্তার বিলবোর্ড, হোটেলেগুলোও একই রকম, খাবার-দাবার, হোটেল বয়দের আচরণ-ব্যবহার একই রকম। ইত্যাদি। সাতটা ভিন্ন ভিন্ন শহর ঘোরার পরেও আপনার মনে হবে আপনি একই শহরে আছেন! আধুনিকতা একটা হোমোজিনিয়াস ফেক্টর। প্রাচীন চিন্তার মতো স্থবির নয় কিন্তু বড্ড একমুখীন। বৈচিত্র্যময়তা এখানে অনুপস্থিত। বহু ক্ষমতা বা বহু সংস্কৃতির অন্তবোধ আধুনিকতার প্রাণশক্তি। পুঁজিবাদী বোধায়নে বিশ্বায়নের যে তকমা লাগানা হয়েছে তা এই আধুনিকতারই উপজাত। প্রকারন্তে এই ধরনের এক গতিময় সরলমুখীন সমসত্বকে আপনার বোধের কাঠামোর মাঝে নিয়ে আসে। খুব সরল কথায়, আধুনিকতা গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে বিশেষ করে প্রথাসিদ্ধ জীবনাচারের বিপরীতে অভিজ্ঞতাসিদ্ধ জীবনবোধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীতে মানুষের চিন্তার ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। তথাকথিত শূন্য মূল্যবোধের দেওয়ালে দেখা দেয় ফাটল। ১৯২২ সালে লেখা টি এস এলিওয়েটের দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড সম্ভবত আধুনিকতার একটা আকর সম্পদ। ৪৩৪ লাইনের এই অতি দীর্ঘ কবিতার ভেতর দিয়ে উঠে এসেছে যুদ্ধ পরবর্তী ভাঙনের শব্দ। তাছাড়া সাহিত্যের অন্যান্য জায়গায়ও আধুনিকতা দারুণভাবে প্রবেশ করেছে। কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে ভাবনার সেই কাঠামোও একসময় ফিকে হয়ে আসে। শুরু হয় নতুন পর্ব পোস্ট- মর্ডানিজম বা উত্তর-আধুনিকতা।
উত্তর-আধুনিক দর্শনে চিন্তার মুক্তি ঘটেছে। সবাই বলে উঠেছে, “আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে/ আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে”। নৈর্ব্যক্তিকতার চাদরে যা এতদিন মোড়ানো ছিল তার খোলস থেকে সবাই বেরিয়ে এসে ছুটে চলল অজানার পথে। একমুখী সরল আর সমসত্ব চিন্তা থেকে বের হয়ে মানুষ বিষমসত্তার দিকে শুরু করল নিঃসঙ্গ ও নিভৃত যাত্রা। এখানেই শুরু হলো দেরিদার নতুন দর্শনের ফলক উন্মোচন।
দেরিদার বিনির্মাণ পশ্চিমা দর্শনকে তার কেন্দ্র থেকে টেনে এনে বাস্তুচ্যুত করেছে। তবে এই ভাঙার উদ্দেশ্য কিন্তু গড়া। ভেঙে নতুন করে বানানোঃ “তোমায় নতুন করে পাবো বলে হারায় ক্ষণে ক্ষণ ও মোর ভালোবাসার ধন”। ছোট্ট শিশুরা হাতের কাছে কোন রেডিও, ট্রানজিস্টার, মোবাইল ফোন পেলে যেমনই প্রথমেই ভেঙে ফেলে তারপর এক এক করে জোড়া দিতে চায়, ঠিক তেমনই দেরিদার ভেঙে ফেলার উদ্দেশ্য নতুন করে তৈরি করা। এটাই বিনির্মাণ। সত্যি বলতে কী, আমরা প্রতি মুহূর্ত ভাঙছি, বানাচ্ছি এক নতুন ভাবনার সৌধ। মারটিন হাইডেগার তাঁর বেসিক প্রব্লেমস অব ফেনমেনলজি বইতে তাঁর শিক্ষক হুসার্ল-এর প্রপঞ্চবাদের বা ফেনমেনলজির ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনটি ধাপকে মাথায় রেখে।
Advertisement
ক্রমহ্রাসমানতা, রূপান্তরিতকরণ, ধ্বংসসাধন। এরা একে অন্যের সাথে খুব নিবিড় ভাবে যুক্ত। দেরিদা হাইডেগারের মতো মনে করতেন পৃথিবীর যাবতীয় জটিল ও দুর্বোধ্য বিষয়াদিকে বুঝতে দরকার প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গিমার পুনঃসংযোজন। একটা নতুন পাঠে তাদের বিন্যস্ত করা। অর্থাৎ একটা টেক্সটচ্যুয়াল প্রেক্ষাপট বানানো।
ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বলা যাক। যেমন ধরুন আপনি বহু আগে বিভূতি বাবুর পথের পাঁচালী পড়েছেন। আপনার একটা মনের ভেতর নির্মাণ বা টেক্সট দানা বেঁধেছে। অপু, দুর্গা, ইন্দিরা ঠাকুর, সর্বজয়া, হরিহর আর নিশ্চিন্দিপুর গ্রাম আপনার মনের ভেতর ভীষণ এক দাগ কেটেছিল। আপনি মনের অজান্তে মনের ভেতর একটা চিত্র রচনা করেছিলেন। ত্রিশ বছর পর সেই আপনিই আবার পড়লেন কিংবা সত্যজিৎ রায়ের ছবিটা দেখলেন। কী মনে হবে? মনের ওপর আগের সেই ছাপ ফেলা ভাবচিত্র বদলে নতুন এক চিত্র তৈরি হবে। এই নতুন চিত্রই এক একটা টেক্সট। অর্থাৎ প্রতিটা পাঠেই জন্ম নেয় এক একটা টেক্সট। একটা শব্দ দিয়ে একটা বস্তু বা বিষয়কে নির্ধারণের পুরোনো ও প্রচলিত অভ্যাস এখানে এসে বাতিল হয়ে গেল। কালের চলমানতায় শব্দগুলো নতুন নতুন রূপ পরিগ্রহ করে। এজন্য দেরিদা লগো সেন্ট্রিজম বা বাণী কেন্দ্রিকতা ও উপস্থিতির অধিবিদ্যাকে নাকচ করে দিয়েছেন। আর এর ফলে গড়ে উঠেছে টেক্সটের অবিরত চলমান অ-কেন্দ্রিভূত ও বিচ্ছুরিত দৃশ্যপট। তাহলে শব্দমালার পবিত্র জায়গা থাকলো কোথায়? রোলা বার্থের দ্য ডেইথ অব দ্য অথরের কথা মনে পড়ছে। ১৯৬৭ সালে লেখা দুর্দান্ত এই প্রবন্ধে বার্থ দেখিয়েছেন, প্রতিটা টেক্সট নির্মাণের সাথে সাথে লেখকের মৃত্যু হয়। প্রতিটা টেক্সট তৈরি হলে নতুন যে বোধের জন্ম হয় তার ফলে লেখকের হাতে অর্থের আর কোন কর্তৃত্ব থাকে না। চলে যায় পাঠকের কাছে। পাঠক তার রুচি, প্রয়োজন, সংস্কৃতি অনুযায়ী নতুন করে বুঝে নেন। যেমন ধরুন আপনি একটা কবিতা লিখলেন। কবিতা ফেসবুকে পোস্ট করার পর যত মানুষ কমেন্ট করেছে তাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ উপলব্ধি থেকে ভালো লাগার কথা জানিয়েছে। কবিতার লেখক কী উদ্দেশ্য নিয়ে লিখেছেন আর পাঠক কী বুঝেছে কিংবা তার কী কারণে ভালো লেগেছে—এই দুয়ের মাঝে একটা ফারাক আছে বৈ কি! তার মানে অথোর আর রিডারের মাঝে অবধারিত ভাবে নতুন এক বিষয়ের আবির্ভাব ঘটেছে এবং সেটা হলো টেক্সট। তাই সমীকরণটা দাঁড়াল এরকমঃ অথোর–টেক্সট—রিডার। এর অর্থ হলো অধুনিকতাতে যেমন অথরের নিরঙ্কুশ জয় জয়াকার ছিল, উত্তর-আধুনিকতায় এসে সেই একচ্ছত্র আধিপত্যের ঘটল অবসান।
পপারের সাথে তাহলে দেরিদার ওভারলেপিংটা কোথায়? পপারের ভাবনার একটা বিরাট অংশজুড়ে বিজ্ঞানের দর্শনের আলোচনার বাইরেও আছে সমাজ, রাজনীতি ও ইতিহাসতত্ত্বের বিশ্লেষণী চিন্তা। একটা মুক্ত সমাজ ব্যবস্থার প্রধান শত্রুকে তিনি চিহ্নিত করেছেন, তাঁর “ওপেন সোসাইটি অ্যান্ড ইটস এনিমি” গ্রন্থে। মোটকথা তিনি ছিলেন যে কোন কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের একটা মাইলফলক। পপার বিজ্ঞানের নির্মিত সৌধের ওপর একটা বিরাট জিজ্ঞাসার দাগ লেপন করে দিয়েছে। তিনি মনে করেন, বিজ্ঞান আমাদের কোন জ্ঞানই দিতে পারে না; যা দেয় তা কঞ্জেকচার মাত্র। অর্থাৎ বিজ্ঞান আমাদের যে জ্ঞান দেয় তা অবশ্যই চূড়ান্ত ভাবে পরোখযোগ্য নয় বরং তা খণ্ডনযোগ্য। যেমন ধরুন, আমি একটা বৈজ্ঞানিক সত্য “সকল রাজহাঁস সাদা” (পপার নিজেই এই উদাহারণ দিয়েছেন)-কে সন্দেহাতীতভাবে গ্রহণ করলাম। কিন্তু অনুপুঙ্খ তদন্তে দেখা গেলো একটা কাল রাজহাঁস আফ্রিকার কোন লেকে পাওয়া গেল। সে ক্ষেত্রে সব রাজহাঁস সাদা প্রত্যয়টা অবলীলায় মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গেল, নয় কি? ঠিক সেরকম ভাবে বিজ্ঞানের লম্বা ইতিহাসে অনেক বৈজ্ঞানিক সত্য কালের ভেলায় ভেসে মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গেছে। তাহলে বিজ্ঞান যে ইন্ডাক্টিভ রিজনিংয়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সেটা এক পর্যায়ে হোচট খেলো। এই হোচট খাওয়ার কারণে পপার ইন্ডাক্টিভের স্থলে ডিডাক্টিভ মেথডের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
পপার ক্লাসিক্যাল রেশনালিজমের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন; অনুরূপভাবে পোস্ট-মডার্নিজমে তথাকথিত লোগোসেন্ট্রিজমের বিরুদ্ধে করেছে বিদ্রোহ। ক্লাসিক্যাল রেশনালিজম ও লোগোসেন্ট্রিজম দুটোই জ্ঞানের একটা মজবুত ভিত খোঁজ করেছে। কিন্তু পপার এবং উত্তর-আধুনিকেরা তথাকথিত রিজন বা বুদ্ধির একচ্ছত্র আধিপত্যকে নস্যাত করে সে জায়গায় বসিয়েছে ট্রায়াল এবং এররের মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানকে। গ্রিক দর্শন থেকে শুরু করে বর্তমান অবধি বুদ্ধিবাদীদের একচেটিয়া অন্ধবিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে প্রচার করেছেন বিচারমূলক বুদ্ধিবাদ। ঠিক সেরকম ভাবে দেরিদা ধারণার আবশ্যিকতাকে বানচাল করে দিয়েছেন। বিষয়টা একটু পরিষ্কার করি। যেমন লোহার গোলক এই আলাদা শব্দ দুটো একত্রিত হয়েছে কোন আবশ্যিকতা ছাড়া। কারণ যদি লোহা শব্দটি গোলক ছাড়াও অর্থপূর্ণ; লোহা গোলক ছাড়াও অন্যকিছু হতে পারে। লম্বা, চ্যাপ্টা, বক্রাকার ইত্যাদি। আবার গোলক মানেই যে সেটা লোহার হবে এমন কথা নেই। নানান কিছু গোলক হতে পারে। কাজেই লোহার গোলক কথাটা যেমন একে অন্যের সাথে সম্পর্কিত ততটাই আবার বিচ্যুত, ততটাই মূলত বিকৃত। দেরিদা এই এটা বোঝাতে নতুন একটা শব্দ যুক্ত করেছেন সেটা হল, Difference বা Differ. ফরাসি ভাষাতাত্ত্বিক ফার্দিন্যাড সসুরের কাছ থেকে পাওয়া একটা কথা খুব গুরুত্বপূর্ণ। লাল বলতে চূড়ান্ত কোন অর্থ নেই আমাদের কাছে। লাল হচ্ছে যা লাল নয় তার সাথে এর পার্থক্য। সবুজ হচ্ছে যা সবুজ নয় তার থেকে আলাদা। ঠিক সেরকমভাবে ‘সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে’র মতো পুতপবিত্র কথার কোন মানে নেই। কারণ পূর্ব বা পশ্চিম দিক শাশ্বত না। মহাকাশে পূর্ব বা পশ্চিম বলে কিছু নেই। যাই হোক, মোটকথা অপরিবর্তনীয় সত্য বলে কিছু নেই। দেরিদা এই অলঙ্ঘনীয় সত্যকে প্রচার করেছেন। পপার সুনিশ্চিতভাবে এই কথাটাই বলতে চেয়েছেন। দ্য লজিক অব সাইয়েন্টিফিক থিওরিতে পপার বিজ্ঞানের অলঙ্ঘনীয় সত্যের ধারণা পুরোপুরি নাকচ করে দিয়েছেন।
দেরিদা কি তাহলে বিজ্ঞানের কোন সত্যকেও টেক্সট বলার পক্ষপাতী? হিউম্যান সায়েন্স যার কেন্দ্রবিন্দু নৃবিজ্ঞান তাকে দেরিদা টেক্সট থেকে তো বাদ দেননি। আসলে “কোন টেক্সটকে পড়া পরবর্তী টেক্সট পড়ার মুখবন্ধ বিশেষ”- বিনির্মাণের এই মূল সত্য মানবিক বিজ্ঞান থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সব ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। পপার বিজ্ঞানের সত্যকে একটা কিছু সময়ের জন্য গ্রহণ করেছেন এড-হক হিসেবে। কাজেই দুজনের চিন্তার সমকেন্দ্রিকতা কারো কাছে বুঝতে অসুবিধে হবার নয়।
এসইউ/জেআইএম