একুশে বইমেলা

বইমেলা ঘিরে সোহরাওয়ার্দীতে জমজমাট কাঠ-রঙের ব্যবসা

নেকবর বিশ্বাসের বয়স ৬০ ছুঁই ছুঁই। পেশায় কাঠ ব্যবসায়ী। বাড়ি রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দিতে। সেখানে রয়েছে তার নিজস্ব স’মিল ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। একুশে বইমেলার তারিখ ঘনিয়ে এলেই তিনি ছুটে আসেন ঢাকায়। মেলা প্রাঙ্গণে গড়ে তোলেন কাঠের অস্থায়ী দোকান। এবারও বইমেলা ঘিরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নানান মাপের কাঠের পসরা সাজিয়ে বসেছেন নেকবর। পাশেই তার কুঁড়েঘর। সেখানেই কাটছে দিনরাত।

Advertisement

মেলার স্টলে কাজ করা কর্মীদের অধিকাংশই নেকবরের চেনাজানা। দোকানের সামনে দিয়ে যেতে যেতে অনেকে হাঁকডাক ছেড়ে জিজ্ঞেস করছেন—‘চাচা, ব্যবসা কেমন’? হাসিমুখে উত্তর দিচ্ছেন নেকবর বিশ্বাস। এগিয়ে গিয়ে একই সুরে তাকে ‘ব্যবসা কেমন’ প্রশ্ন করতেই সেই একই মুচকি হাসি আর হ্যাঁ সূচক জবাব।

নেকবর বিশ্বাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘২৮ বছর তো হয়ে গেলো। এখানেই ব্যবসা করছি। ১৯৯৬ সালে দেশ (গ্রামের বাড়ি) থেকে প্রথম কাঠ লইয়া বইমেলায় ব্যবসা করতে আইছিলাম। মাঝে করোনাভাইরাসের কারণে দু-এক বছর আসিনি। গত বছরও আইছিলাম এবারও আসলাম। ২৪ জানুয়ারি আইছি। আল্লাহর রহমত-বরকতে ব্যবসা এবার ভালো।’

দিনে কেমন বেচাকেনা করছেন—জানতে চাইলে উচ্চস্বরে হেসে ওঠেন তিনি। এরপর বলতে শুরু করেন, ‘টাকার অংক কইলে অনেকে আবার বদনজর দেবে। তাতে আমার যায়-আসে না। দিনে লাখ টাকাও হয়। একটু বেশিও হয়। গড়পড়তা হিসাব করলে দিনে লাখ টাকার বেচাবিক্রি করছি এবার।’

Advertisement

বইমেলায় নেকবর বিশ্বাসের প্রতিযোগী এবার আরও পাঁচজন। তারাও কাঠের ব্যবসা করছেন। সবার দোকানেই প্রায় একই মাপের কাঠ। সঙ্গে রয়েছে চৌকি, ফ্রেম, কাঠের বানানো বই রাখার তাকও। মাপ অনুযায়ী দামেরও হেরফের। ৮ ফুট বাই ৫ ফুট মাপের আম কাঠের চৌকির দাম সাড়ে তিন হাজার টাকা। এরচেয়ে একটু বড় হলে তা চার হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া চাওড়া, চিকনসহ বিভিন্ন মাপের কাঠ বিক্রি হচ্ছে সেফটি হিসেবে। কাঠগুলোর বেশিরভাগই আম ও চাম্বল গাছের। কাঠের মান ও আকার বুঝে হাঁকা হচ্ছে দর-দাম।

আরও পড়ুন>> বইমেলার মাঠে সেজে উঠছে স্টল-প্যাভিলিয়ন

নেকবর বিশ্বাসের দোকানের ঠিক উল্টো পাশে দোকান বাসিয়েছেন বইমেলার আরেক পুরোনো কাঠ ব্যবসায়ী মো. হারুন। তার দাবি, নেকবর বিশ্বাসের আগে থেকেই তিনি বইমেলার স্টল সাজানোর কাঠ বিক্রির ব্যবসা করে আসছেন। গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী হলেও দীর্ঘদিন মধ্যবাড্ডা পোস্ট অফিস গলিতে থাকেন। সেখানে তার স্থায়ী দোকানও রয়েছে।

জানতে চাইলে হারুন জাগো নিউজকে বলেন, ‘নেকবর ভাই আসার দু-এক বছর আগে থেকেই আমি ব্যবসা করছি। তখন কাঠের দাম অনেক কম ছিল। দেখতে দেখতে তো সব জিনিসের দাম বেড়ে গেলো। কাঠের দামটাও এখন একটু বেশি। অনেকে কিনতে এসে দরকষাকষি করছেন। পরিচিতদের অল্প লাভ রেখে দিয়ে দিচ্ছি।’

Advertisement

নেকবর বিশ্বাসের আয় তো ভালো। পুরোনো কাঠ ব্যবসায়ী হারুনের আয় কেমন? এমন প্রশ্নের উত্তরে হারুনের ভাষ্য, ‘সত্যি বলতে লাখ টাকার বিক্রি হচ্ছে। কাঠের দাম, ফাড়াই খরচ, কর্মচারীর প্রতিদিনের মজুরি বাদ দিলে ভালোই লাভ থাকে। ব্যবসা তো হয় মাত্র এক-দেড় সপ্তাহ। ১৮ জানুয়ারি আসছি। ১ তারিখ পর্যন্ত থাকবো। ১২-১৩ দিনে ১৫ লাখ টাকার বিক্রি হলেই হয়।’

বইমেলা ঘিরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কাঠের ব্যবসা গড়ে তোলা অন্যদের মধ্যে পাওয়া গেলো যশোরের সালাম মেম্বার, সিরাজগঞ্জের লিয়াকত মেম্বার, লক্ষ্মীপুরের শামীম হোসেন ও কুষ্টিয়ার জগতির আফজাল মিয়াকে। তাদের ভাষ্যও একই রকম। জানালেন, দিনে লাখ টাকার কাছাকাছি বেচাবিক্রির তথ্যও ঠিক। তবে আগের চেয়ে লাভ কমেছে।

মেলা প্রাঙ্গণে কাঠের দাম বেশি

বইমেলা ঘিরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যারা কাঠ বিক্রি করছেন, তারা বাইরের চেয়ে দ্বিগুণ দাম নিচ্ছেন বলে অভিযোগ অনেক প্রকাশক ও স্টল তৈরির কাজ করা কর্মীদের।

তাদের অভিযোগ, যে পাঁচ-ছয়জন এখানে ব্যবসা করছেন, সবার দামই এক। ফলে দর-দাম করে কম-বেশি দামে কেনার সুযোগ নেই। তারা সিন্ডিকেট করে এভাবে কাঠের বাড়তি দাম নিচ্ছেন। তবে এখান থেকে বাকিতে কাঠ পাওয়া যাচ্ছে, এটা একটা বড় সুবিধা বলেও জানান তারা।

সময় প্রকাশনের স্টল তৈরির কাজ করা শ্রমিক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এরা দাম বেশি নিচ্ছেন। টানাটানি করে আনা কষ্টসাধ্য বলে অনেকে এখান থেকে কিনে কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন। আবার বাইরে থেকে কিনে গাড়ি ভাড়া দিয়ে আনাও ঝামেলা।’

আরও পড়ুন>> ১ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে বইমেলার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী

প্রিয় মুখ প্রকাশনীর স্টল তৈরির দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মী নাম প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘দামটা এখানে বেশি হলেও বেশকিছু সুবিধা রয়েছে। বাকিতে কাঠ নেওয়া যাচ্ছে। কম পড়লে দ্রুত সেখান থেকে এনে কাজ সারাও সহজ। সেজন্য বেশিরভাগ প্রকাশকই এখান থেকেই কাঠ নিচ্ছেন।’

হার্ডওয়্যার-ইলেকট্রনিক পণ্যের ব্যবসাও জমজমাট

বাঁশ-কাঠের মতো রং এবং বাল্ব, তারসহ বৈদ্যুতিক সামগ্রীর বেচাকেনাও ভালো বইমেলা প্রাঙ্গণে। মেলার বেশিরভাগ স্টলই কাঠামো পেয়েছে। এখন চলছে রঙের কাজ। ফলে রঙের দোকানে ভিড় লেগে থাকতে দেখা গেছে।

উদ্যান ঘুরে রঙের চারটি দোকান চোখে পড়ে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পণ্যসামগ্রী দেখা গেলো হাবিব ইলেকট্রিক অ্যান্ড হার্ডওয়্যারে। রোববার (২৮ জানুয়ারি) বিকেলে বেচাবিক্রির চাপে কথার বলার ফুসরত মিলছিল না দোকানমালিক হাবিবের। এক ফাঁকে তিনি জাগো নিউজকে জানান, আগে এখানে তার বাবা ব্যবসা করতেন। বাবা অসুস্থ হওয়ায় এবার তিনিই সব সামলাচ্ছেন। বিক্রি বেশ ভালো। দুজন কর্মী রেখেও সামলাতে হিমশিম।

হাবিব বলেন, ‘দোকানে দুজনকে রাখছি। আজকে চাপটা বেশি। আগামী দুই-তিনদিন আরও চাপ বাড়বে। সবাই এখন রঙের কাজে হাত দিচ্ছে তো। এখন পর্যন্ত ব্যবসা ভালো। বাকি কয়দিন আরও ভালো হবে বলে আশা করছি।’

প্রতি বছরের মতো এবারও ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনে মাসব্যাপী ঐতিহাসিক ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২৪’ শুরু হবে। এদিন বিকেল ৩টায় মেলার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

অমর একুশে গ্রন্থমেলা কমিটির সদস্যসচিব ড. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম জানান, এবার মেলায় ৫৭৩ প্রতিষ্ঠানকে ৮৯৫টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৭৮৬টি সাধারণ স্টল। আর ১০৯টি স্টল লিটল ম্যাগাজিন চত্বরকে দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া এ বছর মোট ৩৭টি প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ করা হয়েছে।

গত বছর অর্থাৎ, ২০২৩ সালে ৬০১টি প্রতিষ্ঠানকে ৯০১টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। সেই হিসাবে এবার ছয়টি স্টল কমছে। অন্যদিকে মেলা ঘিরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মাসব্যাপী সেমিনারের পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের জন্য ছবি আঁকা, সংগীত ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা থাকবে। শিশুপ্রহরে থাকবে সিসিমপুর।

এএএইচ/ইএ/জিকেএস