জাতীয়

‘বুঝতে হবে ট্রান্সজেন্ডার আর হিজড়া এক নয়’

জব্বার হোসেন। কলামিস্ট ও গবেষক। সাংবাদিকতার পাশাপাশি জেন্ডার নিয়ে কাজ করছেন দীর্ঘদিন। কাজ করেছেন মানুষের যৌন আচরণ ও যৌন মনস্তত্ত্ব নিয়ে চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীদের সঙ্গে এসএমসির টেলি জিজ্ঞাসা ডেস্কে। হিজড়াদের নিয়ে তার গবেষণাপত্রও রয়েছে। সপ্তম শ্রেণির বইয়ে ‘শরীফ থেকে শরীফা’ গল্প নিয়ে কথা হয় জাগো নিউজের।

Advertisement

তিনি বলেন, ‘কোনো বিষয়ে ভালোভাবে না জেনে ঢালাও মন্তব্য করা কারও জন্য ঠিক নয়। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ মাহতাবের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, তিনি ট্রান্সজেন্ডার, হিজড়া, সমকামিতা- সব এক করে ফেলেছেন। এখানে প্রতিটি শব্দ ও অর্থ আলাদা। আপনাকে বুঝতে হবে জেন্ডারের জায়গা থেকে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের জায়গা থেকে।’

‘যে ট্রান্সজেন্ডার সে হিজড়া নাও হতে পারে। ট্রান্সজেন্ডার হলো যে তার জেন্ডার পরিবর্তন করেছে বা করতে চায়। সেটা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। কারও শরীরে যদি হরমোনাল পরিবর্তন ঘটে তখন সে নিজে না চাইলেও নারী বা পুরুষে রূপান্তরিত হবে। এমন অনেক ঘটনা আগে ঘটেছে। কখনো কখনো এটি ব্যক্তির নিজস্ব চাওয়া-পাওয়ার বিষয় নয়। সৃষ্টিকর্তা একেক মানুষকে একেকভাবে তৈরি করেছেন। আর তৃতীয় লিঙ্গ হলো জন্মগতভাবে যার লৈঙ্গিক পরিচয়টি নারী বা পুরুষ হিসেবে নির্ণয় করা যায় না। এটি একেবারেই আলাদা। আর সমকামিতা হলো নারী বা পুরুষের যৌন আচরণ। ফলে এখানে একটি ভুল ব্যাখ্যা তৈরি হচ্ছে।’

আরও পড়ুন>> পরীক্ষামূলক বই পড়ছে শিক্ষার্থীরা, উপযোগিতা যাচাই অক্টোবরে

Advertisement

জাতীয় শিক্ষক ফোরামের অনুষ্ঠানে মাহতাব যে বক্তৃতা দিয়েছেন সেখানে অনেকগুলো তথ্য রয়েছে, যা ভুল ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে মন্তব্য করে জব্বার হোসেন বলেন, ‘ট্রান্সজেন্ডার অনেক রকম হয়। ট্রান্সমেন, ট্রান্সওমেন। কেউ নিজেকে মেয়ে মনে করলেই মেয়ে হয়ে গেলো বা কেউ নিজেকে ছেলে মনে করলেই ছেলে হয়ে গেলো বিষয়টি এমন নয়। এখানে জেন্ডার ট্রান্সফারের বিষয় রয়েছে। ছেলে সাজা বা মেয়ে সাজার বিষয়টি এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। কারও মেয়েলি আচরণ বা পুরুষালি আচরণ দিয়ে তাকে মেয়ে বা ছেলে বলা যাবে না। তার হরমোনাল কন্ডিশন, বায়োলজিক্যাল কন্ডিশন এ বিষয়গুলোও মাথায় রাখতে হবে। ইচ্ছাকৃতভাবে মেয়েলি আচরণ করে পরবর্তীসময়ে মেয়েদের ধর্ষণ করতে যাওয়া- যে বিষয়টি তিনি বলেছেন, সেটি এক ধরনের সাইকো সেক্স্যুয়াল ডিজঅর্ডার। এটা পারভার্সনের পার্ট। তিনি বিস্তারিত না জেনে সব এক করে ফেলেছেন। ভাসা ভাসা বা সারফেস লেবেল থেকে জেনে কিছু বলা উচিত নয়।’

আরও পড়ুন>> নবম শ্রেণিতে নেই বিজ্ঞান-বাণিজ্য-মানবিক, সবাই পড়ছে একই বিষয়

‘জেন্ডার ট্রান্সফার করলে কেউ সমকামী হবে একথা তাকে কে বললো? বাংলাদেশে যে ছেলেরা নিজেদের মেয়ে মনে করে তাদের পক্ষে ‘নতুন আইন প্রচারিত হচ্ছে’- এ তথ্য তিনি কোথায় পেলেন? সমকামী না হলে চাকরি দেয় না যুক্তরাজ্য- এটা খুবই আপত্তিকর তথ্য। বাংলাদেশের শত শত লোক কাজ করছে যুক্তরাজ্যে। এ মন্তব্য তাদের জন্য অসম্মানজনক। আমেরিকায় প্রতি দুজনের একজন সমকামী- এ তথ্যও তিনি কোথায় পেলেন। কোন গবেষণা প্রতিষ্ঠান তাকে এ তথ্য দিয়েছে? তিনি নিজে কি কোনো গবেষণা করেছেন? করে থাকলে এ গবেষণার ভিত্তি কি? ভুল তথ্য সমাজের জন্য ক্ষতিকর- এটা মনে রাখতে হবে।’

তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া সম্প্রদায় সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ হিজড়া হয় না। এটা তার জন্মগত পরিস্থিতি। বুঝতে হবে ট্রান্সজেন্ডার আর হিজড়া এক নয়। হিজড়াদের নিজস্ব ভাষা, রীতি, সংস্কৃতি-জীবনাচরণ রয়েছে। তারা সমাজে ব্র্যাত্য। সামাজিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত কিন্তু কর্মক্ষম মানুষ। সামাজিক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মানুষ তাদের কাজে নিতে চায় না। আসিফ মাহতাবের ভুল ব্যাখ্যা হিজড়াদের কাজ পেতে আরও অসুবিধা সৃষ্টি করবে। হিজড়াদের কাজে নেওয়া হয় না বলেই তারা রাস্তাঘাটে চাঁদা তুলে বেড়ায়।’

Advertisement

‘সুযোগ পেলে অনেক হিজড়া অনেকের চেয়ে ভালো কাজ করতে পারে। ডিএমপির বর্তমান পুলিশ কমিশনার মো. হাবিবুর রহমান হিজড়াদের নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছেন। ভদ্রলোককে আমি ধন্যবাদ জানাই। সুযোগ পেলে হিজড়ারা যে ভালো কাজ করতে পারে সেটা তার বড় প্রমাণ। তাহলে আমরা কেন অমূলক বিতর্কের কারণে হিজড়াদের পিছিয়ে দেবো। কোনো হিজড়া কাজ হারালে পরদিন তাকে আমরা কে খাওয়াবো?’

আরও পড়ুন>> নতুন শিক্ষাক্রমে মাদরাসার বই রূপান্তরে ‘জুজুর ভয়’

জনসম্মুখে একজন শিক্ষকের বইয়ের পাতা ছেঁড়া ও চাকরিচ্যুতি সম্পর্কে জব্বার হোসেন বলেন, ‘তিনি যেভাবে বইয়ের পাতা ছিঁড়েছেন সেটি অশোভন। তিনি লেখা বা গল্পটির সঙ্গে একমত না হতেই পারেন। পছন্দ না হতেই পারেন। তিনি নানাভাবে প্রতিবাদ করতে পারতেন। নিজে একটি লেখা লিখতে পারতেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার আপত্তি বা অসম্মতি জানাতে পারতেন। কিন্তু সেটি না করে প্রকাশ্যে বইয়ের পাতা ছেঁড়া এবং অন্যদের ছিঁড়তে উৎসাহিত করা দুঃখজনক।’

‘আর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তিনি কীভাবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন, ব্র্যাকের নিজস্ব চাকরি বিধিমালা কী বা কেমন তা শুধু ব্র্যাক এবং আসিফ মাহতাবই জানেন। যতদূর জানি তিনি খণ্ডখালীন শিক্ষক। তাকে চাকরিচ্যুত করা একেবারেই ব্র্যাকের নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত। এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে নিয়ে যে নানা ধরনের ট্রল হচ্ছে যেমন পানীয়ের গ্লাস, মেয়েদের সঙ্গে ছবি দিয়ে তার চরিত্রহননের চেষ্টা- সেটিও গ্রহণযোগ্য নয়।’

‘শরীফ থেকে শরীফা’ গল্পের উপস্থাপন নিয়ে তার মন্তব্য, ‘গল্পটি যে আবেদন তৈরি করার কথা তা হয়তো করতে পারেনি। সেটি লেখকের দুর্বলতা। এখানে আরও হয়তো ব্যাখ্যার দাবি রাখে। জেন্ডারের বিষয়গুলো আরও বিস্তারিত থাকলে ভালো হতো। তবে গল্পটির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নারী বা পুরুষ ছাড়াও অন্য লিঙ্গ বা হিজড়াদের প্রতি শিক্ষার্থীদের সহমর্মী করে তোলা। সেদিক থেকে আমি গল্পটিতে কোনো বড় ধরনের ঝামেলা দেখি না। এ গল্পের কোথাও সমকামিতার কথা নেই, কোনো বর্ণ, শব্দ, বাক্যও নেই। আসিফ মাহতাব ‘শরীফ থেকে শরীফার’ গল্পে কেন সমকামিতা টেনে আনছেন তা আমার বোধগম্য নয়।’

এএসএস/এএসএ/জেআইএম