পাঠক্রম নিয়ে বিতর্ক চলছে আজ প্রায় ৮০ বছর। বঙ্গবন্ধুর সরকার ব্যতীত আর কোনো সরকার শিক্ষা সংক্রান্ত নীতি বা পাঠক্রম দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। উপমহাদেশে, ভারতে এই বিতর্ক এখন চরমে। যেসব দেশে গণতন্ত্র স্থিতিশীলতা পেয়েছে এবং দৃষ্টিভঙ্গি মোটামুটি সেক্যুলার সেসব দেশে পাঠক্রম নিয়ে বিতর্ক হ্রাস পেয়েছে। যুগোপযোগী পাঠক্রম তৈরির জন্য সেখানে আলাদা সংস্থা আছে।
Advertisement
ধর্মকে যখন পাঠক্রমের কেন্দ্রে আনা হয় তখনই সংঘাত, বিরোধ, বিতর্ক শুরু হয়। ভারতে বিজেপি এসে পাঠক্রম হিন্দুত্বে আচ্ছন্ন করতে চাইলে সেক্যুলার বা মধ্যপন্থিদের সঙ্গে বিরোধ শুরু হয়েছে। কিন্তু সেখানে সেক্যুলারবাদীরা ক্রমেই পিছু হটছে, কেননা সাধারণ মানুষ হিন্দুত্বে আস্থা রাখছে।
পাকিস্তানে ইসলামীকরণ হওয়ার কারণে পাঠ্যপুস্তকে তা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ১৯৭১ সালে পরাজিত হওয়ার পর তারা ইতিহাসের বদলে পাকিস্তান স্টাডিজ চালু করেছে, যাতে ইতিহাসের সবটুকু পড়াতে না হয়। বাংলাদেশেও এখন প্রায় একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
পাঠ্যবইয়ের ইসলামীকরণ শুরু হয়েছে ১৯৪৮ থেকে। শুধু তাই নয়, ওই সময় স্কুলে নামাজ পড়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে। সরকার কিছু ব্যবস্থা প্রত্যাহার করেছে, কিছু রেখে দিয়েছে। যেহেতু সরকারে যারা ছিলেন তারা নিয়ত ধর্ম ব্যবহার করেছেন রাজনীতিতে, সেহেতু পাঠ্যপুস্তকের ধারা বদলানো সহজ হয়নি। প্রবল গণআন্দোলন ছাড়া পাঠক্রম বদলানো যায় না।
Advertisement
বঙ্গবন্ধু তাই ক্ষমতায় এসে ‘কুদরত-ই-খুদা’ শিক্ষা কমিশন করতে পেরেছিলেন যেখানে রাষ্ট্রীয় চারমূলনীতি যাতে প্রতিফলিত হয় পাঠক্রমে তার সুপারিশ করেছিলেন। দুঃখের বিষয় গত ৭৮ বছরে শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য ১১টি কমিশন/কমিটি হয়েছে। কোনো কমিশনের রিপোর্ট গৃহীত হয়নি। বরং, ১৯৭৪ সালে যে নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তা বাতিল করা হয়েছে। উদাহরণ;
১৯৭৮ চারনীতি বাতিল ও ধর্ম শিক্ষার ওপর গুরুত্ব১৯৮৮ ধর্ম ও নৈতিকতার ওপর গুরুত্ব১৯৯৭ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও অসাম্প্রদায়িতকতা ২০০৩ ধর্মীয় নৈতিকতা২০০৭ অসাম্প্রদায়িকতা তবে চারমূলনীতি নয়।
বঙ্গবন্ধুর পর ২৭ বছর প্রায় একটানা স্বৈরশাসক বা তাদের এজেন্ট ও ঘাতকরা ছিল ক্ষমতায়। ফলে, দুটি জেনারেশন অসাম্প্রদায়িকতার বদলে মননে স্থান দিয়েছে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্ম ব্যবসায়ী ও জঙ্গিবাদ মৌলবাদকে আদর্শ হিসেবে দৃঢ় করা হয়েছে। শেখ হাসিনা তার বিপরীতে ক্ষমতায় আছেন ২১ বছর। কিন্তু, ফলাফল প্রায় একই রকম।
অতীত আমলে হেফাজতিদের তীব্র সমালোচনায় সরকার পিছু হটেছে। তাদের দাবি মেনে নিয়েছে। পরবর্তীকালে নীরবে তাদের কিছু দাবি থেকে শুরু হয়েছে কিন্তু হেজাবিরা তাদের শক্তি (হেফাজত+ জামায়াত+ বিএনপি]) বুঝেছে। তাদের হুমকিতে সরকার বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনে বিরত থেকেছে এমনকি শীর্ষ আদালতও সামনে থেকে ভাস্কর্য অপসারণ করেছে। সরকারের এই দুর্বলতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেক্যুলার শিক্ষাধারা। হেজাবিরা শুধু ক্যান্টনমেন্টকে আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকে। সেখানে ভাস্কর্য থাকলেও তারা নিশ্চুপ।
Advertisement
শেখ হাসিনা অতিষ্ঠ হয়ে যখন জঙ্গিবাদের সঙ্গে হেজাবিদের ছাড় দেওয়া বন্ধ করলেন, তখনই শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের হস্তক্ষেপ বন্ধ হলো এবং ডা. দীপু মনি পাঠক্রম নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে পারলেন। শুধু তাই নয়, নতুন পাঠক্রম অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তক রচিত হলো। নির্বাচনের প্রাক্কালে হেজাবিদের প্রভাবে আমরা দেখলাম নতুন পাঠক্রমের বিরোধিতা শুরু হলো।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নয়নে জিডিপি যেভাবে বৃদ্ধি করেছেন তা আগে কেউ করেননি। সেই জিডিপি বৃদ্ধি পাবে ক্রমশ। এখন আমাদের দাবি শিক্ষা-সংস্কৃতির জিডিপি বৃদ্ধির প্রকল্প গ্রহণ। সেটি করার প্রথম পদক্ষেপ সরকারের পিছু না হটা এবং যুগোপযোগী কারিকুলাম প্রয়োগ করা, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে ঢেলে সাজানো।
সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে যখন সরকার স্থিতিশীল হতে যাচ্ছে তখনই আবার পাঠক্রম নিয়ে ধর্মব্যবসায়ীরা মাঠে নেমেছে। ভোটের মাঠ থেকে তাদের হটে যেতে হয়েছে। পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী ৭ম ও ৮ম সংসদ নির্বাচনে ইসলামপন্থি দলগুলোর ভোট ছিল ৪ লাখ ৬১ হাজার ও ৩ লাখ ৬৭ হাজার। এবার তা হ্রাস পেয়েছে ৬৮ হাজার ২৬৪। নতুন ইস্যু সৃষ্টির জন্য তারা পাঠক্রম আক্রমণ করেছে। ৭ম শ্রেণির ইতিহাস ও সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের একটি অনুচ্ছেদ নিয়ে তারা মাঠে নেমেছে।
কয়েকদিন আগে এই ইস্যু তোলার জন্য ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সহযোগী সংগঠন ‘জাতীয় শিক্ষক ফোরাম’ ‘কারিকুলামে নতুন পাঠ্যপুস্তক: বাস্তবতা ও ভবিষ্যত’ শীর্ষক সেমিনারে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক “আসিফ মাহতাব উৎস সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের ‘শরীফার গল্প’ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে দাবি করেন পাঠ্যবইয়ের ওই অংশ ‘রূপান্তকামী’ এবং ‘সমকামিতা’ কে উসকে দিচ্ছে, বইটির দুটি পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলে তিনি বলেন, ‘বইয়ের দোকানে যাবেন। ৮০ টাকা দিয়ে বইটি কিনে এই যে দুটি পাতা আছে, শরীফ শরীফার পাতা দুটি ছিঁড়বেন। ছেঁড়ার পরে আপনার বইটা দিয়ে বলবেন, বইটা অর্ধেক দামে বেচো। যাতে মানুষের অ্যাওয়ার হয়। এটাই হবে আমাদের প্রতিবাদ। আমার টাকা দিয়ে আমি শরীফ-শরীফার পাতা দুইটা ছিঁড়ব।”
তারপর পাতা ছিঁড়ে তিনি বেরিয়ে যান বীরদর্পে। গণতন্ত্রহীন শাসন হলে বালক শিক্ষক এমনটি করতে পারতেন কি না সন্দেহ। মুহূর্তে সোশ্যাল মিডিয়ায় তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন, যা তিনি এবং তার পৃষ্ঠপোষকরা চেয়েছিলেন তা তিনি পেয়েছেন।
অতি তরুণ এই শিক্ষকের বক্তব্য দেওয়ার ভঙ্গি দেখে একজন পুরনো শিক্ষক হিসেবে আমি বিস্মিত হয়েছি। এটি উদ্ধত আচরণ, অশিক্ষক সুলভ তো বটেই। ছাত্ররা যদি এধরনের মনোভঙ্গি লাভ করে তা বিশ্ববিদ্যালয় কোনো সমাজের জন্য শুভ নয়। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা একজন মুক্তিযোদ্ধা, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কনিষ্ঠ একজন শিক্ষকের একি অশিষ্ট আচরণ! কর্তৃপক্ষের উচিত, কীভাবে তিনি সেখানে নিয়োগ পেলেন তা খতিয়ে দেখা।
এটি যে পরিকল্পিত বোঝা যায় পরবর্তীসময়ে বিভিন্ন ঘটনা থেকে। প্রথমে ব্র্যাকের ‘ইসলামপন্থি’ ছাত্ররা (ব্র্যাকের অবস্থা যদি দেখতেন এর প্রতিষ্ঠাতা) বিরোধিতায় নেমে এবং ব্র্যাক বয়কটের আহ্বান জানায়। তাদের বক্তব্য যা শুনেছি তা ওয়াজ মহফিলে ধর্ম ব্যবসায়ীরা যা বলেন তার অনুরূপ। সামাজিক মাধ্যমে তাদের অনুসারীরা নেমে পড়েছেন। চর মোনাইর পির ঘোষণা করেছেন, শিক্ষামন্ত্রী ইসকনের, না হলে ইসকন তাকে কেন সংবর্ধনা জানায়।
নুরুল ইসলাম নাহিদ মাদরাসার এত খেদমত করেও তাদের মন পাননি। তারা জনাব নাহিদ ও ডা. দীপু মনিকে ঈঙ্গিতে অন্য দেশের হয়ে কাজ করার কথা বলেছেন। হেফাজতের দাবির মুখেও হটে যেতে হয়েছিল আগের শিক্ষা মন্ত্রীকে। এটি প্রমাণ করে ধর্মব্যবসায়ীদের তুষ্ট করতে চাইলেও তারা ভোট দেবে না আওয়ামী লীগকে।
চরমোনাইর পির আরও বলেছেন, সরকার চলে বিদেশি এক রাষ্ট্রদূতের নির্দেশে। ‘মওলানা’ আজহারীও এক্স-এ একই কথা বলেছেন। ইতিমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় মানববন্ধন শুরু হয়ে গেছে। এবং এরা সবাই ভ্রান্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ভ্রান্ত তথ্য ছড়াচ্ছেন। ইসলামে কি পির প্রথা আছে? না কি ভ্রান্ত কথা ছড়ানোর সুযোগ আছে?
বালক শিক্ষক আসিফ ভ্রান্ত ধারণা দিয়েছেন, বইয়ে যা নেই তার কথা বলেছেন। তৃতীয় লিঙ্গ আল্লাহর সৃষ্টি এবং আমাদের সংবিধান অন্তর্ভুক্তি মূলক ব্যবস্থায় গুরুত্ব দেয়। আসিফ একই সঙ্গে মিথ্যাচার, ধর্মের অপব্যবহার, অশিক্ষক সুলভ আচরণ, সংবিধান লংঘনকারী। তার উপযুক্ত শান্তি না হলে, এ ধরনের প্রবণতা বাড়তে পারে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় যদি ‘রাজনীতিহীন’ হয় তবে এধরনের রাজনীতিকে তারা কেন প্রশ্রয় দিচ্ছেন?
জঙ্গি মৌলবাদী, ধর্মব্যবসায়ীদের প্রধান প্রকল্প মনোজগতে আধিপত্য সৃষ্টি করে অসংখ্য আসিফ সৃষ্টি করা এখন লড়াইটা তাই। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার কি মনোজগতে আধিপত্য প্রয়াসের প্রকল্প গ্রহণ করবে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নয়নে জিডিপি যেভাবে বৃদ্ধি করেছেন তা আগে কেউ করেননি। সেই জিডিপি বৃদ্ধি পাবে ক্রমশ। এখন আমাদের দাবি, শিক্ষা-সংস্কৃতির জিডিপি বৃদ্ধির প্রকল্প গ্রহণ। সেটি করার প্রথম পদক্ষেপ সরকারের পিছু না হটা এবং যুগোপযোগী কারিকুলাম প্রয়োগ করা, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে ঢেলে সাজানো।
প্রতি বছর তারা কোনো না কোনো কেলেঙ্কারি করে সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করে। আসিফদের মতো শিক্ষক-ছাত্র দিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া যাবে না। আমরা শিক্ষা জগতের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের আহ্বান জানাবো, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সরকারকে স্থিতিশীল ও শক্তিশালী করতে এবং প্রধানমন্ত্রী স্মার্ট বাংলাদেশ প্রত্যয়কে কার্যকর করতে ধর্ম ব্যবসায়ীদের সব রকমের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে রুখে দাঁড়ান।
রাজনীতিতে তারা যেভাবে কাজটি করে এখানেও সেই একইভাবে কাজটি শুরু হলো। বিএনপি থেকে এর প্রতিবাদ শুধু নয় বলা হয়েছে নতুন কারিকুলাম বাদ দিতে হবে। একই সঙ্গে হেফাজতও বলেছে, ‘শরীফ থেকে শরীফা’ তো বটে, এই কারিকুলাম বাদ দিতে হবে। সব মিলিয়ে এটি একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করতে চাচ্ছে ষড়যন্ত্রকারীরা। এছাড়া গণমাধ্যমে থাকার আর কোনো উপায় তারা খুঁজে পাচ্ছে না।
এখানে দুটি পর্যবেক্ষণ: এক. গত কয়েক বছর দেখছি, কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র শিক্ষকদের অনেকে মৌলবাদের এবং জঙ্গিবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছেন। এর কারণ, উপযুক্ত স্কুটিনির অভাব। যে কটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এগুলো ঘটেছে সেগুলোর প্রতিষ্ঠাতা সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। তাহলে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এধরনের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে কীভাবে? বিশ্ববিদ্যালয় তো প্রগতির জায়গা। কর্তৃপক্ষকে বলব, ছাত্রভর্তি ও শিক্ষক নিয়োগে তাদের যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার।
দ্বিতীয়ত. মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারকে ধর্ম ব্যবসায়ীরা ধমক দিলেই তারা পিছু হটেন। এর কারণ যদি ভোট হয় তাহলে বলতে হয়, ধর্ম ব্যবসায়ীদের ভোট ছাড়াই তারা প্রায় ৪১ ভাগ ভোট পেয়েছেন। এবং ধর্ম ব্যবসায়ীরা তাদের কখনও ভোট দেয় না এটি তারা মানতে রাজি নয়, কিন্তু এটিই সত্যি। বঙ্গবন্ধুর এই মোহ ছিল না। তার দলের নেতাকর্মীদের কেন এই মোহ থাকবে? এবং আমাদের আশঙ্কা এবারও পিছু হটে ধর্মব্যবসায়ীদের সরকারকে অস্থিতিশীল করার উদ্যোগ গ্রহণে সাহায্য করবে। আমরা আশা করি সরকার পিছু হটার আত্মঘাতী পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকবে।
লেখক: ইতিহাসবিদ, সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/জিকেএস