ফোকলোর শাখায় ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩’ অর্জন করেছেন লেখক ও গবেষক সুমনকুমার দাশ। পেশাগত জীবনে তিনি সাংবাদিক। তরুণ এ গবেষক বাউল শাহ আবদুল করিমসহ আরও কয়েকজন লোককবিকে নিয়ে প্রচুর কাজ করেছেন। এখনো চষে বেড়ান মাঠ-ময়দান, বিস্মৃত ও জীবিত গুণী ব্যক্তিদের খোঁজে। সুমনের আগ্রহ ও কাজের পরিধি বহুমুখী বিস্তৃত। বিলুপ্তপ্রায় লোকসংস্কৃতি বিষয়েও কয়েকটি বই লিখেছেন। ২০১২ সালের ১২ নভেম্বর সিলেটের একটি হোটেলে বসে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক শফিক হাসান—
Advertisement
জাগো নিউজ: পত্রিকায় ‘ভাটি অঞ্চলের গান: সেকাল-একাল’ নামে আপনার একটি মূল্যবান প্রবন্ধ পড়লাম। এ লেখায় হাওর এলাকার বিভিন্ন গানের ধারা হারিয়ে যাচ্ছে বলে আক্ষেপ করেছেন। বিষয়টি বিস্তারিত শুনতে চাচ্ছি—সুমনকুমার দাশ: যে লেখাটির কথা বললেন, সেটি কলকাতার প্রখ্যাত শিল্পী মৌসুমী ভৌমিকের আহ্বানে লিখেছিলাম। কলকাতায় মৌসুমী ভৌমিকদের উদ্যোগে গত কয়েক বছর ধরে নিয়মিতভাবে বাউল-ফকির উৎসব পালিত হয়ে আসছে। এবারও জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে সে উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। উৎসব উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকার জন্য এটি লিখেছিলাম। একই সময়ের ব্যবধানে একটি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত মাসিক সাহিত্য সাময়িকী নতুনধারার নির্বাহী সম্পাদক কবি সাখাওয়াত টিপুর বদান্যতায় প্রকাশিত হয়েছে। তবে এ লেখার বাইরে ভাটি অঞ্চলের গান সম্পর্কে আমার বলার আরও অনেক কিছু রয়েছে। সেসব কথা ভবিষ্যতে কোনো এক লেখায় বিস্তৃত পরিসরে লেখার ইচ্ছা রয়েছে। লেখাটিতে ভাটি অঞ্চলের বিভিন্ন গানের ধারা প্রসঙ্গে বিচ্ছিন্নভাবে আলোচনার পাশাপাশি ব্যক্তিগত অভিমত জানিয়েছিলাম। কত কত গান ছিল ওই এলাকায়। অথচ সেসব গানের ধারা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। এই তো সেদিন হেমাঙ্গ বিশ্বাসের আত্মজীবনী উজান গাঙ বাইয়া পড়ছিলাম। সে বইটির পরতে পরতে ভাটি অঞ্চলের বিভিন্ন গানের ধারা প্রসঙ্গে লেখক আলোকপাত করেছেন। মাত্র ৬০-৭০ বছরের ব্যবধানে সেসব গানের ধারা এখন বিলুপ্তির পথে। অথচ সেসব গানের ধারা বাঁচিয়ে রাখতে পৃষ্ঠপোষকতা অথবা সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগই তেমনভাবে চোখে পড়ছে না।
জাগো নিউজ: কী ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন বলে মনে করেন?সুমনকুমার দাশ: সরকারি কিংবা বেসরকারি উভয় পর্যায় থেকেই এটি হতে পারে। বাংলা একাডেমি, এশিয়াটিক সোসাইটি কিংবা যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আর উদ্যোগী এগিয়ে আসতে পারে। বিস্মৃতির আড়ালে তলিয়ে পড়া গানের ধারাগুলো পুনর্জীবিত করার পাশাপাশি গানের অডিও-ভিডিওসহ সব ধরনের ডিজিটাল ডকুমেন্টেশন কালেক্ট করা এবং সংশ্লিষ্ট পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করা—কতকিছুই করা যেতে পারে।
জাগো নিউজ: দীর্ঘদিন ধরে হাওর এলাকায় ঘুরে ঘুরে গান সংগ্রহের কাজ করে চলেছেন। শুনেছি আপনার সংগ্রহে ৪০ থেকে ৫০ হাজার লোকগানের পাণ্ডুলিপি রয়েছে—সুমনকুমার দাশ: আমি মূলত হাওরের গ্রামীণ নারীদের কাছ থেকে এসব গানের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেছি। এসব পাণ্ডুলিপির মধ্যে ধামাইল গান, লোকগান, বাউলগান, কেচ্ছা, ঢপযাত্রা, প্যাঁচালি, নারী সংগীত, সূর্যব্রত সংগীত, গোষ্ঠগান, কীর্তনসহ বিষয়-বৈচিত্র্যে ভরপুর বিচিত্র ধরনের গান রয়েছে। সংগৃহীত এসব গান দিয়ে আমার সম্পাদনায় ইতোমধ্যে কয়েকটি গানের সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। যেমন- বাংলা একাডেমি থেকে বাংলাদেশের ধামাইল গান, অ্যাডর্ন পাবলিকেশন্স থেকে অগ্রন্থিত রাধারমণ, উৎস প্রকাশন থেকে বেদে-সংগীত উল্লেখযোগ্য। ২০০৮ সালে প্রকাশিত বেদে-সংগীত গ্রন্থটি ওই বছর প্রথম আলো সাহিত্য সাময়িকী নির্বাচিত ১০ তরুণের নির্বাচিত বইয়ের একটি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল।
Advertisement
আরও পড়ুন: সুলতানার স্বপ্ন: আদর্শ বৈজ্ঞানিক ইউটোপিয়া
জাগো নিউজ: বাউল সম্পর্কিত আপনার কয়েকটি মৌলিক ও সম্পাদিত গ্রন্থও রয়েছে— সুমনকুমার দাশ: ২০১২ সালে অন্বেষা প্রকাশন থেকে ‘বাংলাদেশের বাউল-ফকির: পরিচিতি ও গান’ নামে হাজার পৃষ্ঠার একটি সুবৃহৎ বই প্রকাশিত হয়েছে। এতে বিভিন্ন বাউল-ফকিরদের কথা ও পরিচিতি এবং গানের মূল্যায়নের পাশাপাশি বিশিষ্ট বাউলদের পদাবলিও স্থান পেয়েছে। এছাড়া আমার সম্পাদনায় আরকুম শাহ রচনাসমগ্র, দুর্বিন শাহ রচনাসমগ্র, কফিলউদ্দিন সরকারের গান শীর্ষক কয়েকটি বাউলগানের সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে।
জাগো নিউজ: একসময় কবিতা লিখতেন। এমনকি ‘সামান্থা’ নামে আপনার একটি উপন্যাসও রয়েছে। এখন আপনার সৃজনশীল লেখাজোকা পাচ্ছি না কেন?সুমনকুমার দাশ: আমার সাহিত্যচর্চার শুরুটা কিন্তু কবিতা লেখার মাধ্যমে। তখন টুকটাক গল্পও লিখতাম। তবে এসব গল্প-কবিতার বিষয়বস্তু কিন্তু ভাটি অঞ্চলের বিভিন্ন পুরাণ ও কাহিনি উপজীব্য করে লেখা। ‘চাঁদ উঠেছিল তিন জোড়া চোখের মাপে’ এবং ‘আফালে ভাঙে মরা নক্ষত্রপোড়া চউখ’ নামে আমার দুটি কাব্যগ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছিল। গবেষণার কাজে এখন পুরোপুরি সম্পৃক্ত থাকার সুবাদে কবিতা আর তেমন একটা লেখা হয়ে উঠছে না। তবে বিভিন্ন লোককবি ও বাউলদের জীবনভিত্তিক কয়েকটি উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা রয়েছে। দেখা যাক ভবিষ্যতে সে ইচ্ছা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়!
জাগো নিউজ: বাউল শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে একাধিক গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। করিমকে নিয়ে এত আগ্রহ সৃষ্টি হলো কেন!সুমনকুমার দাশ: শাহ আবদুল করিমের বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায়। এ উপজেলার পাশেই শাল্লা উপজেলা, সেখানে আমার জন্ম। শৈশব থেকে আমাদের বয়সীরা করিমের গান শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। যৌবনে সেই গানের গীতিকার ও গায়ক ব্যক্তি করিম সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। সে আগ্রহ থেকেই একদিন করিমের বাড়িতে হাজির হই। সেভাবেই মূলত শুরু। এরপর করিমকে নিয়ে একের পর এক লিখতে শুরু করি। সেভাবেই করিমের জীবন ও গান নিয়ে গবেষণা আরম্ভ করি। একে একে প্রকাশিত হয় করিম সম্পর্কিত আমার সাত-সাতটি বই। এ পর্যন্ত করিমকে নিয়ে প্রকাশিত বইগুলো হচ্ছে: শাহ আবদুল করিম সংবর্ধন-গ্রন্থ, বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম, গণগীতিকার শাহ আবদুল করিম, শাহ আবদুল করিম স্মারকগ্রন্থ, শাহ আবদুল করিম, সাক্ষাৎকথায় শাহ আবদুল করিম এবং বাংলা মায়ের ছেলে: শাহ আবদুল করিম জীবনী। এছাড়া ২০১৩ সালের বইমেলায় শাহ আবদুল করিম: জীবন ও সংগীত শীর্ষক বই প্রকাশের কথা রয়েছে। এ বইয়ে করিমের জানা-অজানা বিভিন্ন তথ্য, অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার, জীবন পরিচিতি, দুর্লভ কিছু আলোকচিত্রসহ ৫০টি গান সংকলিত হয়েছে।
Advertisement
আরও পড়ুন: জীবনানন্দের লাশকাটা ঘরের পোস্টমর্টেম
জাগো নিউজ: বাংলা গণসংগীতের ধারাটা ক্রমশ স্থিমিত হয়ে পড়েছে। এতে আপনি কতটুকু সহমত পোষণ করবেন?সুমনকুমার দাশ: কথাটি একেবারেই ঠিক। তবে এর পেছনে সুনির্দিষ্ট একটি কারণও রয়েছে। সেটা হচ্ছে—গণসংগীত মূলত জাগরণমূলক গান। ভারতবর্ষের প্রতিটি সংকটকালীন গণসংগীত বাঙালিকে উজ্জীবিত ও প্রাণিত করেছে। অন্যদিকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনে ব্যাপকভাবে গণসংগীতচর্চার বিষয়টি আমরা দেখেছি। সম্প্রতি এ ধরনের সংকটকালীন মুহূর্ত কিংবা পরিবেশ তৈরি না হওয়ার কারণেই নতুনভাবে গণসংগীতের জন্মও হচ্ছে না। তবে এটা ঠিক—এক-এগারোর সময়,মৌলবাদী অপশক্তির বিভিন্ন অপকর্মের প্রতিবাদ জানানোর সময় শিল্পীরা পুরোনো গণসংগীতগুলোই ঘুরে-ফিরে গাইছেন। কিন্তু কেন? এমনটা হবে কেন? এই যে দেশের নানা ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা-আগ্রাসন-সংঘাত, সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান—সেসবের বিরুদ্ধেও তো নতুনভাবে গণসংগীতের জন্ম হতে পারতো। সেটা হচ্ছে না কেন? এ ব্যর্থতা কার! তবে কি গণগীতিকার, সুরকার কিংবা শিল্পীরা নতুনভাবে উঠে আসছে না?
জাগো নিউজ: অনেকদিন ধরে বাংলাগান, বাউলগান, লোকগান নিয়ে গবেষণা করছেন। এর চর্চা, বিকাশ ও ক্ষেত্র কেমন?সুমনকুমার দাশ: আসলে এককথায় এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। তারপরও সংক্ষেপে যদি বলি, এটি এরকম—আমাদের লোকগানের যে সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ভান্ডার রয়েছে—সেটির সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। এসব গান নিয়ে আরও চর্চা ও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। অনাবিষ্কৃত নতুন নতুন ক্ষেত্রগুলো নিয়ে ব্যাপকভাবে কাজ করা প্রয়োজন। যেসব গানের ধারা এখনো নিভু নিভু জ্বলছে; তাতে ঘি ঢালতে হবে। আর এ ঘি ঢালার কাজটা করতে হবে প্রত্যেককেই।
এসইউ/এসএম