দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রেশ কাটতে না কাটতেই বেজে উঠেছে নতুন নির্বাচনের দামামা। গুরুত্বে না হলেও সংখ্যায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চেয়েও বড় উপজেলা নির্বাচন। দেশে ৪৯৫টি উপজেলা রয়েছে। এরমধ্যে ৪৫২টি নির্বাচন উপযোগী। তবে উপজেলা নির্বাচন একদিনে হয় না। ধাপে ধাপে দেশে উপজেলা নির্বাচন হবে। মার্চ থেকেই হয়তো শুরু হয়ে যাবে উপজেলা নির্বাচনের উৎসব। তবে নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সামনে কিছু চ্যালেঞ্জ আছে।
Advertisement
এসএসসি পরীক্ষা, রমজান এবং আসন্ন বর্ষা মৌসুমকে মাথায় রেখেই নির্বাচনী তফসিল পরিকল্পনা করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। তবে নির্বাচন কমিশনের কাজ নির্বাচন কমিশন ঠিকমতই করবে।
নির্বাচনের খেলার মাঠ তারা তৈরি করবে। নির্বাচন কমিশন তো রেফারি। তারা সমতল মাঠ তৈরি করবে। কিন্তু কারা খেলায় অংশ নেবে, কারা নেবে না; এটার নিশ্চিত করার এখতিয়ার বা ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই। তারা আমন্ত্রণ জানাতে পারে। কিন্তু সাড়া দেয়া না দেয়ার দায়িত্ব খেলোয়াড়দের। যেমন গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। ফলে ভোটার উপস্থিতিও পর্যাপ্ত ছিল না।
কিন্তু নির্বাচনের পর থেকেই বিএনপি বলছে, এই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি, ভোটাররা অংশ নেয়নি। নির্বাচন যে অংশগ্রহণমূলক হবে না, এটা বলার জন্য তো ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করার দরকার ছিল না। ভোটাররা যে কেন্দ্রে আসবেন না, এটা জানার জন্যও জ্যোতিষী হতে হয় না। বিএনপি নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর থেকেই এ দুটি ব্যাপার নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। যাদের সিদ্ধান্তের কারণে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হতে পারলো না, তারাই যদি এখন নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি বলে শোরগোল করে, তাহলে তো মুশকিল।
Advertisement
বাংলাদেশে নির্বাচন একটা উৎসব। কিন্তু সবগুলো দল ঠিকঠাক মত অংশ না নেয়ায় অনেকদিন ধরেই সে উৎসবটা হারিয়ে গেছে। জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে গুরুত্ব কম হলেও স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে উৎসব-আগ্রহটা বেশি। নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী- সবার দায়িত্ব হলো নির্বাচনে সেই উৎসবের রংটা ফিরিয়ে আনা।
সর্বশেষ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপি উপজেলা নির্বাচনেও অংশ নেবে না। তবে গত কয়েকবছরে দেখেছি, সিদ্ধান্ত বদলানোর ব্যাপারে দারুণ ধারাবাহিকতা আছে দলটির। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকেই নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে বিএনপি। তারা বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না, এটাই তাদের সিদ্ধান্ত।
সে অনুযায়ী তারা ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়নি। কিন্তু সে জাতীয় নির্বাচনের আগে-পরে বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ঠিকই অংশ নিয়েছে এবং সাফল্যও পেয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নিলেও ২০১৮ সালের নির্বাচনে ঠিকই অংশ নিয়েছে বিএনপি। সে নির্বাচনে ভরাডুবি হলে তারা সংসদে যোগ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ঠিকই সংসদে যোগ দেন বিএনপির সংসদ সদস্যরা। আবার হুট করে পদত্যাগও করে বসেন।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে উৎসবমুখরতা বেশি থাকে। কারণ এখানে প্রার্থী বেশি থাকে। সব প্রার্থী নিজ নিজ স্বার্থে ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে সচেষ্ট থাকেন। আর নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হলে ভোটাররা এমনিতেই উৎসাহী থাকেন। আগামী উপজেলা নির্বাচন দিয়েই দেশে নির্বাচনে উৎসবের রং লাগুক, ভোটাররা স্বতস্ফুর্তভাবে কেন্দ্রে এসে তাদের প্রতিনিধি বাছাই করার স্বাধীনতা উপভোগ করুক।
Advertisement
বিএনপি এমপিরা কেন একাদশ সংসদে যোগ দিলেন, কেন পদত্যাগ করলেন; কোনোটারই কোনো ব্যাখ্যা নেই। ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি। তারই ধারাবাহিকতায় তারা উপজেলা নির্বাচনেও অংশ নেবে না, এমনটাই বলা হচ্ছে। কিন্তু উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে আমি মোটেই অবাক হবো না। বরং আমি মনে করি নিজেদের স্বার্থে, সংগঠনের স্বার্থে, নেতাকর্মীদের স্বার্থে বিএনপির উচিত নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ফিরে আসা।
বিএনপির মত একটা নির্বাচনমুখী দল দিনের পর দিন নির্বাচনের বাইরে থাকলে নেতাকর্মীদের মনোবল নষ্ট হয়ে যায়। আপনি নির্বাচনে অংশও নেবেন না আবার নির্বাচন ঠেকানোর মত আন্দোলনও করতে পারবেন না; তাহলে নেতাকর্মীরা কিসের আশায় দিনের পর দিন রাজনীতি করবেন। এরই মধ্যে বিএনপির দলীয় ফোরামে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার দাবি উঠেছে। শেষ পর্যন্ত হয়তো দলীয়ভাবে না হলেও বিএনপির স্থানীয় নেতাদের নির্বাচনে অংশ নেয়ার অনুমতি দেয়া হতে পারে। নির্বাচনে অংশ নিলেই বরং বিএনপির নেতাকর্মীরা চাঙা হবে। মাঠে নামতে পারবে। প্রকাশ্যে নির্বাচনী কর্মসূচি পালন করতে পারবে।
বিএনপি নির্বাচনে আসুক আর না আসুক আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেবে। তবে বিএনপি আসা না আসার ওপর আওয়ামী লীগের কৌশল নির্ভর করবে। বিএনপি এলে একরকম, না এলে আরেকরকম। স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হতো। আইন বদলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও দলীয় প্রতীকে করার বিধান করা হয়। তবে এই সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগের জন্যই বুমেরাং হয়েছে।
সারাদেশে তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্ব রক্তক্ষয়ী রূপ পেয়েছে। বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ‘নৌকা’ প্রতীকের পরাজয় ঘটেছে। এবার তাই আওয়ামী লীগ ভিন্ন চিন্তা করছে। বিশেষ করে গত জাতীয় নির্বাচনে দলীয় বিদ্রোহীদের নির্বাচনে অংশ নেয়ার অনুমতি দিয়ে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার চেষ্টা হয়েছে। তাতে সরকার অনেকটাই সফল হয়েছে।
৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীর জয় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। উপজেলা নির্বাচনও সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার কথা ভাবছে আওয়ামী লীগ। সে ক্ষেত্রে দলীয় প্রতীক কাউকে নাও দেয়া হতে পারে। কারণ দলীয় প্রতীক পেলে সংঘাত-সহিংসতা বাড়ে। সে ক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাচন সবার জন্য উন্মুক্ত থাকলে বিএনপি না এলেও দেশজুড়ে দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও উৎসবের আমেজ তৈরি হতে পারে। তারচেয়ে বড় কথা আওয়ামী লীগের অন্তর্ন্দ্বটা তৃণমূল পর্যায়ে রক্তক্ষয়ী হয়ে উঠবে হয়তো।
দলও তখন বুঝতে পারবে, কারা সত্যিকারের জনপ্রিয়। যারা জনগণের কাছে যাবে, ভালো কাজ করবে; তারাই জিতে আসবে। ‘নৌকা’ পেলেই এই ধারণাটা ভাঙার সময় এসেছে। আমাদের কিছু করতে হবে না, শেখ হাসিনা কোনো না কোনোভাবে জিতিয়ে দেবেন, এই ধারণাটা আওয়ামী লীগ নেতাদের জনবিচ্ছিন্ন করেছে।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে অনায়াসে জয় পাওয়ায় আওয়ামী লীগের তৃণমুলে একটা গাছাড়া ভাব চলে এসেছিল। গত নির্বাচনে ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীর জয়, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা, এমনকি মন্ত্রীদের পরাজয় আওয়ামী লীগ নেতাদের ধারণায় বড় ধাক্কা দিয়েছে। জিততে হলে জনগণের কাছে যেতে হবে। উপজেলা নির্বাচন উন্মুক্ত করে দিলে আওয়ামী লীগ নেতাদের আবার জনগণের কাছে যেতে হবে। তাতে আখেরে সংগঠনেরই লাভ।
আরেকটা বড় ব্যাপার হলো, স্থানীয় সরকার নির্বাচন যখন নির্দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হতো; তখন স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয়, প্রভাবশালী অরাজনৈতিক ব্যকিত্তরাও নির্বাচনে অংশ নিতেন এবং তাদের অনেকে নির্বাচিতও হতেন। এভাবে শিক্ষক, আইনজীবী, সমাজকর্মীদের স্থানীয় সরকারে অবদান রাখার সুযোগ ছিল। কিন্তু দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের বিধান করার পর থেকে রাজনীতির বিষ ছড়িয়ে পড়ে তৃণমূলেও। ফলে হারিয়ে যায় অরাজনৈতিক সামাজিক শক্তি।
আগেই বলেছি, গুরুত্বে কম হলেও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে উৎসবমুখরতা বেশি থাকে। কারণ এখানে প্রার্থী বেশি থাকে। সব প্রার্থী নিজ নিজ স্বার্থে ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে সচেষ্ট থাকেন। আর নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হলে ভোটাররা এমনিতেই উৎসাহী থাকেন। আগামী উপজেলা নির্বাচন দিয়েই দেশে নির্বাচনে উৎসবের রং লাগুক, ভোটাররা স্বতস্ফুর্তভাবে কেন্দ্রে এসে তাদের প্রতিনিধি বাছাই করার স্বাধীনতা উপভোগ করুক।
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/জেআইএম