দুধের দাম কম হওয়ায় নিজের খামারে উৎপাদিত দুধ দিয়ে দই বানিয়ে বাজারজাত করছেন পাবনার এক খামারি। অভিনব এ পদ্ধতিতে মুনাফাও করছেন ভালো। অথচ শুধু দুধ বিক্রি করে এসময় ক্ষতির মুখে পড়েছিল তার খামার। যেখানে উৎপাদন খরচ তুলতেই হিমশিম খেতে হতো তাকে। এখন এক লিটার দুধের দই বানিয়ে খরচ বাদ দিয়েও লাভ হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকা। খামারটিও ধ্বসের মুখ থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
Advertisement
পাবনার সদর উপজেলার চোমরপুর কদমতলা গ্রামে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এভাবেই ঘুরে দাঁড়ানোর বাস্তব গল্প লিখছেন খামারটির মালিক আমির সোহেল মিলন নামের এক যুবক। স্ত্রীর নামেই খামারের নাম দিয়েছেন ‘জান্নাত অ্যাগ্রো ফার্ম’। অথচ একসময় জাপানে নাবিকের চাকরি ছেড়ে দেশে ফিরে খামার করে লোকসানের চোখ রাঙানো দেখছিলেন এই উদ্যোক্তা। তারপরও হাল ছাড়েননি। খুঁজেছেন বিকল্প পথ। আর সেই পথে সাফল্যও ধরা দিয়েছে। প্রাণিসম্পদ বিভাগ জানিয়েছে, এ ধরনের ব্যতিক্রমী উদ্যোগ অনুসরণ করে অন্য খামারিরাও লাভবান হতে পারেন।
স্নাতকোত্তর শেষ করা উদ্যোক্তা মিলন পাবনা সদর উপজেলার চোমরপুর কদমতলা গ্রামের আব্দুল কুদ্দুসের ছেলে। আব্দুল কুদ্দুস সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান। মিলন দম্পতি এখন এলাকার বেকার যুবকদের স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখাচ্ছেন। তার সফলতা দেখে উদ্বুদ্ধ নতুন খামারিরাও।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বাড়ির আঙিনায় কয়েক বিঘা জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে জান্নাত অ্যাগ্রো ফার্ম। তৈরি করা হয়েছে একাধিক পাকা শেড। খামারের ভেতর-বাইরের পরিবেশ বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সেখানেই গো- খাদ্যের জন্য চাষ করা হচ্ছে উন্নত জাতের ঘাস।
Advertisement
আমির সোহেল মিলন জাগো নিউজকে জানান, তিনি জাপানে চাকরি করলেও মন পড়ে থাকত গ্রামে। মনে মনে ভাবতেন কোনো একসময় গ্রামে ফিরে উদ্যোক্তা হবেন। এক পর্যায়ে জাপানে চাকরি ছেড়ে দেশে ফিরে আসেন। প্রাণের টানেই বছর পাঁচেক আগে স্ত্রীকে নিয়ে গড়ে তোলেন জান্নাত অ্যাগ্রো ফার্ম। স্ত্রীর নামে প্রতিষ্ঠিত খামারটিতে এখন অর্ধশতাধিক ষাঁড় এবং ১০টি গাভী রয়েছে। এই উদ্যোক্তা এখন বছরে একশোর বেশি গরু মোটাতাজাকরণের পরিকল্পনা করছেন।
মিলন বলেন, বাংলাদেশ কোরবানির পশু উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাইরে থেকে গরু আনার প্রয়োজন হয় না। দেশে নতুন নতুন খামারিও আসছেন। তরুণ ও বেকারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, উদ্যোক্তা হওয়ার বিকল্প নেই। আমি আধুনিক খামার করে দেখিয়ে দিচ্ছি, দেশে শ্রম দিলে টাকা উপার্জনের জন্য জাপান বা অন্য কোনো দেশে যাওয়ার দরকার হয় না। শ্রম ও নিষ্ঠা থাকলে দেশে থেকেই অনেক আয় করা সম্ভব। আমার খামারে নিজে আয় করছি, পাশাপশি ১০-১২ জনের কর্মসংস্থান করতে পেরেছি।
তিনি আরও বলেন, স্বপ্ন আছে এই খামারে শতাধিক লোকের কর্মসংস্থান করবো। দেশীয় পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজাকরণ করছি।
মিলনের স্ত্রী শাকিলা ফেরদৌস জানান, তিনিও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। স্বামীর সঙ্গে নিজেও খামারে সময় দেন। স্বামীর বাইরের অনেক কাজ সামলাতে হয়। সেজন্য তিনি সার্বক্ষণিকভাবে খামার দেখভাল করে থাকেন। গো-খাদ্যের পাশাপাশি তিনি হাঁস-মুরগি ও ছাগল পালন করেন।
Advertisement
শাকিলা জানান, শুরুতে গরুর খামার করার কথা শুনে অনেকেই নেতিবাচক মন্তব্য করতেন। অনেকে ব্যঙ্গ করে এমনও বলতেন, ঢাকার খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান থেকে পড়ালেখা শেষ করে এসেছে গরুর খামার করতে! যারা এসব বলতেন তারাই এখন প্রশংসা করছেন।
আমির সোহেল মিলন জানান, গাভী পালন করতে গিয়ে তিনি সমস্যায় পড়েছেন গো-খাদ্য নিয়ে। গো-খাদ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েন তিনি। ১০ বছর আগে এক কেজি গমের ছালের দাম ছিল ৮-১০ টাকা, এখন সেটা ৬০-৬২ টাকা। এখন এক মণ খেসারির ভুসির দাম ১৪০০ টাকা, তখন এসব ভুসি খামারিরা কিনতেনই না। এক মণ খড়ের দাম এখন ৫০০ টাকা। সেই খড় আবার ৩০-৩২ কেজিতে মণ ধরা হয়। সে হিসাবে কেজিপ্রতি দাম পড়ে ১৫ টাকা। মিল্ক ভিটাসহ দুগ্ধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দুধ সংগ্রহ কমিয়ে দেওয়ায় তাদের মতো খামারিদের বাধ্য হয়ে বিকল্প পথ খুঁজে নিতে হচ্ছে।
সংকট কাটিয়ে খামারকে লাভবান করতে বিশেষ কৌশল নেন বলে জানালেন মিলন। তার খামারে প্রতিদিনের উৎপাদিত শতাধিক লিটার দুধের দই তৈরি করছেন। সেই দই পাবনা শহরে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করছেন। এতে তিনি ক্ষতি কাটিয়ে ভালো মুনাফাও করছেন।
এই উদ্যোক্তা জানান, তার খামারে উৎপাদিত দুধ থেকে তিনি প্রতিদিন ৫০০ কাপ দই তৈরি করছেন। প্রতি লিটার দুধ থেকে ১২ কাপ দই তৈরি করেন। প্রতি কাপ দই বিক্রি করেন ২৫ টাকা দরে। সে হিসাবে ১২ কাপ দইয়ের দাম পান ৩০০ টাকা।
এই খামারি বলেন, গরম মৌসুমে ৪০-৪৫ টাকা লিটার দরে দুধ বিক্রি করতে হয়। তাতে লাভ তো দূরে, খরচ উঠানোই কঠিন ছিল। কিন্তু দই তৈরি শুরুর পরে দ্রুতই খামারের দৃশ্যপট পাল্টে যেতে শুরু করে। এখন প্রতি লিটার দুধে ১২ কাপ দই তৈরি করে ৩০০ টাকা পাচ্ছেন। চিনি ও অন্য খরচ বাদ দিয়েও প্রতি লিটার দুধে তৈরি দই থেকে তার ৮০-৯০ টাকা লাভ থাকে। দুধ বিক্রি করে এ মুনাফার কথা কল্পনাও করা যায় না।
মিলনের বাবা সাদুল্লাপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল কুদ্দুস জাগো নিউজকে জানান, তাদের মোটামুটি সহায় সম্পদ রয়েছে। ছেলে উচ্চশিক্ষিত হয়ে জাপানে যায়, সেখানে জাহাজের নাবিক ছিল, ভালো বেতনও পেত। তবে ছেলে শুধু টাকার জন্য বিদেশে পড়ে থাকুক তা তিনি চাননি। তিনি চাইতেন ছেলে দেশে ফিরে উদ্যোক্তা হোক, এলাকার তরুণ-যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করুক। ছেলেও বাবার সেই চাওয়া পূরণ করেছেন। বাবা হিসেবে আব্দুল কুদ্দুস এখন ছেলেকে নিয়ে গর্বিত। এছাড়া নিয়মিত পরামর্শ ও উৎসাহও দিচ্ছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা আশরাফ হোসেন জানান, মিলনের খামার এলাকায় অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত। উচ্চশিক্ষিত এ দম্পতি বেশ কিছু লোকের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করেছেন।
পাবনা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আল মামুন হোসেন মন্ডল জাগো নিউজকে বলেন, দুধের দাম কম বলে আমির সোহেল মিলন দম্পতি দই তৈরি করে বিক্রির যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা একটি সৃজনশীল চিন্তা। যা তাদের সাফল্য এনে দিয়েছে। তাদের দেখাদেখি অন্য খামরিরাও উৎসাহ পাবেন।
আমিন ইসলাম জুয়েল/এমকেআর/এমএস