অবাধ শব্দটির সঙ্গে অবাধ্যতার একটি সম্পর্ক রয়েছে। আর অবাধ্যতার সঙ্গে বাধ্যতার। শুনতে অনেক শব্দ যেমন শ্রুতিমধুর কার্যত তার মাধুর্য বিবেচনা ‘আপেক্ষিক’ অনেক অর্থেই। তাই অবাধ স্বাধীনতা বলে আদৌ কিছু কোথাও আছে কি না তা সময়, পরিবেশ, ভূগোল, পরিস্থিতি সাপেক্ষ। ফলে ফ্রিডম অব স্পিচ, ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন, ফ্রিডম অব থটস্ বলে অ্যাবসলিউট ফ্রিডমের যে পশ্চিমা ভাব ও ভাবনা তা অনেকটাই বায়বীয়। অ্যাবসলিউট বলে সারা বিশ্ব ভূগোলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব বহন করে কি না তাও এক প্রকার যুক্তির জন্য যুক্তি; তর্কের জন্য তর্ক।
Advertisement
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে বেশ মুখরোচক আলোচনা প্রায়শই শুনি। কিন্তু যারা এই আলোচনায় মেতে উঠেন তারা নিজেরা এই স্বাধীনতা কতটা নিজের এবং কতটা অন্যের স্বার্থে বিবেচনা করেন তা তাদের ব্যক্তিগত আমলনামা লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়। প্রায়ই শোনা যায় বাংলাদেশের গণমাধ্যম স্বাধীন নয়। সরকার নিয়ন্ত্রিত, সরকার গণমাধ্যমকে স্বাধীনতা দেয় না এমন সব কথা। কিন্তু যারা এ কথাটি বলেন দেশে অথবা বিদেশে বসে তাদের মূলত জ্ঞানের অভাব। অথবা ভদ্র ভাষায় আমি জ্ঞানের স্বল্পতাও বলতে পারি। মূর্খ বলবো না কেননা তারা জেনে বুঝে উদ্দেশ্য, এজেন্ডা নিয়েই এমন বলেন।
জেনে রাখা ভালো কোনো সরকার চাইলেই গণমাধ্যমকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। হয়তো স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত করতে পারে। কেননা গণমাধ্যমের স্টেকহোল্ডার সরকার একা নয়। এখানে আরও অনেক স্টেকহোল্ডার রয়েছে। ফলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নির্ভর করে অনেকগুলো বিষয়ের ওপর। যার মধ্যে সরকার একটি। ফলে ঢালাও ভাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পরিপন্থি সরকার এমন বয়ানের কোনো ভৌত ভিত্তি নেই আদতেই। কারণ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোই তা অনুমোদন করে না। দেশের প্রচলিত আইনও বিবেচ্য। এছাড়া ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। ফলে সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই বলা আছে সাংবাদিক ও প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা কতখানি।
আবার বিজ্ঞাপনদাতাগণও ফ্যাক্টর। কারণ তাদের অর্থে গণমাধ্যমের উপার্জন হয়। ফলে বিজ্ঞাপনদাতা বা এজেন্সির স্বার্থ কখনো কখনো সংবাদ প্রকাশ বা প্রচারকে নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। এখানে গোপনীয়তার কিছু নেই বরং তা বাস্তবতা। আর মালিক পক্ষ? তাদের কথা কী আপনি ভুলে যাবেন, সুযোগ রয়েছে কোনো?
Advertisement
মালিক পক্ষের রাজনৈতিক, আদর্শিক, ব্যবসায়িক এমন অনেক অবস্থান থাকতে পারে সেটা অস্বীকারেরও কোনো সুযোগ নেই। এমনকি সাংবাদিক নিজেও পক্ষ অবস্থানে থাকতে পারেন। তার রাজনৈতিক অবস্থান, আদর্শিক অবস্থান, ধর্মীয় অবস্থান এমন অনেক কিছু। খোদ মার্কিন মুল্লুকেই তো সাংবাদিকদের একপক্ষ ডেমোক্রেট, অন্যপক্ষ রিপাবলিকান সমর্থক। আবার কখনো কখনো সাংবাদিক নিজেও সেলফ্ সেন্সর করে তার নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থের জায়গা থেকে। এটি অস্বীকারের সুযোগ কোথায়?
দীর্ঘদিন সম্পাদক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে কেবল তাত্ত্বিক নয়, গণমাধ্যম বিষয়ে সব প্রায়োগিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে। ফলে বিজ্ঞাপনদাতা ও এজেন্সির কাছে গণমাধ্যম কতটা করুণ ও অসহায়ভাবে বন্দি তা গণমাধ্যম কর্মী মাত্রই জানেন।
তাই অবাধ স্বাধীনতা চাই, স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে, সরকার সব নিয়ন্ত্রণ করছে এমন ধুয়া না তুলে নির্দিষ্ট করলে ভালো যে কোথায়, কীভাবে স্বাধীনতা নষ্ট হচ্ছে, খর্ব হচ্ছে, কার কারণে। এই ‘জায়গায়’ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নষ্ট হয়েছে বা এ জায়গায় আইনি কাঠামো নষ্ট করেছে বা এ জায়গায় মালিক পক্ষ বা বিজ্ঞাপনদাতাদের কারণে স্বাধীনতা হানি ঘটেছে সেই জায়গাটি সুনির্দিষ্ট করে দেখাতে পারলে ভালো। তা না করে অবাধে যদি বলে দেওয়া হয়, সরকার অবাধ তথ্যের স্বাধীনতা বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা নষ্ট করছে, তা দুঃখজনক।
আবার মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রের অনেক গোপনীয় তথ্য থাকে রাষ্ট্রের স্বার্থ, দেশের মানুষের স্বার্থে। তথ্য অধিকারের কথা বলে সেই তথ্য বা নথি পাওয়ার অধিকার কিন্তু গণমাধ্যমের কোনো ব্যক্তি কেন, সাধারণ কোনো নাগরিকেরই নেই। ফলে সাংবাদিক যদি সেই তথ্য অবাধ করতে চায়, প্রকাশ্য করতে চায়, উন্মুক্ত করতে চায় তা অন্যায় এবং রাষ্ট্রের আইন পরিপন্থি। তখন রাষ্ট্রও তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে।
Advertisement
আবার কোনো একটি স্যাটেলড ইস্যু বা প্রতিষ্ঠিত প্রমাণিত সত্যকে উদ্দেশ্যমূলক ভাবে কেউ যদি বিতর্ক তৈরির টার্গেট নিয়ে চ্যালেঞ্জ করে বসে বা ভুল ব্যাখ্যা দেয় সেটিও অন্যায়। অনেককেই বলতে শুনি মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে করেনি। এটি বলার অর্থই হচ্ছে তাদের কোনো না কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ঘুরে এলে এমন অসংখ্য বিভ্রান্ত্রিমূলক তথ্য বা অপ্রচার চোখে কানে আসবে।
মাননীয় তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত দীর্ঘদিন ধরে গুজব, অপ্রচার, অসত্য তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম করছেন। তার সুচিন্তা ফাউন্ডেশনও সে লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধী ইস্যু, পদ্মা সেতু নিয়ে অপপ্রচার, ড. ইউনূস ইস্যু, বিদেশিদের চাপ এমন অনেক ইস্যুতে তিনি ছিলেন দেশের স্বার্থে সোচ্চার ও সক্রিয়। তিনি বরাবরই বলেছেন, আমি সত্য আর মিথ্যার মাঝখান দিয়ে হাঁটা তথাকথিত নিরপেক্ষ মানুষ নই, এরকম হতেও চাই না। আমার একটা পক্ষ আছে, আর তা হলো, সত্যের পক্ষ, ন্যায়ের পক্ষ।
সম্প্রতি প্রতিমন্ত্রী কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে অপপ্রচার হয় বা হচ্ছে। অনেক সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মূলধারার গণমাধ্যমের লোগো ব্যবহার করেও অপপ্রচার হয় এটা আমরা সবাই জানি। যদি অপপ্রচার অবাধ ও স্বাধীনভাবে বিস্তৃতি লাভ করার সুযোগ পায়, তাহলে কিন্তু কোনো কিছুই দিন শেষে গণতন্ত্রের জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে না, সেটা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বলি আর যাই বলি। সেখানে আমাদের একটি কর্মকৌশল নিতে হবে আলাদা করে। কীভাবে অপপ্রচার ও গুজব আমরা জবাদিহিতার আওতায় আনতে পারি সেটির একটি কাঠামো দাঁড় করাতে পারি।
তিনি আরও বলেন, তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অংশ। আমাদের পূর্ণাঙ্গ অঙ্গীকার আছে। গণতন্ত্রের স্বার্থে, দেশের অগ্রগতির স্বার্থে তথ্যের অবাধ প্রবাহ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি আমরা নিশ্চিত করেছি এবং করতে চাই। একইসঙ্গে তথ্যের অবাধ প্রবাহ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে অপব্যবহার করে কোনো গোষ্ঠী যদি অপপ্রচার বা মিথ্যাচার করে সেটি গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। সাধারণ মানুষের জন্যও ক্ষতিকর।
তার কথাগুলো বিশেষ অর্থ বহন করে। অর্থ বহন করে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, মত প্রকাশের স্বাধীনতার অর্থে। তথাকথিত নিরপেক্ষতার মানে আপনি অর্ধ সত্য, অসত্য সমর্থন করছেন ব্যক্তিগত স্বার্থে; দেশের স্বার্থের বিপরীতে গিয়ে। বলছেন অবাধ তথ্যপ্রবাহের কথা। অবাধ স্বাধীনতার কথা। কিন্তু আপনার এই ‘তথাকথিত অবাধ’র কারণে এক বৃহৎ জনপদের মানুষ, তাদের জীবন মানের উন্নয়ন, তাদের গণতান্ত্রিক দিনযাপনের অধিকার নষ্ট হবে কি না, হারাতে যাচ্ছে কি না তা আপনার নজরে নেই।
যেখানে, যে মাটিতে দাঁড়িয়ে আপনি দেশের সমালোচনা করছেন, গণতন্ত্রের সমালোচনা করছেন, সেই মাটি ভিজে আছে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত আর অশ্রুতে। যেই সজল ভূমি আপনাকে সুযোগ করে দিয়েছে সমালোচনা করার, অধিকার নিয়ে আন্দোলন করার। কিন্তু ভূমিটি যদি না থাকে, অন্যদের অধিকারের আবাস ভূমিতে পরিণত হয় যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করেনি, বাংলাদেশ দর্শন ও আদর্শে বিশ্বাস করেনি। এক বিপরীত বাংলাদেশ। তাহলে আপনার অস্তিত্ব কোথায়?
লেখক: সম্পাদক, আজসারাবেলা। সাবেক ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়া ওয়াচ।
এইচআর/ফারুক/এমএস