স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে সরকার যখন এগিয়ে যাচ্ছে, তখনও অভিযোগের পাহাড় দেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে। ডিজিটাল সেবা দিয়ে গত কয়েক বছরে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করা অনলাইন মার্কেটপ্লেসগুলো হঠাৎ মুখ থুবড়ে পড়ে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে। বিনিয়োগ করে পথে বসেন হাজার হাজার গ্রাহক। ২০২৩ সাল পর্যন্ত জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে (ডিএনসিআরপি) ই-কমার্সের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে ৩৪ হাজার ৬৭টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ১৫ হাজার ২৫টি। এখনো ঝুলে আছে ১৯ হাজার ৪২টি। প্রায় ৫৬ শতাংশ মানুষ এখনো ধুঁকছে।
Advertisement
করোনার আগে ও করোনাকালীন প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে দেশে। লোভনীয় অফার দিতে থাকে সবাই। এক পর্যায়ে উঠতে থাকে প্রতারণার অভিযোগ। টাকা পরিশোধ করেও পণ্য পাওয়া নিয়ে শুরু হয় গড়িমসি। গ্রাহকের অভিযোগ আমলে নিয়ে সরকারও কঠোর হয়। বন্ধ হয় একের পর এক প্রতিষ্ঠান। কেউ কেউ অর্থপাচার করে পাড়ি জমিয়েছে বিদেশে। কয়েকজন ধরা পড়ে খাটছেন জেল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল ইভ্যালি। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার রাসেল প্রায় ২৮ মাস জেল খেটে জামিন পেয়ে নতুন পদ্ধতিতে শুরু করেছেন ব্যবসা।
আরও পড়ুন>> গ্রাহকের অর্ধকোটি টাকা নিয়ে উধাও ‘অগ্রণী ই-কমার্স’
ডিএনসিআরপি তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মোট অভিযোগের মধ্যে ৪৮টি সরাসরি ই-কমার্সে যুক্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগের সংখ্যা ২৮ হাজার ১৮৮টি। এছাড়া ফেসবুক পেজের মাধ্যমে চালানো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ৫ হাজার ৮৭৯টি। ওইসব পেজের বিরুদ্ধে ৯৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ অভিযোগ অবশ্য নিষ্পত্তি করা হয়েছে। বাকি রয়েছে ১৫৭টি অভিযোগ।
Advertisement
এ পরিস্থিতিতে প্রতারিত গ্রাহকেরা বলছেন, অভিযোগগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ পাওনা টাকা ফেরত সংক্রান্ত। লোকসান করা টাকা ফেরত পেতে সব জায়গায় ধরনা দিচ্ছেন তারা। ডিএনসিআরপিতে অভিযোগ দিয়েছেন, কিন্তু প্রতিকার পাচ্ছেন না। এছাড়া চুক্তির শর্ত ভঙ্গ সংক্রান্ত প্রচুর অভিযোগ করেছেন প্রতারিতরা, যেগুলোর বিষয়ে কোনো সুরাহা হচ্ছে না।
ভুক্তভোগী গ্রাহক সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ইভ্যালিতে ১৩ হাজার টাকায় এক টন এসির অফার চলছিল প্রায় আড়াই বছর আগে। ওই সময় টাকা দিয়েছি। এর কিছুদিন পর থেকে ইভ্যালির কার্যক্রম বন্ধ। দীর্ঘদিন কোনো প্রতিকার পাচ্ছি না। এখন কার্যক্রম আবার শুরু হচ্ছে। কিন্তু আগের সার্ভারে আমার ডাটা ছিল। এখন কোনো তথ্যও পাচ্ছি না। প্রমাণ গায়েব হয়ে গেছে।’
আরেকজন প্রতারণার শিকার ক্রেতা রবি ইসলাম বলেন, ‘দুটি বাইকের জন্য টাকা দিয়েছিলাম ইভ্যালি বন্ধ হওয়ার আগে। এখন শুনছি টাকা ফেরত পাবো। কিন্তু কখন কীভাবে এ টাকা পাওয়া যাবে কিছুই জানি না। আবার শুনছি সবাই টাকা পাবে না, তাহলে আমি পাবো কি না সেটাও জানি না। এখনো ইভ্যালির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। কিন্তু তারা কোনো তথ্য দিতে পারছে না। শুধু বলছে, অপেক্ষা করেন, বিষয়টি সরকার দেখছে।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, এতদিন ৩২টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে গ্রাহকের মোট পাওনা ৫৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৮টি প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের টাকা ফেরত দেয়নি।
Advertisement
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার বিষয়গুলো সামনে এলে ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে টাকা ফেরত দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হয়। তার আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বহুপক্ষীয় বৈঠক হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান এবং গেটওয়ে প্রতিষ্ঠানের যৌথ তালিকা অনুযায়ী টাকা ফেরতের প্রক্রিয়া শুরু করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
আরও পড়ুন>> ভ্যাট দায়মুক্তি পেতে যাচ্ছে ই-কমার্স
প্রথম বছর মানে ২০২২ সালজুড়ে টাকা ফেরত দেওয়ার কার্যক্রম ভালোভাবেই চলে। সেবার গ্রাহক ফেরত পান ৩১০ কোটি টাকা। কিন্তু দ্বিতীয় বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে ফেরত দেওয়া হয় ৭৭ কোটি টাকা। গ্রাহকরা এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে ফেরত পেয়েছেন ৩৮৭ কোটি টাকা। এখনো ১৪৪ কোটি টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় ঘুরছেন।
জানা যায়, এ পর্যন্ত গ্রাহকদের মোট টাকার মধ্যে কিউকম পরিশোধ করেছে ৩০৮ কোটি টাকা। এছাড়া উল্লেখযোগ্য আলিশা মার্ট ৪০ কোটি ও ইভ্যালি ১০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে।
এক-তৃতীয়াংশ অভিযোগ ইভ্যালির বিরুদ্ধে
ডিএনসিআরপি তথ্য বলছে, এতদিন যত অভিযোগ এসেছে, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ইভ্যালির বিরুদ্ধে। শুধু এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই অভিযোগের সংখ্যা ১১ হাজার ৯১টি, যা মোট অভিযোগের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এসব অভিযোগের মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৪ হাজার ৪৯৫টি অভিযোগ, যা ৪০ দশমিক ৫৩ শতাংশ। এখনো ৬ হাজার ৫৯৬টি অভিযোগ রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।
অনেক সময় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দিতে বলা হয়েছে। তবে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে ই-কমার্স লাগবে। এটির একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে ভূমিকা রেখেছে। কোভিডের সময় প্রয়োজনীয় পণ্য ঘরে পৌঁছে দিয়েছে।– ভোক্তার ডিজি এ এইচ এম সফিকুজ্জামান
জানতে চাইলে এ প্রতিষ্ঠানের সিইও রাসেল জাগো নিউজকে বলেন, ‘এসব অভিযোগের বেশিরভাগ পাওনা টাকা সংক্রান্ত। ইভ্যালি গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যে সমস্যাগুলো কমে যাবে।’
ইভ্যালি ছাড়া উল্লেযোগ্য সংখ্যক অভিযোগ রয়েছে ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে। তাদের বিরুদ্ধে ৬ হাজার ১৭টি অভিযোগ, যার মধ্যে মাত্র ৩৩টি অভিযোগের প্রতিকার পেয়েছেন গ্রাহক।
আরও পড়ুন>> চলতি মাসে গেটওয়ের টাকা ফেরত দিতে শুরু করবে ইভ্যালি: রাসেল
এছাড়া আলেশা মার্টের বিরুদ্ধে ২ হাজার ৫৫৬টি, কিউকমের বিরুদ্ধে ১ হাজার ২৯৫টি অভিযোগ রয়েছে ডিএনসিআরপিতে। এই দুই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও মামলার প্রতিকারের হার ২ শতাংশের নিচে।
এসব বিষয়ে ভোক্তা অধিকারের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ইভ্যালির অভিযোগের প্রতিকার দীর্ঘসসময় দেওয়া যায়নি। কারণ প্রতিষ্ঠানটির সিইও ২৭ মাস জেলে ছিলেন। এখন তাদের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অভিযোগ নিষ্পত্তি ও পাওনা পরিশোধ শুরু হবে।’
তিনি বলেন, ‘আলিশা মার্ট অভিযোগ নিষ্পত্তি ও টাকা ফেরতের বিষয়ে সহযোগিতা করছে না। সেজন্য এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। কিউকমের অভিযোগগুলো আমাদের ই-কমার্স নিয়ে তদারকি শুরুর আগের। সেজন্য নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। ৭০ কোটি টাকা পাওনার জন্য বেশিরভাগ অভিযোগ রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক হবে শিগগির। সেটা কীভাবে নিষ্পত্তি করা যায়, সেটা ঠিক করা হবে।’
অভিযোগ-পাওনা নিয়ে চলছে কার্যক্রম
এত অভিযোগ ও দেনা-পাওনার মধ্য দিয়ে দেশে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম চলছে। সম্প্রতি ইভ্যালি তাদের কার্যক্রম নতুন করে শুরু করায় এসব বিষয় বেশি আলোচনায় আসছে।
এসব প্রসঙ্গে সফিকুজ্জামান বলেন, ‘তারা (ই-কমার্স খাতের অভিযুক্তরা) যদি ব্যবসার মধ্যে না থাকে তবে তারা কীভাবে ভোক্তার টাকা পরিশোধ করবে। যারা দেশে রয়েছে, একটি পাওনা পরিশোধের প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে তারা সেটা করছে। যারা টাকা নিয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছে, কার্যক্রম বন্ধ, তাদের টাকা ফেরত আসছে না। সেটা আরও বড় সমস্যা।’
তিনি বলেন, ‘এসব প্রতিষ্ঠানকে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল বলে তারা পরিশোধ করেছে। কিন্তু ই-অরেঞ্জের মতো যেসব প্রতিষ্ঠানের কর্তারা পালিয়ে গেছেন, তাদের টাকা ফেরত আনা যাচ্ছে না। তারা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার করে ফেলেছে। তাদের আমরা ধরতেও পারছি না।’
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘অনেক সময় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দিতে বলা হয়েছে। তবে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে ই-কমার্স লাগবে। এটির একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে ভূমিকা রেখেছে। কোভিডের সময় প্রয়োজনীয় পণ্য ঘরে পৌঁছে দিয়েছে।’
তথ্য বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশে ই-কমার্সের বাজার প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের। দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ওপর। বাণিজ্যিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিচার্জ অ্যান্ড মার্কেট ডট কমের মতে, ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশে এর পরিমাণ হবে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার। দেশের সার্বিক খুচরা বিক্রির মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশের হিস্যা ই-কমার্সের।
এনএইচ/এএসএ/জেআইএম