আপনি যদি জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য চান, আপনি যদি চান আপনার জীবন সুন্দর হোক, আপনার রিটায়ারমেন্টটা খুবই স্মুথ হোক, তাহলে বয়স চল্লিশ হবার আগে আপনার কয়েকটা লক্ষ্য অর্জন করা উচিত এবং কিছু কাজ আপনার শুরু করা উচিত। কিছু মানুষ আছেন, যারা খুব আরাম আয়েসে দিন কাটান। দেখবেন, তাঁদের বিল পেমেন্ট করতে কোনো কষ্ট হচ্ছে না, তাঁদের বাড়ি ভাড়া দিতে তেমন কোনো ঝামেলা হচ্ছে না, তাঁরা পরিবারসহ খুব স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দেখবেন, তাঁদের ব্যাংকে সবসময় টাকা থাকছে, কারো কাছ থেকে তাঁরা ধার করছেন না, ঋণে নিমজ্জিত হচ্ছেন না। তাঁদেরকে দেখে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকা সুখী ও সফল মানুষ বলে মনে হচ্ছে। আপনিও যদি তাঁদের দলে যোগ দিতে চান, তাহলে বয়স চল্লিশ হবার আগেই আপনার কিছু দিকে নজর দেওয়া উচিত, কিছু লক্ষ্য অর্জন করা উচিত, কিছু বিষয় শুরু করা উচিত। আমরা দশটা লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি। আমরা মনে করি এই দশটি লক্ষ্য আপনার চিন্তাকে শাণিত করবে।
Advertisement
এক, প্রথমে আপনাকে ঋণ পরিশোধের দিকে যত্নবান হতে হবে, কারণ ঋণ হচ্ছে আর্থিক স্বাধীনতার পথ একটা বড় বাঁধা। আপনার ঋণ থাকলে সঞ্চয় শুরু করার বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া আপনার জন্য কঠিন হবে এবং সঞ্চয়কে বিনিয়োগে নিয়ে যাওয়া কষ্টকর হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনি ঋণ থেকে বেরিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করুন। আর, ঋণ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আপনাকে প্রথমে দুটো কাজ করতে হবে। একটা হচ্ছে- আপনার খরচকে কমাতে হবে; আর একটা হচ্ছে- ইনকামের পথ একটু বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। এই দুটো জিনিস যখন একসাথে করবেন তখন দেখবেন আপনার হাতে কিছু টাকা বাড়তি থাকছে, যে টাকাটা আপনি আপনার ঋণ পরিশোধে ব্যয় করতে পারবেন।
তবে ঋণ যে সব সময় খারাপ, ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয়। ভালো ঋণও আছে। যে ঋণ আপনি নিচ্ছেন শুধুমাত্র ভোগের জন্য, সে ঋণ আপনার কোনো টাকার ইনফ্লো তৈরি করছে না, সেই ঋণ আপনার জন্য খারাপ। কিন্তু, যে ঋণ আপনার জন্য কাজ করছে, আপনাকে ব্যাংকের সুদের চেয়ে বেশি আয় করে দিচ্ছে, সেই ঋণ আপনার জন্য খারাপ নয়। আমি বলবো ভোগের জন্য ঋণ করা থেকে বিরত থাকুন এবং যে খারাপ ঋণগুলো আপনার চলমান আছে সেই ঋণগুলো আগে পরিশোধ করুন।
দুই, একটি বাজেট তৈরি করুন। এমন একটি বাজেট তৈরি করুন যা দিয়ে আপনি চলতে পারেন। আমরা সবাই আমাদের আয়ের চেয়ে বেশি খরচ করতে অভ্যস্ত। কিন্তু, দীর্ঘ মেয়াদী আর্থিক সাফল্যের জন্য একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকা খুবই দরকার। এই লক্ষ্য আপনি কিভাবে অর্জন করতে পারেন? একটা সহায়ক টিপস আছে, যেটা হলো- এমন একটা বাজেট আপনি তৈরি করবেন যেখানে আপনি আপনার আয়ের ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ প্রয়োজনীয় খরচের জন্য বরাদ্দ রাখবেন, ১০ থেকে ২০ শতাংশ সঞ্চয়ের জন্য বরাদ্দ করবেন এবং বাকিটা আপনার শখ পূরণের জন্য ব্যবহার করবেন। (এটা ৫০ঃ৩০ঃ২০ অনুপাত রুলও হতে পারে, আপনার যেটা পছন্দ)। তবে, শুধু এটুকু নিশ্চিত করুন যে, এগুলো যেন বাস্তবসম্মত পরিমাণ হয়। আপনার চল্লিশ বছর বয়স হওয়ার আগে, প্রতি মাসে আপনার কি পরিমাণ ব্যয় করতে হবে সেই সম্পর্কে একটা ভালো ধারণা থাকতে হবে। আবার, আপনার ব্যয়ের খাতগুলো সম্পর্কেও আপনার খুব সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। মূল কথা হচ্ছে খুব চিন্তা করে একটা বাজেট তৈরি করুন এবং সেটা অনুসরণ করুন। সপ্তাহে রিভিউ এবং মনিটর করবেন যে, আপনি আপনার বাজেট মত চলছেন কিনা।
Advertisement
তিন, আপনার ইমারজেন্সি ফান্ড গঠন করা। আপনি তিন মাস থেকে সর্বোচ্চ দুই বছর আবশ্যিক খরচ চালানোর জন্য ইমারজেন্সি ফান্ড গঠন করবেন। কারণ, আপনার জীবনে যে কোনো সময় একটা ইমারজেন্সি সিচুয়েশন চলে আসতে পারে। আপনার চাকরি চলে যেতে পারে, আপনি অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন, আপনার আরও মেডিক্যাল ইমার্জেন্সি দেখা দিতে পারে। কত ধরনের সমস্যা জীবনে দেখা দিতে পারে। তার জন্যে আপনার ইমার্জেন্সি ফান্ড গঠন করা খুবই জরুরি। তাই প্রথমেই আপনার ইমার্জেন্সি ফান্ড গঠন করতে হবে। আপনি দেখবেন খেয়াল করে, আপনার আশপাশে বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে ইমারজেন্সি ফান্ডের ওরকম তাড়াহুড়ো নেই। কিন্তু, আপনি যদি আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে চান তাহলে আপনার এমারজেন্সি ফান্ড অবশ্যই থাকতে হবে।
চার, সঞ্চয় শুরু করুন। যারা এখনও সঞ্চয় শুরু করেননি, তাঁরা বাচ্চাদের এডুকেশনের জন্য সঞ্চয়, ছেলে মেয়েদের বিয়ের জন্য সঞ্চয়, রিটায়ারমেন্টের জন্য সঞ্চয়, ভবিষ্যৎ এ কোন সম্পত্তি কেনার জন্য সঞ্চয়- এগুলো দেরি না করে এক্ষুনি শুরু করা দরকার। যদি আপনি সবে চাকুরি শুরু করেন, তাহলে সঞ্চয় শুরু করুন। আর, যারা অনেক বছর চাকুরি করেছেন কিন্তু এখনো সঞ্চয় শুরু করেননি, তারাও এক্ষুণি সঞ্চয় শুরু করে দিন। যদি আপনার সঞ্চয় না থাকে, ভবিষ্যতে আপনি খুব বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারেন। তাই, এখনও যারা সঞ্চয় শুরু করেননি, তারা সঞ্চয় শুরু করুন। আবার বলছি, সঞ্চয় শুরু করুন।
পাঁচ, একটি বাড়ি বা ফ্লাট ক্রয় করা। যদি পারেন তাহলে চল্লিশের আগেই একটা বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনুন। আপনি যখন তরুণ থাকবেন, তখন ঝুঁকি নেওয়া আপনার জন্য সহজ হবে। কারণ, তখন আপনার হারানোর খুব বেশি কিছু থাকে না। কিন্তু, আপনার বয়স বাড়ার সাথে সাথে একটা বাড়ি বা ফ্লাট কেনা একটা প্রয়োজনীয়তা হয়ে উঠবে। একসময় আপনি বিয়ে করবেন, আপনার বাচ্চা হবে, এবং কোথাও আপনি স্থায়ী হতে চাইবেন। এক্ষেত্রে, আপনার নিজের একটা বাড়ি থাকলে সেটা আপনাকে নিরাপত্তার অনুভূতি প্রদান করবে। এটা এমন কিছু, যা আপনি মূল্য দিয়ে পরিমাপ করতে পারবেন না। তাই, আপনার বয়স চল্লিশ হওয়ার আগে আপনার নিজের বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনার জন্য আপনার যথেষ্ট অর্থ সঞ্চয় করা উচিত। আমাদের পরামর্শগুলো ভালভাবে মেনে চললে আপনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করবেন না।
ছয়, জীবন বীমা করা। প্রিয়জনকে আর্থিকভাবে রক্ষা করতে চাইলে জীবন বীমা করা দরকার। আপনার সংসারে যারা আছে আপনার প্রিয়জন, আত্মীয়-স্বজন তাঁদেরকে আর্থিকভাবে সুরক্ষা দিতে জীবন বীমা করাটা খুব জরুরি। জীবন বীমা হলো এক ধরনের সঞ্চয় পরিকল্পনা, যা অল্প বয়সে আপনি মারা গেলে আপনার পরিবারকে আর্থিকভাবে রক্ষা করবে। আপনি যদি চল্লিশ বছর বয়সের আগে মারা যান, আপনার পরিবার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পাবে, যা তাঁদের প্রতিদিনের খরচ চালাতে সহায়তা করবে। আপনি যখন তরুণ, আপনি হয়তো ভাববেন যে আপনার মৃত্যু এত তাড়াতাড়ি হবেনা কিন্তু সত্য হচ্ছে, যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটতে পারে। আপনি একটা গাড়ি দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হতে পারেন, বা আপনার ঘর পুড়ে যেতে পারে। আপনার বার্ষিক আয়ের কমপক্ষে দশ গুণ মেয়াদী একটি জীবন বীমা পলিসি কিনুন। এটি নিশ্চিত করবে যে, যদি আপনার সাথে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে তবে আপনার পরিবার আপনাকে ছাড়াই টিকে থাকতে পারবে।
Advertisement
সাত, উইল তৈরি করা। দেখুন, বয়স চল্লিশ হওয়ার আগেই আপনি একটা উইল তৈরি করতে পারেন। আপনার উইল হল একটি আইনি নথি, যা আপনার মৃত্যুর পর কিভাবে আপনার সম্পদ বিতরণ করা হবে তার রূপরেখা দেয়। যদি উইল ছাড়া মারা যান, তাহলে আপনি যে দেশে বাস করেন, সেই দেশের আইনের ভিত্তিতে আপনার সম্পদ বণ্টন করা হবে। এর মানে হলো যে, আপনার যা কিছু সম্পদ আছে, সেটা আপনার প্রিয়জন বা যাদের কাছে আপনি দিতে চান তারা নাও পেতে পারে। চল্লিশের মধ্যে ন্যূনতম একটি সাধারণ উইল আপনার করতেই হবে, যা আপনার সম্পত্তির অর্ধেক অন্তত কাভার করে, যদি আপনি কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনার ক্ষেত্রে আপনার সম্পদ ও আপনার পরিবারকে রক্ষা করতে চান।
আট, অবসর জীবনের জন্য সঞ্চয় শুরু করুন। অবসর আপনার জীবনের এমন একটা সময়, যখন আপনি আপনার শ্রমের ফল উপভোগ করতে চান, আপনি চিরকাল কাজ করতে চান না। তাই, আপনাকে পর্যাপ্ত পরিমান অর্থ সঞ্চয় করতে হবে, যাতে আপনি আপনার অবসর জীবন নিজের ইচ্ছা মতো কাটাতে পারেন। আপনার প্রতি মাসের স্যালারির অন্তত দশ শতাংশ একটি অবসর একাউন্টে জমা করতে হবে। চল্লিশ বছর হওয়ার আগে আপনার বার্ষিক আয়ের কমপক্ষে ছয় থেকে আট গুন সঞ্চয় করা উচিৎ। এই সঞ্চয় এটা নিশ্চিত করবে যে, আপনি যখন চান, আপনি আরামে অবসর নিতে পারেন। তাই, দেরি না করে যারা এখন সঞ্চয় শুরু করেননি তারা এখুনি শুরু করুন।
নয়, বিনিয়োগ করা। দেখুন, সঞ্চয় শুরু না করলে বিনিয়োগের প্রশ্ন আসে না। শুধু সঞ্চয় করলেন, কিন্তু সেই সঞ্চয়কে যদি আপনি বিনিয়োগে টার্ন না করেন, তাহলে আপনার টাকা বাড়তে অনেক সময় লাগবে। বিনিয়োগ করলে আপনার আর্থিক গ্রোথ অনেক বেশি হতে পারে। আপনি স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করতে পারেন, সরকারি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে পারেন, আপনি কোনো জমিতে টাকা বিনিয়োগ করতে পারেন। আপনার বয়স চল্লিশ বছর হওয়ার আগে আপনি ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ করতে পারেন; কিন্তু ঝুঁকি নিতে হবে হিসাব করে। ঝুঁকি এড়ানোর জন্য আপনি কোন বিনিয়োগ পরামর্শকের সাথে কথা বলতে পারেন। তাছাড়া, আপনি বিনিয়োগ সংক্রান্ত পড়াশুনা করে নিজে আর্থিক জ্ঞান অর্জন করতে পারেন। ইন্টারনেটে অনেক ইনফরমেশন আছে। এছাড়াও ফিনফাক্টস (finfacts) নামের ইউটিউব চ্যানেল দেখতে পারেন সেখানে শত শত ভিডিও আছে। আপনি সেগুলো দেখে, পড়ে এবং নিজের বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে নিজের বুঝমত নিজে বুঝে বিনিয়োগ করতে পারেন।
দশ, আর্থিকভাবে স্বাধীন হয়ে উঠুন। আর্থিক স্বাধীনতা হল, পর্যাপ্ত পরিমান অর্থ সঞ্চয় করার একটা অবস্থা, যাতে আপনাকে আবার কাজ করতে না হয়। এর অর্থ হল যে, আপনি কাজ থেকে আয় করার পরিবর্তে আপনার সঞ্চয় ও বিনিয়োগের উপর নির্ভর করতে পারবেন। আপনি যখন চল্লিশ বছর বয়সে উত্তীর্ণ হবেন, তখন আপনার বিনিয়োগ থেকে যে মুনাফা অর্জন করবেন, সেটা থেকে আপনি বাঁচতে সক্ষম হবেন। আপনি যদি আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে চান, তাহলে আপনার চল্লিশ বছর হওয়া পর্যন্ত আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে না। অনেকেই ২৫ বা ৩০ বছর বয়সেই আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে যান। উদ্দেশ্য হল, পর্যাপ্ত অর্থ উপার্জন করে আর্থিকভাবে স্বাধীন হওয়া যাতে আপনাকে সারাজীবন কাজ করতে না হয়। আমরা কে না চাই আর্থিকভাবে স্বাধীন হতে? আপনারা যদি আমাদের এই পরমর্শগুলো মেনে চলেন, এবং এগুলোর দিকে নজর দেন, তাহলে আপনার আর্থিক স্বাধীনতার পথে কেউ বাধা হতে পারবে না। এইচআর/এএসএম