শিক্ষা

মন্ত্রীদের শুভেচ্ছায় বিজ্ঞাপনের ‘ছড়াছড়ি’, তোপের মুখে চবি ভিসি

অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার। তার পদত্যাগের দাবিতে টানা আন্দোলন কর্মসূচি করছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক সমিতির নেতারাও। এরই মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্বে এসেছে পরিবর্তন। ডা. দীপু মনি শিক্ষা মন্ত্রণালয় হারানোর পর উপাচার্যও যেন মাথার ওপর থেকে ছায়া হারিয়ে ফেলেছেন। এখন চট্টগ্রামের সন্তান নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও নতুন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে মরিয়া অধ্যাপক শিরীণ আখতার।

Advertisement

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন মন্ত্রিসভার শপথের পরদিনই ঢাকায় নতুন শিক্ষামন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে গেছেন চবি উপাচার্য। তাতেও ঠিক স্থির থাকতে পারেননি তিনি। এবার দুই মন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বুধবার (১৭ জানুয়ারি) দেশের শীর্ষ অধিকাংশ পত্রিকায় চার কলামজুড়ে রঙিন বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। তাতে নিজের নাম-পরিচয় বড় হরফে ব্যবহার করেছেন উপাচার্য শিরীণ আখতার। তাতেই বেঁধেছে বিপত্তি।

জাতীয় অন্তত ১২ থেকে ১৩টি এবং বেশ কিছু স্থানীয় পত্রিকায় এ বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে এতে প্রায় খরচ পড়বে ৫০ লাখ টাকা। বিজ্ঞাপনে উপাচার্যের নাম রাখা এবং তা বড় হরফে দেওয়ার ব্যাপারে অধ্যাপক শিরীণ আখতার খোদ নির্দেশনা দিয়েছেন

বিষয়টি নজরে আসার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অমান্য ও বিজ্ঞাপনী খরচের উৎস জানতে চেয়ে চিঠি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। বুধবার ইউজিসির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের উপ-পরিচালক মো. গোলাম দস্তগীর চিঠিতে সই করেছেন।

Advertisement

এতে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নবনিযুক্ত দুই মন্ত্রীকে ডেইলি স্টার, ডেইলি সান, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ডেইলি অবজারভার, বাংলাদেশ প্রতিদিন, কালেরকণ্ঠ, সমকালসহ একাধিক সংবাদপত্রে চার কলাম বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এ বিজ্ঞাপন ঠিক কতটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এবং এর ব্যয় কোন খাত থেকে নির্বাহ করা হবে, তার তথ্য দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো।

এদিকে, এ ধরনের বিজ্ঞাপন দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাও অনুসরণ করা হয়নি বলে উল্লেখ করেছে ইউজিসি। এজন্য কারণ দর্শাতে অনুরোধ জানিয়ে চিঠিতে বলা হয়, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সেবা শাখা থেকে গত ১২ জানুয়ারি জারিকৃত নোটিশের নির্দেশনা (স্মারক: ৩৭.০০.০০০০.০৬২.১১.০০১.১৮.২১) কেন অনুসরণ করা হয়নি, সে বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তব্য আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে প্রেরণের অনুরোধ করা হলো।’

উপাচার্য যেকোনোভাবে তার অবস্থান ধরে রাখার জন্য যা করার দরকার তা-ই করে বেড়াচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, এটা হচ্ছে তার বাড়তি অবৈধ আয়-রোজগারের উৎসব। আর নিয়োগ বাণিজ্য তো সঙ্গে রয়েছেই। অতিউৎসাহী হয়ে উনি যা করে বেড়িয়েছেন, তা কোনোভাবেই পারেন না

বিজ্ঞাপনগুলোতে চবি উপাচার্যের নাম ব্যবহার করে বলা হয়েছে, ‘বীর চট্টলার দুই কৃতি সন্তান ড. হাছান মাহমুদ এমপিকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী এমপিকে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করায় বঙ্গবন্ধু তনয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। আমি মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীকে শুভেচ্ছা এবং প্রাণঢালা অভিনন্দন জ্ঞাপন করছি। আপনাদের সুযোগ্য নেতৃত্বে স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১ রূপকল্প বাস্তবায়নের পথে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। আমি আপনাদের সুস্বাস্থ্য, দীর্ঘায়ু ও সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ কামনা করছি।’

Advertisement

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী জাগো নিউজকে বলেন, ‘এর আগে আমরা বহু অভিযোগ করেছি। কেউ সেভাবে আমাদের কথাগুলো শোনেননি। এরপরই কিন্তু আন্দোলনে গিয়েছি। দুজনের পদত্যাগ চেয়েছি, উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমান উপাচার্য যেকোনোভাবে তার অবস্থান ধরে রাখার জন্য যা করার দরকার তা-ই করে বেড়াচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, এটা হচ্ছে তার বাড়তি অবৈধ আয়-রোজগারের উৎসব। আর নিয়োগ বাণিজ্য তো সঙ্গে রয়েছেই। এখন তার মেয়াদকালের একেবারে শেষ পর্যায়ে মন্ত্রীর নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও অতিউৎসাহী হয়ে উনি (উপাচার্য) যা করে বেড়িয়েছেন, তা কোনোভাবেই উনি পারেন না।’

চবির এ শিক্ষক নেতা আরও বলেন, ‘এ বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি যে উনি করলেন, এটার ব্যয় কোন খাত থেকে দিলেন? এটার কোনো খাত আছে কি না, তা আমাদের জানা নেই। যদি বিজ্ঞাপনটা দিতেই হয়, সেটা প্রতিষ্ঠানের নামে যেতে পারতো। কিন্তু উনি নিজের নাম ব্যবহার করে নিজের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচে বিজ্ঞাপন দিয়ে বেড়াচ্ছেন। এটা উনি কোনোভাবেই করতে পারেন না। আমরা মনে করি, উনি এটা বেআইনিভাবে করেছেন। বড় বড় এত পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়ার নিয়ম বা রীতি কোথায় আছে, তা-ও আমরা জানি না।’

ইউজিসির চিঠি ও শিক্ষক সমিতির আপত্তির বিষয়ে জানতে উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। একাধিকবার তার অফিসিয়াল মোবাইল ফোন নম্বরে কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে এসএমএসে পরিচয় দিয়ে প্রশ্ন পাঠানো হলেও দুই ঘণ্টায়ও কোনো উত্তর মেলেনি।

বিজ্ঞাপন ব্যয়ের খাত কী হবে, তা জানতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কে এম নূর আহমেদকে একাধিকবার ফোনকল করা হয়। তিনিও কল রিসিভ করেননি। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ফোনকল দেওয়া হলে তিনি ‘এ প্রসঙ্গে এখন নয়, পরে কথা বলবেন’ বলে জানান।

যদি বিজ্ঞাপন দিতেই হয়, সেটা প্রতিষ্ঠানের নামে যেতে পারতো। কিন্তু উনি নিজের নাম ব্যবহার করে নিজের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচে বিজ্ঞাপন দিয়ে বেড়াচ্ছেন। এটা উনি কোনোভাবেই করতে পারেন না। আমরা মনে করি, উনি এটা বেআইনিভাবে করেছেন। বড় বড় এত পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়ার নিয়ম বা রীতি কোথায় আছে, তা-ও আমরা জানি না

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দুজন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে জানিয়েছেন, জাতীয় অন্তত ১২ থেকে ১৩টি এবং বেশ কিছু স্থানীয় পত্রিকায় এ বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে এতে প্রায় খরচ পড়বে ৫০ লাখ টাকা। বিজ্ঞাপনে উপাচার্যের নাম রাখা এবং তা বড় হরফে দেওয়ার ব্যাপারে অধ্যাপক শিরীণ আখতার খোদ নির্দেশনা দিয়েছেন।

২০১৬ সালের ২৮ মার্চ চবির উপ-উপাচার্য হন অধ্যাপক শিরীণ আখতার। ২০১৯ সালের ১৩ জুন তিনি উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়োগ পান। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ৩ নভেম্বর চবি উপাচার্যের পূর্ণ দায়িত্ব পান। নিয়মিত চাকরির বয়সপূর্তিতে ২০২১ সালের ২৯ এপ্রিল অবসরে যান তিনি।

শিক্ষকতা থেকে শিরীণ আখতারের অবসর গ্রহণের দিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব পালন করেন তৎকালীন কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মহীবুল আজিজ। তবে একই দিন (২০২১ সালের ২৯ এপ্রিল) বিকেলে পুনরায় উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন শিরীণ আখতার। সেসময় পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তাকে উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। সেই থেকে উপাচার্য পদে বহাল অধ্যাপক শিরীণ আখতার।

এএএইচ/এমকেআর/এমএস