শীত এলে প্রায়ই বায়ুদূষণে বিশ্বের শীর্ষস্থান দখল করে ঢাকা। ২০২৩ সাল ছিল আট বছরের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর বছর। এর পেছনে অন্যতম দায় ধুলার। এ দূষণ রোধে সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে সেগুলো দূষণ রোধ করতে পারছে না। ফলে দূষিত শহরের তালিকায় প্রায়ই শীর্ষস্থানে থাকছে রাজধানী ঢাকা।
Advertisement
পরিবেশবাদীরা বলছেন, ধুলার দূষণে রোগবালাই থেকে শুরু করে পোশাক-পরিচ্ছদ, আসবাবপত্র, বাসাবাড়ি, খাবার-দাবার সবকিছুতেই ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন নগরবাসী।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগরের বায়ুদূষণ রোধে সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও সরকারের মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয়হীনতা রয়েছে। বিশেষ করে ধুলাদূষণের প্রধান উৎস নির্মাণকাজ ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলেও সেগুলো মানছে না সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এছাড়া দূষণ রোধে সিটি করপোরেশন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সমন্বয় নেই। ফলে শহরে মারাত্মক আকার ধারণ করছে ধুলা দূষণ।
প্রথম সর্বোচ্চ উৎস নির্মাণকাজ, দ্বিতীয় কারণ হলো শিল্পকারখানা, তৃতীয় সর্বোচ্চ হলো ফিটনেসবিহীন যানবাহন। বর্তমানে শঙ্কা হলো নির্মাণবিধি না মেনে বড় বড় মেগা প্রজেক্ট, রাস্তা কাটাকাটির কারণে ধুলাবালি বেশি হচ্ছে। সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর যদি নজরদারি রাখতো তাহলে এ উৎসগুলো থেকে দূষণ হতো না।
Advertisement
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ারের বাতাসের মানসূচক (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স-একিউআই)-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি জানুয়ারির মোট ৯ দিন রাজধানীর বাতাসের মান দুর্যোগপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছেছিল যা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর মধ্যে গত ৬ জানুয়ারি থেকে টানা তিনদিন সকালে বায়ুদূষণে শীর্ষে ছিল ঢাকা।
আরও পড়ুন>> আর কতদিন লিখতে হবে ‘ঢাকার বায়ু আজ খুবই অস্বাস্থ্যকর’
দূষণবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যাপসের গবেষণা বলছে, ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য সমন্বয়হীন রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজ ৩০ শতাংশ দায়ী। ঢাকার বায়ুদূষণে শিল্পায়নের প্রভাব ও আশপাশের ইটভাটার পাশাপাশি নির্মাণ স্থান হলো ধুলা দূষণের প্রধান উৎস। এছাড়া নির্মাণসামগ্রী আনা-নেওয়ার সময় বড় বড় মালবাহী গাড়িতে ছাউনি না থাকায় ছড়াচ্ছে ধুলা।
ধুলাবালি নিবারণে ঢাকা উত্তর সিটি অত্যাধুনিক স্প্রে ক্যাননের মাধ্যমে পানি ছিটাচ্ছে। নির্মাণাধীন সড়কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বেশি পরিমাণ পানি ছিটানো হয়। নির্মাণকাজ চলাকালীন ঠিকাদাররা যেন মাটি ঢেকে রেখে কাজ করে সে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। নির্মাণসামগ্রী যত্রতত্র রেখে পরিবেশ দূষণ করলে ডিএনসিসির ম্যাজিস্ট্রেট আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছেন। হয়তো প্রয়োজনের তুলনায় সেটি কম হচ্ছে।
Advertisement
ক্যাপসের চেয়ারম্যান ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথম সর্বোচ্চ উৎস নির্মাণকাজ, দ্বিতীয় কারণ হলো শিল্প কারখানা, তৃতীয় সর্বোচ্চ হলো ফিটনেসবিহীন যানবাহন। বর্তমানে শঙ্কা হলো নির্মাণবিধি না মেনে বড় বড় মেগা প্রজেক্ট, রাস্তা কাটাকাটির কারণে ধুলাবালি বেশি হচ্ছে। সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর যদি নজরদারি রাখতো তাহলে এ উৎসগুলো থেকে দূষণ হতো না।
রাজধানীতে সারা বছরই ওয়াসা, সিটি করপোরেশনসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ভবন নির্মাণ ও রাস্তা মেরামতের কাজ চলে। পাশাপাশি গত কয়েক বছরে সরকারের বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ চলমান। এসব নির্মাণ কাজের কারণে সবচেয়ে বেশি ধুলা দূষণ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে যে কোনো ধরনের নির্মাণকাজ করার সময় বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরের সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে এসব নিয়ম পালন করতে তেমন দেখা যায় না।
পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী, রাস্তা ও ভবন নির্মাণ বা মেরামতের সময় ধুলাবালি যেন বাতাসের সঙ্গে মিশে না যায়, সেজন্য নির্মাণ স্থানে যথাযথ ছাউনি বা ঢেকে রাখার নির্দেশনা রয়েছে। একই সঙ্গে ভেতর ও বাইরে নির্মাণসামগ্রী (মাটি, বালি, রড, সিমেন্ট ইত্যাদি) যথাযথভাবে ঢেকে রাখা এবং দিনে কমপক্ষে দুবার পানি ছিটানোর কথা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এসব নির্দেশনা অনুসরণ না করায় রাজধানীতে ধুলার পরিমাণ বাড়ছে।
২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে হাইকোর্ট বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে যে ৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তার মধ্যে নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, পানি ছিটানো এবং খোঁড়াখুঁড়ির ক্ষেত্রে দরপত্রের শর্ত মানার বিষয়গুলো ছিল। কিন্তু সেগুলো মানা হয় না। মানাতে তেমন কোনো পদক্ষেপও দেখা যায় না।
দূষণ রোধে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন পানি ছিটানোর স্পেশাল ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালু করলেও সেটি ফলপ্রসূ হচ্ছে না। উত্তর সিটির বাসিন্দারা বলছেন, সব এলাকায় পানি ছিটানো হয় না। যে পরিমাণ পানি ছিটানো হয় তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য।
মালিবাগ রেলগেট এলাকার বাসিন্দা আব্দুল কাদের জাগো নিউজকে বলেন, আমি এদিকে কখনো পানি ছিটাতে দেখিনি। এত পরিমাণ ধুলা বাতাসে উড়ছে, মাস্ক না পরলে মুখে হাত দেওয়া ছাড়া বের হতে পারি না। গত তিন মাস থেকে এখান দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে, এ কারণে ধুলা আরও বেড়েছে।
আরও পড়ুন>> ঢাকায় এখন ধুলার রাজত্ব
একই পরিস্থিতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকাতেও। এ এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ধুলাবালি থাকে। কিন্তু এসব দূষণ নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের উল্লেখযোগ্য কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না। শীত মৌসুমে তারা ধুলাবালিকে সবচেয়ে ভোগান্তি হিসেবে দেখছেন।
মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যানের বাসিন্দা রাকিব জাগো নিউজকে বলেন, আমি ব্যবসা করি রায়েরবাজারে। প্রতিনিয়ত বেড়িবাঁধ দিয়ে চলাফেরা করি। এ এলাকায় এত পরিমাণ ধুলাবালি, প্রায়ই সর্দি-কাশিতে ভুগছি। এ রাস্তাটি গত দেড় বছর যাবৎ সংস্কার করা হচ্ছে। বর্ষাকালে একটু ভালো থাকি, কিন্তু শীত-গরম দুই মৌসুমেই খুব ভোগান্তির মধ্যেই চলাচল করছি।
ক্যাপসের গবেষণা বলছে, সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে যে এলাকায় পানি ছিটানো হচ্ছে দুই ঘণ্টা পর সেখানের দূষণ পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ধুলা দূষণ রোধে সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়কে গুরুত্ব দিচ্ছেন ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামরুজ্জামান।
তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের উচিত নির্মাণকাজে একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া। যারাই ঢাকা শহরের নির্মাণ কাজের সঙ্গে যুক্ত তাদের নির্দিষ্ট বিধি অনুযায়ী কাজ শেষ করতে হবে। ঢাকা শহরে ১০টি মন্ত্রণালয় ও ৩০-৩৫টি সংস্থা বায়ুদূষণের সঙ্গে যুক্ত। এক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর বা সিটি করপোরেশন এটার টেকসই সমাধান করতে পারবে না। এজন্য সর্বোচ্চ আইন প্রয়োগের মাধ্যমে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে কাজ করতে হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ধুলাবালি নিবারণে ঢাকা উত্তর সিটি অত্যাধুনিক স্প্রে ক্যাননের মাধ্যমে পানি ছিটাচ্ছে। নির্মাণাধীন সড়কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বেশি পরিমাণ পানি ছিটানো হয়। নির্মাণকাজ চলাকালীন ঠিকাদাররা যেন মাটি ঢেকে রেখে কাজ করে সে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। নির্মাণসামগ্রী যত্রতত্র রেখে পরিবেশ দূষণ করলে ডিএনসিসির ম্যাজিস্ট্রেট আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছেন। হয়তো প্রয়োজনের তুলনায় সেটি কম হচ্ছে।
আরও পড়ুন>> ঢাকার বায়ু আজ ‘অস্বাস্থ্যকর’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, বায়ুদূষণ আমাদের অপরিকল্পিত উন্নয়নের একটি বাই-প্রোডাক্ট। নগর পরিকল্পনায় যত ধরনের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড আছে তার সব প্রভাব বায়ুদূষণের ওপর পড়ছে। সরকারি-বেসরকারিভাবে যে অবকাঠামো নির্মাণ চলছে, কোথাও স্ট্যান্ডার্ড মানা হচ্ছে না। ঢাকা ও আশপাশে যে শিল্পায়ন হচ্ছে, এর ফলে বায়ুদূষণ বেশি হচ্ছে। কিন্তু এর বিপরীতে বায়ুদূষণ কমানোর জন্য একটা ব্যালেন্সিং ফ্যাক্টর হিসেবে শহরে যদি গাছপালা থাকে, সবুজায়ন হয়, তাহলে একটা ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। কিন্ত মাত্রারিক্ত নগরায়নের কারণে এটিকে আমরা ধ্বংস করে দিয়েছি।
প্রশাসনকে দায়ী করে এ পরিকল্পনাবিদ বলেন, যাই হচ্ছে, সবকিছুর জন্য আমাদের নীতিমালা আছে, আইন আছে। কিন্তু এগুলো প্রতিফলনের জন্য কোনো মনিটরিং হচ্ছে না। এক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন বা সংশ্লিষ্টরা শুধু নির্দেশনা মানছে না বলে দায় এড়াচ্ছে। এসব নির্দেশনা মানাতে আমাদের রাষ্ট্র ব্যর্থ। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতাও নেই। যারাই কনস্ট্রাকশনের কাজ করছে, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করছে, নীতিমালা না মানলে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ ছাড়া নগরবাসীর এ ভোগান্তি কমানো সম্ভব হবে না।
পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা বিভাগের ডিরেক্টর জিয়াউল হক জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকায় বায়ুদূষণ না কমার উল্লেখযোগ্য কারণ হলো ৩০-৩৫ শতাংশ দূষণ আসে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে। এখানে আমাদের কিছু করার থাকে না। কিন্তু বাকি ৬৫ শতাংশ আমাদের। এখন সরকারিভাবে যে প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করে, তাদের তো নির্দেশনা মানতে হবে। যারা বেসরকারিভাবে ঘরবাড়ি বানায়, তাদেরও মানতে হবে। নিয়ম হলো যেখানে রাস্তা কাটা হবে এটা ঢেকে রাখতে হবে। যেন ধুলাবালি না বের হয়। সবাই মিলে যদি এসব বিষয়ে খেয়াল রাখি তাহলে দূষণ রোধ করা সম্ভব হবে।
জিয়াউল হক আরও বলেন, নির্দেশনাগুলো প্রতিফলিত হচ্ছে না দেখেই আমরা এগোতে পারছি না। নির্দেশনাগুলা বাস্তবায়ন করাটা আমাদের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অনুযায়ী জাতীয় পর্যায়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব স্যারকে সভাপতি করে একটি কমিটি হয়েছে সেখানে এ ব্যাপারে দুটি মিটিংও হয়েছে।
আরএএস/এমএইচআর/এএসএম