কৃষি ও প্রকৃতি

শীত-কুয়াশার তীব্রতায় বাড়ছে কৃষকের দুশ্চিন্তা

তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে নষ্ট হচ্ছে বোরোর বীজতলা। নষ্ট হচ্ছে কৃষকের শিম, লাউ, করলা, মিষ্টি কুমড়া, আলু, শাক-সবজিসহ বিভিন্ন কৃষি ক্ষেত। উল্লেখ্য, মৌসুমের এ সময়ে মাঠে শীতকালীন ফসল আলু, টমেটো, বেগুন, মরিচ, সরিষা, শিমসহ বিভিন্ন জাতের সবজি রয়েছে। এছাড়া কোথাও কোথাও বোরোর বীজতলা রয়েছে আবার কোথাও বোরো চারা রোপণ করা হয়েছে। চলমান শৈত্যপ্রবাহে বোরো বীজতলা ও রোপা ধানের কোল্ড ইনজুরি এবং আলুর লেটব্লাস্টইট রোগে আক্রান্ত হওয়ার দুশ্চিন্তায় কৃষক ও মাঠ পর্যায়ের কৃষিবিদরা। এ ধরনের আবহাওয়া গম উৎপাদনে সহায়ক হলেও বৃষ্টি নামলে ছত্রাকবাহী ‘ব্লাস্ট’ রোগের সংক্রমণ ছড়াতে পারে। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাপমাত্রা ৮-৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে হ্রাস পেয়েছে। ফলে রোপা বোরোর বীজতলা এবং আলু নিয়ে কৃষকের দুশ্চিন্তা ক্রমশ বাড়ছে। বোরো বীজ রোপণে ক্ষতির আশঙ্কা না থাকলেও বীজতলা নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তা থেকেই যাচ্ছে। পাশাপাশি আলু নিয়েও শঙ্কা বাড়ছে কৃষকের।

Advertisement

অপরদিকে, গত কয়েকটি বছর ছত্রাকবাহী ব্লাস্ট রোগের কারণে সরকার কিছু এলাকায় গম আবাদ নিরুৎসাহিত করলেও এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। দুর্যোগ কাটিয়ে চলতি মৌসুমে গম আবাদ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে নষ্ট হচ্ছে বোরোর বীজতলা। বিভিন্ন ধরনের ছত্রাকনাশক ছিটিয়েও তেমন ফল পাওয়া যাচ্ছে না। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে শৈত্যপ্রবাহ চলছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। শস্যভান্ডারখ্যাত উত্তরাঞ্চলে তাপমাত্রা তলানিতে নামতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় বীজতলা মরে বোরোর চারা সংকট দেখা দেওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কৃষকরা বলছেন, তারা বীজতলায় ছত্রাকনাশক ছিটাচ্ছেন। কুয়াশার হাত থেকে বাঁচাতে বীজতলা পলিথিন দিয়ে ঢেকেও রাখছেন। তীব্র শীত-কুয়াশার কারণে বোরো নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। শীত বেশি হলে বোরো বীজতলাতেও সমস্যা হয়।

আরও পড়ুন: মিরসরাইয়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দ্বিগুণ সরিষা চাষ 

শীতে বিশেষ করে কুয়াশা বাড়লে আলুর মড়ক দেখা দেয়। ‘আলুগাছ হ্যাল সবার (ঠান্ডা সহ্য করতে) পারে না’। তাই কুয়াশা ঝরলে আমাদের চিন্তা হয়। শুধু আলুই নয়, টমেটোর ক্ষেতেও মড়ক দেখা দেয়। কয়েক দিনের ঘন কুয়াশা ও তীব্র শীতে বগুড়া ও জয়পুরহাটে আলু চাষিদের মধ্যে তৈরি হয়েছে শঙ্কা। বিঘার পর বিঘা জমির আলুর পাতা কুঁকড়ে যাওয়াসহ পাতা ও কাণ্ড পচে যেতে শুরু করেছে। চারদিন পর পর তাঁরা জমিতে ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করছেন। আলু রোপণের দেড় থেকে দুই মাস পর কাণ্ড ও পাতা এই রোগে আক্রান্ত হয়ে গাছ মরে যাচ্ছে। লেট ব্লাইট বা মড়ক নামের এই পচন রোগ থেকে রক্ষা পেতে জমিতে সপ্তাহে অন্তত একদিন কীটনাশক ছিটাতেই হবে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।

Advertisement

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েকদিনে রংপুর অঞ্চলে শীতের তীব্রতা বেশ বেড়েছে। দিনের বড় অংশই কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকায় ক্ষেতে ছত্রাকের আক্রমণ দেখা দিয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় চারা হলুদাভ হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। আবার অনেকের বীজতলায় চারা পোড়া ও ঝলসানো রোগও দেখা দিয়েছে। জমিতে ১০-১৫ দিন বয়সী চারাগুলো সাদা ও লালচে রং ধরে মারা যাচ্ছে্।

আরও পড়ুন: সরিষা ক্ষেতে মৌ-বক্স, আহরণ হবে দেড়শ টন মধু 

তবে চলমান শীতে বীজতলা সম্পূর্ণ নষ্ট হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্ট কৃষি অধিদপ্তর। তাদের মতে, ‘বীজতলা সম্পূর্ণ নষ্ট হওয়ার মতো শীতের তীব্রতা এখনো হয়নি। যেসব বীজতলা আক্রান্ত হয়েছে; সেগুলো কিছুটা তাপমাত্রা বাড়লেই ঠিক হয়ে যাবে।’ কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে যে পরিমাণ ধান উৎপাদন হয় তার সিংহভাগই বোরো। এ সময়ের ধানের ফলনও তুলনামূলক বেশি। যেখানে প্রতি হেক্টর জমিতে আউশ ও আমনের ফলন যথাক্রমে ২.৫৫ ও ২.৫০ মেট্রিক টন, সেখানে বোরোর ফলন ৪ মেট্রিক টনেরও বেশি। বোরোর উৎপাদন কমলে সেটা পুরো বছরের সার্বিক উৎপাদনে দারুণ নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই বিষয়টি অধিক গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) কর্মকর্তারা।

উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা বলেন, ‘শৈত্যপ্রবাহের সময় বাড়তি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। তা না হলে এর প্রভাব সামগ্রিক বোরো উৎপাদনে পড়বে। মাঠপর্যায়ে শৈত্যপ্রবাহের প্রভাব থেকে বাঁচতে বীজতলায় নলকূপের পানি দিয়ে তা ধরে রাখতে হবে। এছাড়া বীজতলা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা যেতে পারে। শিশির পড়লে তা ঝরিয়ে দিতে হবে। এর সঙ্গে ছত্রাকনাশক এবং প্রতিশতক জমিতে ২৮০ গ্রাম করে ইউরিয়া সার দিতে হবে বলে নির্দেশনা প্রদান করেন।

Advertisement

আরও পড়ুন: মিরসরাইয়ে ফুলকপি চাষে লাভবান কৃষকেরা 

চলতি মৌসুমে আলুর উৎপাদন গত বছরের তুলনায় বৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এদিকে সাম্প্রতিককালে দেশের পোল্ট্রি ফিডসহ বিভিন্ন সম্পূরক খাদ্য হিসেবে ভুট্টার ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে এর আবাদও বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত বছর দেশে হাইব্রিড, উফশী ও স্থানীয়সহ বোরো ধানের উৎপাদন ছিল হেক্টর প্রতি ৩.৬৫ টন। এবার ৪.২৪ টনে পৌঁছাতে কাজ করছে ডিএই। গত বছর গমের উৎপাদন হেক্টর প্রতি ৩.৬৪ টন থেকে চলতি মৌসুমে ৩.৬৫ টনে পৌঁছাতে চাচ্ছে সরকার। ভুট্টার উৎপাদনও হেক্টর প্রতি ১০.৩৬ টনে পৌঁছার লক্ষ্যে কাজ করছে ডিএই। আলুর ক্ষেত্রেও গত বছরের ২৩.৫০ টন থেকে হেক্টর প্রতি ২৪.২৭ টন নির্ধারণ করা হয়েছে।

এসইউ/জিকেএস