উপনিবেশ বিরোধী লড়াই সংগ্রামে বাঙালির বৈপ্লবিক সংগ্রাম বা সশস্ত্র সংগ্রাম এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বিপ্লবীদের রক্তের ইতিহাসে লেখা হয়েছে অবিভক্ত ভারতের ইতিহাস। যে বিপ্লব সংগ্রাম বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের অগ্রদূত হয়ে আছে।
Advertisement
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন শোষণ থেকে মুক্তি পেতে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সংগ্রামী দেশবাসীকে আহবান জানিয়েছিলেন । কবি তাঁর ‘বিষের বাঁশী’ কাব্যগ্রন্থের ‘সেবক’ কবিতায় লিখেছেন, ‘সত্যকে হায় হত্যা করে অত্যাচারীর খাঁড়ায়,/ নাই কি রে কেউ সত্য-সাধক বুক খুলে আজ দাঁড়ায়?-/ শিকলগুলো বিকল করে পায়ের তলায় মাড়ায়,-/ বজ্র-হাতে জিন্দানের ঐ ভিত্তিটাকে নাড়ায়?/ নাজাত-পথের আজাদ মানব নেই কি রে কেউ বাঁচা,/ ভাঙতে পারে ত্রিশ কোটির এই মানুষ-মেষের খাঁচা?/ ঝুটার পায়ে শির লুটাবে, এতই ভীরু সাঁচা?-’।
১৯২৪ সালে কবির লেখা এই কবিতার দশ বছর পরে ১৯৩৪ সালে সত্যিকারের এক দেশপ্রেমিকের সন্ধান মিলেছিল। প্রায় দুইশ বছর শাসন করা ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্তি পেতে সশস্ত্র আন্দোলন সংগ্রামে দাঁড়াতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন, তিনি সূ র্য সেন। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি ব্রিটিশদের হাত থেকে জন্মভূমি মুক্ত করার জন্য নির্ভয়ে দৃঢ় পায়ে হাসতে হাসতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন। ফাঁসির আগের দিন প্রিয় দেশবাসীর উদ্দেশ্যে সূর্য সেন একটি চিঠিতে লিখেছিলেন:
“ ফাঁসির রজ্জ্বআমার মাথার ওপর ঝুলছে । মৃত্যু আমার দরজায় করাঘাত করছে । এই তাতে আমার মৃত্যুকে বন্ধুর মতো আলিঙ্গন করার সময় । আমার জীবনের একঘেয়েমিকে তোমরা ভেঙে দাও , আমাকে উৎসাহ দাও । এই আনন্দময় , পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আমি তোমাদের জন্য কি রেখে গেলাম , শুধু একটি মাত্র জিনিস , তা হলো আমার স্বপ্ন । একটি সোনালি স্বপ্ন । এক শুভ মুহূর্তে আমি প্রথমে স্বপ্ন দেখেছিলাম । উৎসাহ ভরে সারা জীবন তার পেছনে উন্মত্তের মতো ছুটেছিলাম । জানি না , এই স্বপ্নকে কতটুকু সফল করতে পেরেছি । আমার আসন্ন মৃত্যুর স্পর্শ যদি তোমাদের মনকে এতটুকুস্পর্শ করে , তবে আমার এই সাধনাকে তোমরা তোমাদের অনুগামীদের মধ্যে ছড়িয়ে দাও যেমন আমি ছড়িয়ে দিয়েছিলাম তোমাদের মধ্যে।”
Advertisement
এ লেখাগুলো যখন সূর্য সেন লিখছেন, তখন তিনি সুস্থ ছিলেন না। চট্টগ্রাম কারাগারে তাঁকে হাতুড়ি মেরে ভেঙে দেওয়া হলো দাঁত, মেরে চুরমার করে দেওয়া হয়েছিল দেহের সব জয়েন্ট। এত যন্ত্রণা সহ্য করেও ১৯৩৪ সালের ১১ জানুয়ারি কারাগারে অন্তিম রাতের শেষ বাণীতেও মাস্টার দা সূর্য সেন বললেন “বন্ধুগণ , এগিয়ে চলো । কখনো পিছিয়ে যেও না । দাসত্বের দিন চলে যাচ্ছে। স্বাধীনতার লগ্ন আগত ওঠো জাগাতে জয় আমাদের সুনিশ্চিত ।”
সূর্য সেন ছিলেন অবিভক্ত ভারতের এক স্বাধীনতাকামী অগ্নি বীর পুরুষ, মহান সৈনিক। এই বীর পুরুষের জন্ম চট্টগ্রামের রাউজান থানার ১৮৯৪ সালে। বাবা রাজমনি সেন এবং মা শশীবালা দেবী। সূর্য সেনের বাল্যকাল এবং কৈশোর কেটেছে চট্টগ্রামেই। পড়াশোনা করেছেন রাউজানের দয়াময়ী বিদ্যালয়ে, নোয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়, ন্যাশনাল হাইস্কুলে, চট্টগ্রাম কলেজে এবং বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে।
তিনি যখন নোয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়, রাউজানের ছাত্র সেই সময়ই বাংলার রাজনীতি বেশ উত্তাল। বাংলায় বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে স্বদেশী আন্দোলন চলছে। এরপর যখন বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে বিএ পড়তে যান তিনি তাঁর শিক্ষক শতীশচন্দ্র চক্রবর্তীর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে যুগান্তর দলের সঙ্গে যুক্ত হলেন।
১৯১৮ সালের দিকে তিনি চট্টগ্রামে ফেরত আসেন ন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষকতায় যোগ দেন। পরিচিতি লাভ করেন মাস্টার দা হিসেবে। এই সময় তিনি যুগান্তর দলকে সক্রিয় করে তোলেন। এর সঙ্গে অনুশীলনকেও যুক্ত করেন। ক্রমাম্বয়ে তিনি সহিংস আন্দোলনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষদের উজ্জীবিত করেন। ছাত্র ধর্মঘট, হরতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আদালত বর্জন, সভা সমাবেশের মাধ্যমে উপনিবেশ হটানোর তীব্র আন্দোলন শুরু করেন। জনগণকে স্বাধীনতাকামী করে তোলেন।
Advertisement
এভাবে চলতে চলতে এসে গেলো ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল। মাস্টার দা সূর্য সেন তাঁর দলবল নিয়ে চট্টগ্রামের অস্ত্রাগারে হানা দেন। বিদ্রোহ ঘোষণা করেন ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে। বিদ্রোহের নেতৃত্বদানকারী মাস্টার দা সূর্য সেন ওই পতাকার তলে দাঁড়িয়ে চট্টগ্রামের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। চট্টগ্রাম সম্পূর্ণরূপে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত ছিল চারদিন।
১৯৩০ সালের ২০ এপ্রিল রোববারের দি বেঙ্গলী পত্রিকায় চট্টগ্রাম বিদ্রোহের খবর ছাপা হলো লিড নিউজ দিয়ে। যেখানে লেখা হলো: “Chittagong Armouries Raided by 100 Insurgents” পত্রিকায় আরো বলা হলো-
: Six persons shot dead ; Railway and Telegraphic communications cut off; Bengal Ordinance Revived: Viceroy’s Proclamation ; Eastern Frontier Rifles leave for Chittagong; Governor Hastens Back to Calcutta from Siliguri; Civilian Employees Safe.
এতেই বোঝা যায় ব্রিটিশ শাসনের কতটা ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন মাস্টার দা সূর্যসেন। ব্রিটিশ সরকার থেকে থাকলো না। সূর্যসেনসহ ছয়জন শীর্ষস্থানীয় বিপ্লবীকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকার ৫ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। ব্রিটিশরা তাকে কিছুতেই ধরতে না পারায় পরে এ পুরস্কারের পরিমাণ বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করা হয়।
১৯৩০ সালের ১ মে চট্টগ্রামের জেলাশাসক এইচ.আর.উইকিনসন বাংলা সরকারের চিফ সেক্রেটারিকে গোপন পত্রে লেখেন,“Revolutionary outbreak in Chittagong during which events occurred which have no parallel in Bengal since the mutiny of 1857. It was a declaration of war against His Majesty the king by a body of armed and disciplined men calling themselves the Chittagong branch of the Indian Republic Army. They succeeded in affecting a complete surprise.”
কিন্তু সূর্য সেন ধরা পড়ে গেলেন ১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। চট্টগ্রামের নিজ গ্রাম গৈরালার আরেক বিপ্লবী ব্রজেন সেনের বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন কল্পনা দত্ত, সুশীল এবং মণি দত্তকে নিয়ে। পরম যত্নে তাঁদের আগলে রেখেছিলেন সে বাড়ির বড় বধূ ক্ষিরোদপ্রভা । এই আশ্রয় ছিল ১৯৩৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি। এরই মধ্যে প্রতিবেশী নেত্র সেন সরকারি পুরস্কারের দশ হাজার টাকার লোভে পুলিশে খবর দিয়ে ধরিয়ে দেয়। পরদিন সমস্ত সংবাদপত্রের হেডলাইন ১৯৩৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তারিখের অমৃতবাজার পত্রিকায় আবারো বড় করে খবর ছাপা হলো: “ গৈরালা নামক গ্রামে সূর্য সেন গ্রেফতার।”
শুরু হলো বিচারিক কার্যক্রম। নিয়তির পরিহাসের কাছে তিনি হার মানলেন। ১৯৩৪-এর ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলে ফাঁসি হলো মাস্টারদা সূর্য সেনের |
১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের এই ফাঁসির মঞ্চে সেদিন আরেকজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল। তিনিও ছিলেন সূর্য সেনের সহগামী। নাম তারকেশ্বর দস্তিদার । ফাঁসির পর লাশ দুটো জেলখানা থেকে ট্রাকে করে ৪ নম্বর স্টিমার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর মরদেহ দুটোকে ব্রিটিশ ক্রুজার “The Renown” এ তুলে নিয়ে বুকে লোহার টুকরো বেঁধে বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগরের সংলগ্ন একটা জায়গায় ফেলে দেওয়া হয় |
সূর্য সেনকে চট্টগ্রামের যেখানে ফাঁসি দেওয়া হয়, এখন সেটা চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার। প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে বাঁ দিকে কিছুদূর এগোলেই প্রায় ১০ ফুট উঁচু একটি দেওয়াল। যেখানে রয়েছে ধূসর দেওয়ালে মাস্টার দা সূর্যসেনের রঙিন প্রতিকৃতি। দেওয়ালের সামনেই সাদা রং করা ফাঁসির মঞ্চ। বেদিটা ঢেকে রাখা হয়েছে টিন দিয়ে। মঞ্চের পাশেই একটা স্মৃতিফলক। সেখানে লেখা আছে, ‘সংরক্ষিত ঐতিহাসিক নিদর্শন: ১৯৩৪ সনে কার্যকর, মাস্টার দা সূর্যসেনের ফাঁসির মঞ্চ।’ ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে তাঁর এই অদম্য লড়াকু বীরের মৃত্যুদিনে আমরা শ্রদ্ধাভরে তাঁকে স্মরণ করতে চাই।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। anwarhist@gmail.com
এইচআর/ফারুক/এমএস