বাংলাদেশ এমন একটি জাতি রাষ্ট্র যা কোনো ব্যক্তির নামেই পরিচিত। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ অবিচ্ছেদ্য অংশ। আজ থেকে বায়ান্ন বছর পূর্বে এইদিনে জাতির অবিসংবাদিত নেতা সকল উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা কাটিয়ে পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে প্রিয় স্বদেশে ফেরেন। জাতির পিতার স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে বাঙালি পায় বিজয়ের পূর্ণতা। ঐতিহাসিক দিনটি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস হিসেবে পালিত হয়।
Advertisement
তিনি ফিরে এসেছিলেন বলেই আজ বাংলাদেশ স্বমহিমায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানী বন্দীদশা হতে মুক্ত হয়ে দেশে ফেরেন তখন রাষ্ট্রীয় কোষাগার ছিল শূন্য। সরকার গঠনের পরপরই বঙ্গবন্ধু দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া লাখ লাখ শরণার্থীর পুনর্বাসন, খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা উপকরণ সরবরাহ, কৃষি ও কৃষকের উন্নতি, প্রাথমিক শিক্ষা, পানি ও বিদ্যুতের উপর গুরুত্বারোপ করেন। কারণ মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাসে পাকিস্তানিরা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল,ব্যাংক, অফিস-আদালত, সেতু, রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিল। হত্যা করেছিল কর্মরতদের। সেই শূন্যতা পূরণে বঙ্গবন্ধু নিয়েছিলেন ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত।
জাতির পিতা আর্থিকখাতকে সমৃদ্ধ করতে প্রথমেই ব্যাংক-বীমা পুনগর্ঠনের সিদ্ধান্ত নিলেন। পাকিস্তানি আমলের ব্যাংকগুলো পুনগর্ঠন করে ছয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করলেন। ভিন্ন ভিন্ন সেক্টরের জন্য ভিন্ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। কৃষির জন্য কৃষি ব্যাংক, শিল্পের জন্য শিল্প ব্যাংক, সব বীমাসমূহ একত্রিত করে জীবন বীমা কর্পোরেশন ও সাধারণ বীমা কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করেন। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক করেন। এছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নামকরণে বাঙালিয়ানার মুন্সিয়ানা দেখান বঙ্গবন্ধু। সেগুলো হলো- সোনালী, জনতা, রূপালী, অগ্রণী, জনতা, পূবালী ও উত্তরা ব্যাংক।
তাছাড়া প্রতিষ্ঠানিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলারোধ করতে দেশে ফেরার ২১ দিনের মধ্যে পরিকল্পনা কমিশন গঠন করেন। শিক্ষাকে সংস্কার ও আধুনিকায়ন করতে ৪০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ এবং ১ লাখ ৬০ হাজার শিক্ষককে সরকারি বেতনভুক্ত করেন। যা ছিল বঙ্গবন্ধুর যুগান্তকারী পদক্ষেপ। দেশ স্বাধীনের মাত্র সাড়ে তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় মিত্রবাহিনীকে দেশে ফেরত পাঠাতে পেরেছিলেন। যা ছিল ইতিহাস সৃষ্টিকারী সফলতা।
Advertisement
বঙ্গবন্ধু কৃষিখাতকে আধুনিকায়ন করার জন্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বিআরডিবিসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এছাড়া কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করাসহ ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করে দেন।
এছাড়া সামরিকভাবে দেশকে শক্তিশালী করতে সশস্ত্রবাহিনীর সদর দপ্তর ঢাকায় স্থাপন করেন। দেশের ভাবমূর্তি বাড়াতে নিজস্ব পতাকাবাহী বিমান সংস্থা ও শিপিং করপোরেশন স্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন দেশের স্বাস্থ্যসেবা ঔষধ নিয়ে ভাবতেন। কিভাবে স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া যায় এবং ঔষধসমূহের মান সঠিক রাখা যায়। এসব বিবেচনায় জাতির পিতা মানসম্মত ঔষধ উৎপাদন ও মান নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে ‘ঔষধ প্রশাসন পরিদপ্তর’ গঠন করেন।
এছাড়া ওষুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে পেটেন্ট না মেনে যে সাহস দেখিয়েছিলেন যা তৃতীয় বিশ্বের কোন রাষ্ট্রনায়ক সাহস পাননি। বঙ্গবন্ধুর এই উদ্যোগে দেশীয় কোম্পানীগুলো বিপুল প্রণোদনা লাভ করে এবং ওষুধগুলোর দাম কম হওয়ায় মানুষের নিকট সহজলভ্য হয়। এতে জনগণ উপকৃত হয় এবং দেশীয় ঔষধশিল্পের প্রসার ঘটে। যা দেশর অর্থনীতিতে অবদান রাখে। তিনি এসেছিলেন বলেই এমন জনগুরুত্বপূর্ণ কর্ম সম্পাদিত হয়েছিল।
একটি দেশের বাস্তব ও টেকসই পররাষ্ট্রনীতির উপর নির্ভর করে দেশটির ভবিষ্যৎ। দেশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ঠিক তেমনি যুগোপযোগী ও দুরদৃষ্টিসম্পন্ন পররাষ্ট্রনীতির উপর গুরুত্বারোপ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু কারও সাথে বৈরিতা নয়,সবাই বন্ধু এই নীতিতে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ৫০ টির মতো রাষ্ট্রের সরকারপ্রধানের সফরসহ শতাধিক সফর অনুষ্ঠিত হয়।
Advertisement
এসময়ে বিশ্ব নিয়ন্ত্রকারী অধিকাংশ মোড়ল দেশসমূহ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এমনকি জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভসহ ইউনিসেফ, ডব্লিউএফপি, আইডিএ, ইউএনএইচসিআর বাংলাদেশকে ঋণ ও অর্থনৈতিক সাহায্য করে। এসবই ছিল বঙ্গবন্ধুর ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বের অনন্য গুণাবলী। সেদিন যদি তিন ফিরে না আসতেন তবে বাংলাদেশ নামক ভূখন্ড হয়তো আবারও পাকিস্তানি কবজায় চলে যেত।
বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্র প্রসারে ছিলেন নিবেদিত। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরমাণু শক্তি কমিশন গঠন করেন। এবং একই সাথে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ‘ বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ’ (বিসিএসআইআর) প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬১ সালে দেশে প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয় পাবনার রূপপুরে।
পরে তা বন্ধ হয়ে যায় তৎকালীন সামরিক জান্তার কারণে। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু স্থগিত হওয়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়নের উদ্যোগে নেন। এবং ২০২৩ সালে বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনার হাত ধরেই পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনের মাধ্যমে উৎপাদন শুরু করেছে। বঙ্গবন্ধু যদি ফিরে না আসতেন তবে এসব কখনোই বাস্তবায়িত হতো না।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাংবাদিক ও সাহিত্যিকদের সম্পর্ক ছিল আন্তরিকতাপূর্ণ। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে শেখ মুজিবের সঙ্গে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াও অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। একজন রাজনৈতিক নেতা অপরজন সাংবাদিক। এছাড়া শহিদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের সঙ্গেও ছিল তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। বঙ্গবন্ধু সাংবাদিক ও সাহিত্যিকদের কদর করতেন। এজন্য তাঁদের সঙ্গে ছিল বঙ্গবন্ধুর হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে পূর্ণতা পায় স্বাধীনতা। তাঁর আগমনে প্রশমিত হয় সন্তানহারা মায়ের ক্রন্দন, সম্ভ্রমহারা বোনের আর্তনাদ। তিনি এসেছিলেই বলেই আজকের আধুনিক বাংলাদেশ পেয়েছি আমরা।
ফিরে যায়, সাতচল্লিশে দেশ ভাগের পর ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটো আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে পরাধীনতার যাঁতাকালে নিক্ষিপ্ত হয় পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অঙ্গীভূত হওয়া বাংলাদেশ (পূর্ব বাংলা)। বাঙালি জাতির মুক্তির দূত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তান জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে আপামর জনগণ।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ কালজয়ী ভাষণের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়। এর ১৮ দিন পর ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পূর্বেই বঙ্গবন্ধু ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন,যা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়লে মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে সর্বস্তরের জনগণ। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায় পাক সেনারা। এবং মুক্তির আগ পর্যন্ত পাকিস্তানের লায়ালপুর ও শাহিনওয়ালের দুটি কারাগারে কাটাতে হয় এই অবিসংবাদিত নেতাকে।
কারাগারে আটক রেখে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ১২ টি অভিযোগ এনে বিচার শুরু করে পাকিস্তান সামরিক জান্তা। অভিযোগগুলোর মধ্যে অন্যতম হল-‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা’করা। ১২টি অভিযোগের মধ্যে ছয়টির রায় ছিল মৃত্যুদন্ড। টাইমসের প্রতিবেদনে লেখা হয় এই বিচার শেষ হয় চার ডিসেম্বর। এদিকে পাকিস্তানি সেনাশাসক ইয়াহিয়া খান সেনা কর্মকর্তাদের রাওয়ালপিন্ডিতে ডেকে পাঠিয়ে শেখ মুজিবকে গুলি করে হত্যার নির্দেশ দেন। কিন্তু বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতের সাথে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
সাত ডিসেম্বর মিয়ানওয়ালিতে ফিরিয়ে আনা হয় বঙ্গবন্ধুকে। ১৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য ইয়াহিয়া খানের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এদিন জেলখানার দায়িত্বরতদের জানানো হয় নিয়াজিকে পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) বাঙালিরা হত্যা করেছে। এর প্রতিশোধ হিসেবে শেখ মুজিবকে হত্যা করা হবে। ১৬ ডিসেম্বর ভোর চারটায় জেল সুপার বঙ্গবন্ধুর সেলের দরজা খুলে ঢুকলে তাঁকে ফাঁসির জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কিনা জানতে চান। কারণ তিনি আগেই দেখেছিলেন তাঁর সেলের বাইরে কবর খুঁড়ে রাখা হয়েছে। জেল সুপার বলেন, তাঁকে ফাঁসির জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছেনা।
বঙ্গবন্ধু তাকে আবার বললেন,যদি ফাঁসিই দেওয়া হয় তাহলে আমাকে প্রার্থনার জন্য কয়েক মিনিট সময় দিন। তিনি না না বলে একদম সময় নেই জানিয়ে দেন। এরপর বঙ্গবন্ধুকে কয়েক মাইল দূরে অজ্ঞাত স্থানে নয়দিন সরিয়ে রাখেন। জেলের কর্মকর্তারা জেল সুপারকে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কে জানতে চাইলে কিছু জানেন না বলে জানান।
১৯ ডিসেম্বর জুলফিকার আলী ভুট্টোর ক্ষমতা গ্রহণের কথা জেল সুপারকে জানান এক পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি শেখ মুজিবকে আর লুকিয়ে রাখার প্রয়োজন নেই মন্তব্য করে বলেন, তাঁর সাথে কথা বলতে চান ভুট্টো। তারপর রাওয়ালপিন্ডিতে শেখ মুজিবকে নিয়ে গৃহবন্দি করা হয় এবং ২৪ ডিসেম্বর তাঁর সাথে দেখা করেন ভুট্টো।
শেষবারের মত ৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেন ভুট্টো। বাংলাদেশ স্বধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তানকে চাপ দেওয়ার জন্য ৬৭ দেশের সরকার প্রধানকে চিঠি দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।
অবশেষে বিশ্ব জনমতের চাপে নতি স্বীকার করে ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি ভোররাতে যা গ্রেগরিয়ান হিসাব মতে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। বঙ্গবন্ধু মুক্তি পাওয়ার পর প্রথমে বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী সেটাই সম্ভব ছিল না, কারণ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের আকাশসীমা ব্যবহার করা। পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে তৃতীয় দেশ হিসেবে ইরান অথবা তুরস্ককে বেছে নেওয়ার প্রস্তাব দেয়া হলে বঙ্গবন্ধু সে প্রস্তাবে প্রত্যাখান করেন এবং লন্ডনে পাঠানোর প্রস্তাবে রাজি হন।
এরপর বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া সামরিক বিমানটি বঙ্গবন্ধুকে সকাল সাড়ে ছয়টায় লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দেয় এবং কিছু সময়ের মধ্যে ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা হ্যারল্ড উইলসন(পরে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী) বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে হোটেল ক্যারিজেসে যান। লন্ডনে পৌঁছে সকাল ১০টার পর তিনি কথা বলেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে। এছাড়া তিনি কথা বলেন, মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গেও।
বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডনে পৌঁছান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ তখন লন্ডনের বাইরে ছিলেন। তিনি পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করে বিকেল পাঁচটায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে প্রায় ঘন্টাব্যাপী বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। এরপর ৯ জানুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া কমোট বিমান বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। কিন্তু সেদিন সকালে লন্ডনে থাকা অবস্থায় টেলিফোনে বঙ্গবন্ধু-ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে আধা ঘণ্টা আলোচনা হয় এবং ঢাকায় ফেরার পথে দিল্লিতে যাত্রাবিরতির অনুরোধ করলে বঙ্গবন্ধু আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং দিল্লিতে যাত্রাবিরতির সিদ্ধান্ত নেন।
১০ জানুয়ারি সকালে দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু পৌঁছালে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি.ভি.গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, মন্ত্রিসভা, তিনবাহিনীর প্রধানসহ অন্যান্য অতিথি বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান। বিমানবন্দরের অনুষ্ঠানিকতা শেষে জনসভায় বঙ্গবন্ধু ভারতের জনগণ, সরকার ও ইন্দিরা গান্ধীর নিকট কৃতজ্ঞতা জানান এবং ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ থেকে ফেরত নেওয়ার কথা বলেন। ইন্দিরা গান্ধী তখনই জানিয়ে দেন- ‘যখনই বলা হবে, ভারতীয় বাহিনী তখন ফেরত যাবে।
দিল্লিতে জনসভার পর দুপুর ১ টা ৪১ মিনিটে বিজয়ের বেশে স্বপ্নের সোনার বাংলায় পা রাখেন জাতির মহানায়ক। বিমান থেকে নামার পূর্বেই বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ব্রিটিশ বিমানের পাইলটরা প্রায় পৌনে এক ঘন্টা ঢাকার আকাশে চক্কর দেন। বঙ্গবন্ধু ঢাকার আকাশ থেকে প্রাণভরে অবলোকন করেন তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলাকে। বিমান থেকে নেমেই আবেগে কেঁদে ফেলেন শেখ মুজিব।
ওই দিন বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত ছিল জনসমুদ্র। এরপর সেখানে বিকেল পাঁচটায় সদ্য স্বাধীন দেশের প্রায় ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ভাষণ দেন শেখ মুজিব। প্রায় কুড়ি মিনিটের সেই আবেগতাড়িত বক্তৃতায় পাকিস্তানে বন্দিদশার কথা উল্লেখ করে বলেন, তিনি ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন,বাঙালিকে কেউ ‘দাবায় রাখতে’ পারবে না।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে পূর্ণতা পায় স্বাধীনতা। তাঁর আগমনে প্রশমিত হয় সন্তানহারা মায়ের ক্রন্দন, সম্ভ্রমহারা বোনের আর্তনাদ। তিনি এসেছিলেই বলেই আজকের আধুনিক বাংলাদেশ পেয়েছি আমরা।
লেখক: প্রতিবেদক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)।
এইচআর/জেআইএম