রেগুলেটরের ব্যর্থতায় বোনাস শেয়ার ও প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে শেয়ারবাজারের থেকে চলে যাচ্ছে শত শত কোটি টাকা। ফলে নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও দেশের শেয়ারবাজাবে দরপতন থামছে না বলে মন্তব্য করেছেন শেয়ারবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ। অর্থনীতিবিদ, শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ। সম্প্রতি জাগো নিউজের সঙ্গে বর্তমান শেয়ারবাজারের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করেন এ শেয়ারবাজার বিশ্লেষক। সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক শফিকুল ইসলাম। তার চুম্বক অংশ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো- জাগো নিউজ: স্যার কেমন আছেন? আবু আহমেদ: ভালো। জাগো নিউজ: শেয়ারবাজারের বর্তমানের সার্বিক পরিস্থিতিকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?আবু আহমেদ: শেয়ারবাজার পরিস্থিতি কথা বলতে গেলে প্রথমে বলতে হবে বাজার ভালো যাচ্ছে না। সবার প্রত্যাশা ছিলো বাজারের মূল্য সূচক পাঁচ বা সাড়ে ৪ হাজারের নিচে নামবে না। কিন্তু এখন সূচক সাড়ে ৪ হাজারের নিচে নেমে এসেছে। ধারাবাহিক দরপতন হচ্ছে। এর মূল কারণ অনিয়ম আর নানা অপকৌশলে বাজার থেকে অর্থ বেড়িয়ে যাচ্ছে। রেগুলেটরের ব্যর্থতায় বোনাস শেয়ার ও প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে শত শত কোটি টাকা বাহিরে চলে যাচ্ছে। তবে এ বিষয়ে রেগুলেটরদের কোনো ধরনের চিন্তাভাবনা নেই। তিনি বলেন, আইপিওর মাধ্যমে বাজারে নতুন কোম্পানিগুলো অর্থ তুলে নিচ্ছে। এগুলোর বেশিরভাগই বেশি প্রিমিয়াম নিয়ে অতি মূল্যায়িত হয়ে বাজারে আসছে। আর রেগুলেটররা যাচাই বাছাই না করেই অনুমোদন দিচ্ছে। ফলে বাজারে আসার পর প্রথম কয়েক মাস তিন থেকে চার গুণ বেশি দামে শেয়ার বিক্রি হলেও পরে তা ফেসভ্যালুতে আবার অনেকগুলো তার নিচে নেমে আসছে। এতে করে একদিকে কোম্পানিগুলো বাজার থেকে অর্থ তুলে নিচ্ছে। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। আবু আহমেদ বলেন, নতুন কোম্পানিগুলো বাজারে আসার আগে তিন-চার বছর তেমন কোনো লভ্যাংশ না দিলেও বাজারে এসেই বোনাস শেয়ার ইস্যু করছে। আর তাদের উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা সেই বোনাস শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে শত শত কোটি টাকা তুলে নিচ্ছে। কিন্তু পুনরায় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছে না। ফলে বাজারে শেয়ার মূল্য পতন হচ্ছে। আর এভাবে অর্থ চলে গেলে বাজার ঘুরে দাঁড়াবে কিভাবে। এছাড়াও বিনিয়োগকারীদের ঠকানো আরো একটি উপায় বের করেছে প্রতারকরা। তা হলো মার্জার প্রতারণা। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সঙ্গে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির মার্জার (একীভূত) করছে। এতে কোম্পানির ইকুইটি বেজ কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। ফলে শেয়ারের দর অতিমূল্যায়িত হবে। আর এসব কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা আনুপাতিক হারে শেয়ার নিয়ে বাজারে বিক্রি করে টাকা তুলে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে বলে মনে করেন এ বিশ্লেষক। তিনি বলেন, মার্জারের নামে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ইকুইটি বেজকে কয়েক গুণ বাড়তে দিলে শেষ পর্যন্ত তার ভার বহন করতে হবে বাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। জাগো নিউজ: তাহলে বাজার উত্তোরণে রেগুলেটরদের করণীয় কি?আবু আহমেদ: রেগুলেটরদের অনেক কিছু করণীয় আছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের জন্য বোনাস শেয়ারের ক্ষেত্রে (Lock-IN) লক-ইন সময় বেঁধে দেওয়া। আর এলক-ইন সময় করতে হবে বোনাস ইস্যু করার প্রথম দুই বছর পর্যন্ত। যাতে করে উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা বোনাস শেয়ার বিক্রি অর্থ তুলে নিতে না পারে। তিনি বলেন, বর্তমানে নতুন কোম্পানির প্রসপেক্টাস প্রকাশনার তারিখ থেকে পরবর্তী দুই বছর উদ্যোক্তা-পরিচালক জন্য লক-ইন দেওয়া আছে। প্রসপেক্টাস প্রকাশনার তারিখ না ধরে কোম্পানির বোনাস ইস্যু করার প্রথম দুই বছর পর্যন্ত লক-ইন দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। এছাড়াও আইপিও অনুমোদনের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ সংস্থার আরো বেশি যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে প্রিমিয়াম নির্ধারণ কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থার বিবেচনা করে দেয়া উচিত। মার্জার সম্পর্কে তিনি বলেন, একই ধরণের পণ্য উৎপাদনে আছে এমন দুটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি, যাদের শেয়ার আছে বাজারে, তাদের মধ্যেই কেবল মার্জারের অনুমোদন বিবেচনা করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে যে দুই কোম্পানি মার্জার (একীভূত) হবে সেই কোম্পানির লাভ-লোকসান কত? লাভ হলে ট্যাক্স দিয়েছে কিনা, তার দালিলিক প্রমাণ দেখা এবং দুই কোম্পানির সম্পদ মূল্য নতুন করে যাচাই-বাছাই করে রেগুলেটরের অনুমোদন দেওয়া উচিত। জাগোনিউজ: কোয়ালিটি সম্পূর্ণ শেয়ারবাজারে আনতে কি করা প্রয়োজন?আবু আহমেদ: কোয়ালিটি সম্পূর্ণ শেয়ারবাজারে আনতে প্রয়োজন আমাদের দেশে যে সব মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি রয়েছে যেমন: ইউনিলিভার, নেসলে, বাংলালিংকসহ অন্যান্য কোম্পানিকে দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করতে হবে। তারা ব্যবসা করে শত শত কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে কিন্ত আমাদের কি দিচ্ছে? তারা শুধু আমাদের ভোক্তা বানাচ্ছে। ইউনিলিভার, নেসলে পাশবর্তী দেশগুলোর শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে আমাদের এখানে হলে সমস্যা কি? আর এ জন্য রেগুলেটর একা পারবে না, সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিগুলো বাজারে না আসলে তাদের টেক্স বাড়িয়ে দেয়া উচিত। জাগোনিউজ: বর্তমান শেয়ারবাজার নিয়ে আপনার প্রত্যাশা ও বিনিয়োগকারীদের জন্য আপনার পরামর্শ কি?আবু আহমেদ: বাজারের এখন যে অবস্থা তা বিনিয়োগযোগ্য কিন্তু এজন্য রেগুলেটরের সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে। একই সঙ্গে বাজার উন্নয়নে সরকারের যেসব পলিসি সাপোর্ট রয়েছে তা অব্যাহত রাখতে হবে। ব্যক্তির লভ্যাংশের ওপর টেক্স কমাতে হবে। একই সঙ্গে সাবসিডিয়ারি মার্চেন্ট ব্যাংকে একক গ্রাহক ঋণ সমন্বয়ের সময় (সিঙ্গেল বরোয়ার এক্সপোজার লিমিট) বাড়াতে হবে। আর বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে আমি বলবো যে কোম্পানির শেয়ার আপনি কিনছেন সেই শেয়ার আপনার সম্পদ। আর এ সম্পদ কেনার আগে আপনাকেই বিবেচনা করতে হবে। তবে আমি বলবো আপনারা (বিনিয়োগকারীরা) জং শেয়ার (যে শেয়ারের দর আগে ৩০ টাকা ছিলো এখন ১০ থেকে ১৫ টাকায় নেমে গেছে) কিনবেন না। কোম্পানির বিগতদিনের ডিভিডেন্ড, অভারঅল পারফোরমেন্স দেখে বিনিয়োগ করবেন। জাগো নিউজ: ব্যস্ততার মাঝে মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য জাগো নিউজের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।আবু আহমেদ: আপনাকেও ধন্যবাদ। এসআই/জেএইচ/এমএস
Advertisement