ভোজ্যতেলের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে গত কয়েক বছর ধরে নওগাঁয় বেড়েছে সরিষা চাষ। এই সরিষার আবাদ মৌয়ালদের মধু আহরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। শতাধিক মৌচাষি নওগাঁর বিভিন্ন স্থানে সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌ-বক্স বসিয়ে মধু সংগ্রহ করছেন। এতে কেবল তারাই লাভবান হচ্ছেন, বিষয়টি তেমন নয়।
Advertisement
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্ষেতের পাশে মৌ-বক্স বসালে পরাগায়ন বৃদ্ধি পায়। এতে সরিষার ফলন বাড়ে। ফলে পরোক্ষভাবে কৃষকও লাভবান হচ্ছেন। আর চলতি মৌসুমে মৌ-বক্সের মাধ্যমে জেলায় দেড়শ টন সরিষা ফুলের মধু আহরণের আশা করছে কৃষি বিভাগ।
কৃষি অফিসের তথ্যমতে, জেলায় গত ৫ বছরে সরিষার আবাদ বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। চলতি বছর নওগাঁর ১১টি উপজেলায় ৬৮ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় ২০ হাজার ৬৫০ হেক্টর বেশি। ২০২২ সালে জেলায় ৪৭ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছিল। ২০২১ সালে সরিষার আবাদ হয়েছিল ৩৬ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে। ২০২০ সালে ৩১ হাজার ১৭৫ হেক্টর এবং ২০১৯ সালে সরিষা চাষ হয়েছিল ৩০ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে। সে হিসাবে গত ৫ বছরে জেলায় ৩৭ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ বেড়েছে। এ বছর চাষ হওয়া জমি থেকে ১ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন সরিষা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: জয়পুরহাটে সরিষার বাম্পার ফলনের আশা
Advertisement
চলতি বছর জেলায় সবচেয়ে বেশি সরিষা আবাদ হয়েছে মান্দায়। এ উপজেলায় ৭ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করেছেন কৃষকেরা। তাই মান্দার মাঠে মাঠে মৌয়ালদের আনাগোনাও বেশি।
নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়কের মান্দা উপজেলার জয় বাংলা মোড় এলাকায় সরিষা ক্ষেতের পাশে আম বাগানে মৌ-বক্স স্থাপন করেছেন জাহিদ হাসান। তার বাড়ি রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার কেশরহাট এলাকায়। তিনি জানান, গত ৯ বছর ধরে এভাবে মৌ-বক্স স্থাপন করে মধু সংগ্রহ করছেন। এখানে ১৪০টি মৌ-বক্স স্থাপন করেছেন। এখন পর্যন্ত তিনবারে ২০০ কেজির বেশি মধু সংগ্রহ করেছেন। বছরে তিনি ১০-১২ লাখ টাকার মধু সংগ্রহ করেন। সব খরচ বাদ দিয়ে ২-৩ লাখ টাকা লাভ থাকে।
জাহিদ হাসান বলেন, ‘আগে কৃষকেরা ক্ষেতের পাশে মৌ-বক্স রাখতে দিতে চাইতেন না। তাদের মধ্যে ভুল ধারণা ছিল যে, মৌমাছি মধু শুষে নেওয়ার কারণে সরিষার দানা পুষ্ট হয় না। ফলে উৎপাদন ব্যাহত হয়। তবে কৃষি বিভাগের প্রচারণায় এখন কৃষকদের সেই ভ্রান্ত ধারণা পাল্টে গেছে। তারা এখন জানেন, ক্ষেতের পাশে মৌ-বক্স বসালে সরিষার ফলন কমে না বরং বাড়ে।’
আরও পড়ুন: মধু ও মৌমাছি নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করেন অলিউল্লাহ
Advertisement
জাহিদ হাসানের মৌ-খামারের পাশেই ৩ বিঘা জমিতে সরিষা আবাদ করেছেন আক্কাস আলী। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগে আমরা মনে করতাম এভাবে মধু সংগ্রহ করলে ফসলের ক্ষতি হয়। তবে সেই ধারণা যে ভুল ছিল, তা বুঝতে পেরেছি। এখন আমরা জানি, সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌমাছি রাখলে ফুলের পরাগায়ন বৃদ্ধি পায়। এতে উৎপাদনও বাড়ে। তাই আশপাশের সব জমির মালিক মিলে মৌচাষিদের উৎসাহিত করছি।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নওগাঁর উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘জেলায় চলতি মৌসুমে ১১১ জন মৌচাষি সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌ-বক্স স্থাপন করে মধু সংগ্রহ করছেন। ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত ৬১ স্থানে ৮ হাজার ৩০০টি বক্স স্থাপন করা হয়েছে। এ থেকে ৭০ হাজার কেজি মধু সংগ্রহ করেছেন মৌচাষিরা। মৌসুম শেষে চাষিরা দেড় লাখ কেজি (দেড়শ মেট্রিক টন) মধু আহরণ করতে পারবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘মৌমাছির মাধ্যমে বক্স পদ্ধতিতে মধু আহরণ করে কৃষিখাতে বিশেষ করে সরিষা, কালিজিরা, আম ও লিচুর উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে প্রচারণার পাশাপাশি মৌচাষে উদ্বুদ্ধ করতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের উদ্যোগে মৌচাষিদের বিনা মূল্যে মৌ-বক্সও বিতরণ করা হচ্ছে।’
মশিউর রহমান/এসইউ/এমএস