মতামত

শেখ হাসিনার দেশপ্রেম সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ

বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ৫২ বছর পার করেছে। বাঙালি জাতি আরও একবার বিজয়ের আনন্দে মেতে উঠলো। এ বিজয় অবশ্য সহজে আসেনি। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের সোনার বাংলা। তাই এ অর্জনে রয়েছে অনেক শোকগাথা।

Advertisement

’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাক হানাদারদের ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী হামলার মুখে এদেশ থেকে প্রায় এক কোটি লোক (বর্তমান হিসেবে তিন কোটি) ভারতে শরণার্থী হতে বাধ্য হয়েছিল। এদেশের অর্থনীতি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। খুব কম সংখ্যক স্থাপনা অটুট ছিল। পাকিস্তানি হানাদাররা পোড়ামাটি নীতি নিয়েছিল। পরিণামে সোনার বাংলা শ্মশানে পরিণত হয়। দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের বাছাই করে হত্যা করা হয়েছিল। যাতে বাঙালি জাতি শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়। এতসব জুলুম, নির্যাতন, হত্যাকাণ্ডের পরও আত্মপ্রকাশ ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।

বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। এটা অবশ্য বঙ্গবন্ধুর আমলেও হতে পারতো। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী দুই পরাশক্তির কারণে তা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ যখন ভঙ্গুর অর্থনীতি থেকে উদীয়মান অর্থনীতির দিকে ধাবিত হচ্ছে তখনই দুই পরাশক্তি সক্রিয় হয়। রাতারাতি তারা নীলনকশা তৈরি করে বাংলাদেশকে ধ্বংসের ফন্দি আঁটে। এদের চক্রান্তেই ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শাহাদতবরণ করেন।

পঁচাত্তরের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এলে তিনি ক্যান্টনমেন্টে বসে বিএনপি নামক একটি দলের জন্ম দেন। পরে সহযোগী হিসেবে পান জামায়াতে ইসলামীকে। পঁচাত্তর থেকে ’৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতিরা স্বর্গে বাস করেছে। এসময় তারা ক্ষমতাসীনদের মদতে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার সব ধরনের চেষ্টা চালায়। আওয়ামী লীগ, যুব লীগ ও ছাত্রলীগসহ মূল দলের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের প্রায় ৪০ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করে। সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়সহ আাওয়ামী লীগের লাখ লাখ লাখ নেতাকর্মী ও সমর্থকের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। ফলে তারা তাদের ভিটেমাটি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।

Advertisement

এ অপশক্তিগুলো দ্বাদশ নির্বাচন সামনে রেখে এখন দেশের অর্থনীতি ধ্বংসে লিপ্ত রয়েছে। তারা জানে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার প্রধান অস্ত্র তার নেতৃত্বে দেশের অভাবনীয় উন্নয়ন। তাই তাকে দুর্বল করতে অর্থনীতি ধ্বংসের বিকল্প নেই। এ কারণে তারা হরতাল-অবরেধের নামে বিভিন্ন স্থানে জ্বালাও-পোড়াও চালাচ্ছে। তারা বাসে আগুন দিচ্ছে, রেললাইন উপড়ে ফেলছে, বিচারালয় প্রাঙ্গণে বোমার বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে এবং সর্বোপরি সারাদেশে এক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। তাদের এ অপতৎপরতা অবশ্য খুব বেশি দিন অব্যাহত থাকবে না। আসন্ন নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ জয়লাভ করলে তাদের জন্য পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।

কেননা শেখ হাসিনার দেশপ্রেম সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনিই দেশের অর্থনীতি আজকের মজবুত অবস্থায় এনেছেন। তার নিরলস প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংসস্তূপ থেকে একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। কাজেই তিনি বেঁচে থাকেতে উন্নয়ন এবং এ দেশকে ধ্বংস করা যাবে না। এ কারণে তারা অর্থনীতি অচল করার মতো জঘন্য কৌশল অবলম্বন করছে।

শেখ হাসিনার অর্থনীতির দর্শন আজ সারাবিশ্বে একটি রোল মডেল, যা বাংলাদেশকে কেবল মর্যাদাকর আসন দেয়নি, জনগণের জীবনমানেরও ব্যাপক উন্নতি ঘটিয়েছে। এ অগ্রযাত্রায় প্রধান বিরোধী দল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও দলটির মদতপুষ্ট উগ্রপন্থি সংগঠনগুলো ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। তাদের ধারণা এভাবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যেতে থাকলে জনগণ তাদের নাম-নিশানা মুছে ফেলবে। এ কারণেই তারা ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করেছে। হাসিনার দেশ গঠনের পরিবর্তে তারা দেশের অর্থনীতির চাকা স্থবির করতে জ্বালাও-পোড়াওয়ে লিপ্ত হয়েছে।

শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে জয়লাভের পর ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এরপর থেকে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের রফতানি আয় কোভিড সময়কাল বাদ দিলে প্রতি বছরই ঈর্ষণীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। এমনকি কোভিডকালেও যে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বিশাল অর্থনীতির দেশ চীন বা ভারত তার কাছাকাছি আসতে পারেনি। বিএনপি ও তাদের দোসর জামায়াত বাহিনী এই অগ্রযাত্রা ব্যাহত করার জন্য অব্যাহতভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে।

Advertisement

গত বছর বিশ্ব অর্থনীতি ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগময় কাল অতিবাহিত করার সময় তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগের সমর্থক সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পদ লুট, অগ্নিসংযোগ এবং তাদের ওপর সহিংসতা চালায়। নতুন বছরের শুরুতে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার আগে থেকেই এ চক্র তাদের সহিংসতার মাত্রা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।

শেখ হাসিনা চতুর্থ মেয়াদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার দুই মাস আগে থেকেই রাজধানীকে কার্যত রণক্ষেত্রে পরিণত করা হয়। অক্টোবরের শেষ থেকে শুরু করে নভেম্বরের প্রথম পর্যন্ত সপ্তাব্যাপী সহিংসতায় রাজধানী প্রকম্পিত হয়েছে। পুলিশ হত্যা এবং সরকারি সম্পত্তির ক্ষতিসাধন থেকে শুরু করে পণ্য পরিবহনে বাধা দেওয়ার মতো ঘটনা ছিল ব্যাপক। সর্বশেষ ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের শেষ দিকে রাজধানী ঢাকা এ ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করে। ওই বছরই দেশের সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচনে জামায়াতের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করে।

অপরদিকে একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তান ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বিরুদ্ধেও লড়তে হয়েছিল। ওই দুই দেশ সর্বোতভাবে পাকিস্তানকে সহায়তা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রগুলি চীন থেকে আমদানি করা হয়েছিল। অর্থ এবং অন্যান্য বিষয়ে পাকিস্তানকে সহায়তা করে মার্কিন প্রশাসন। ফলে মুক্তিযুদ্ধের লড়াই শুধু পাকিস্তানের সঙ্গেই নয়, যুদ্ধ ছিল দুই শক্তিধর দেশের বিরুদ্ধেও।

৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবস তাই প্রতিটি বাঙালির জন্য গর্বের এবং অহংকারের। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সর্বতোভাবে পাশে ছিল ভারত। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেন ভারতীয় সেনারা। প্রতিটি ভারতীয় নাগরিক এগিয়ে আসেন মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি অগণিত শরণার্থীদের প্রতি তাদের মানবিক সাহায্য নিয়ে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নও তাদের বন্ধুদেশ ভারতের পাশে ছিল।

স্বাধীনতা লাভের ৫২ বছর পর যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে নিজেদের জাহির করলেও পাকিস্তানিদের বর্বরতার সময় তারা ঘাতকদেরই পক্ষে ছিল। যুক্তরাষ্ট্র আজ গণতন্ত্র নিয়ে অনেক কথা বললেও সেদিন পাকিস্তানিরা যখন সাধারণ নির্বাচনে জয়ী আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায় সেদিন তারা চুপ ছিল। বরং আড়ালে পাকিস্তানকে বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরোধিতা করে। তাদের যুক্তি ছিল বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা গেলে ভারতের সঙ্গে তারা আপসের পথ খুঁজবে। এতে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ পাকিস্তানের অস্ত্রের চাহিদা কমে যাবে এবং তারা একটি বৃহৎ অস্ত্র ক্রেতা দেশ হারাবে। এ ক্ষতি তারা মানতে রাজি ছিল না বলেই সেদিন তারা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল।

এছাড়া একাত্তরে পাক হানাদাররা যখন নিরীহ বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালাচ্ছিল, তখন ঘাতকদেরই সহায়তা করেছে মার্কিন প্রশাসন। চীনও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে অস্ত্র জোগান দিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদারদের। পরে ভারতের সহায়তায় বিজয় অর্জিত হলে চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকতে তারা আমাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেননি।

অবশেষে পাকিস্তানের সেদিনের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোর (পাকিস্তান ভাঙ্গার নায়ক ও খুনের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে ফাঁসির কাষ্ঠে মৃত্যুবরণকারী) আহ্বানে সাড়া দিয়ে তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। আশা ছিল সেনাবাহিনীর দ্বারা গঠিত বাংলাদেশের নতুন সরকার তাদের হুকুম দাসে পরিণত হবে। সেই যে শুরু আজও বাংলাদেশকে কব্জায় আনার চীনা চেষ্টা অব্যাহত আছে। তাদের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে আর এক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র। তাদের লক্ষ্য অভিন্ন। তারাও নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য বাংলাদেশকে তাদের সঙ্গে রাখতে চায়।

ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কাছে বিভিন্ন সুবিধা পেতে চেয়েছে। এর অন্যতম হচ্ছে ভারত মহাসাগরে নজরদারির জন্য সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ইজারা, যা বাংলাশের পক্ষে রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া বাংলাদেশ বিমানের কাছে অতি উচ্চমূল্যে বোয়িং বিমান বেচতে চায় তারা। এবিষয়টি অবশ্য শেখ হাসিনা সরকার বিবেচনায় রেখেছে। কিন্তু এতে তারা খুশি নয়। তারা এই মুহূর্তেই বেচতে চায়। অথচ বাংলাদেশের রিজার্ভে টান রয়েছে। এটা জানা সত্ত্বেও বাংলাদেশকে বেকায়দায় ফেলার জন্য তারা জোরাজুরি করছে। বাংলাদেশ অপারগতা প্রকাশ করায় তারা ভিন্ন কৌশল নিয়েছে। তারা এখন জনবিচ্ছিন্ন একটি দলকে পেছন থেকে মদত দিচ্ছে। দলটি নির্বাচন বর্জন করলেও তারা তাদের পক্ষেই ওকালতি করে চলেছে। তাদের মতে ওই বিরোধী দলটি ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। অথচ বিএনপি ছাড়া সব দলই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে এটা তারা বুঝেও না বোঝার ভান করছে।

আগামী ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর বহু আগেই তারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ অফিস খুলে বসেছে নির্বাচনে ত্রুটি ধরার জন্য। এখন পর্যন্ত একাজে তারা সফল হয়নি। এর অর্থ এই নয় যে নির্বাচন যতই সুষ্ঠু হোক তারা বলবে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচন হয়েছে। বরং এমন সব আজগুবি প্রশ্ন তুলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে যা শুনে বাংলাদেশের মানুষ বিস্ময় প্রকাশ করবে। এতে তাদের কিছু যায় আসে না। তারা এসেছে একটি সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য। তারা বিএনপি-জামায়াতের মতো সন্ত্রাসী দলকে ক্ষমতায় বসাতে চায়।

তারা একদিকে সন্ত্রাসের নিন্দা করে আবার সন্ত্রাসী দলের পৃষ্ঠপোষকতা করে। যেমনটা করেছিল ওসামা বিন লাদেনের বেলায়। তারাই লাদেনকে তৈরি করেছে। আবার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায় একদিন তাকেই হত্যা করার জন্য উতলা হয়েছে। এ এক অদ্ভুত চরিত্র। এরা কখনও খুশি হয় না, আবার এদর খুশি করাও যায় না। এরা খুশি ততক্ষণ থাকে যতক্ষণ সংশ্লিষ্ট দেশ তাদের তাবেদারিতে চলে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/এমএস