সাহিত্য

দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণুর গুচ্ছ কবিতা

চিঠিটি লেখা হয়নি আজও

Advertisement

প্রিয়তমা, এলোকেশী বধূ আমারতুমি একটি দীর্ঘ চিঠি চেয়েছিলে, দীর্ঘ চিঠিআমার ঈশ্বর জানেন, এই চিঠি লিখতে গিয়েকতবার সূর্য অস্ত গেছে অথচ চিঠি লেখা হয়নি আজও।

একবার দক্ষিণেশ্বরে গঙ্গার ঘাটে স্নানে নামিয়েসিঁড়িতে দাঁড়িয়ে চিৎকার দিয়ে বলেছিলেএই তাকাও; আমার দিকে তাকাওতোমার ত্রিনয়নে শ্রেষ্ঠাঙ্গিনীর চওড়া কপাল দেখবমনে আছে?

একবার শান্তিনিকেতনে ছাতিমতলায়নির্জন প্রত্যুষে গ্রীবায় ওষ্ঠ ছুঁয়ে বলেছিলেযেদিন তোমার চিঠি আমার হাতে আসবে সেদিনআমাদের জীবনের উঠোনজুড়েও এমন আবহ তৈরি হবেমনে আছে?

Advertisement

একবার চেরাপুঞ্জিতে মেঘলা বিকেলেরবিঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ আওড়াচ্ছিলামঅমিত-লাবণ্যের সংলাপপর্ব শুরুমাত্রদু’হাত তুলে করতল দেখিয়ে বলেছিলেতুমি আমাকে এমন দীর্ঘ একটি চিঠি লিখবে, দীর্ঘ চিঠিমনে আছে?

একবার ছেঁড়াদ্বীপে জোয়ারের উজানে দাঁড়িয়ে ছিলামতোমার উচ্ছৃঙ্খল আউলা চুলের ঝাপটায়ঢেকে যাচ্ছিল আমার মুখাবয়বঝাপটামুক্ত রাখতে পরাস্ত হয়েস্কন্ধে চিবুক ঠেকিয়ে মৃদুকণ্ঠে বলেছিলেএসো যুগলবন্দি ঝাঁপ দিইসময় বয়ে গেলে আর কখনো ফিরে আসে নাআমি তোমাকে টানতে টানতেপ্রাণপণে ছুটছিলাম ভাটি ছেড়েমনে আছে?

একবার পাহাড় বেয়ে, মেঘ কেটে কেটেদার্জিলিংয়ের টাইগার হিল যেতে যেতেবুকে চেপে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেছিলেযেদিন তোমার চিঠি পাবসুনীলবাবুর বরুণার মতো নয়সেদিন সত্যিই আমার বুক আতরগন্ধি হবেমনে আছে?

শরীরের সঙ্গে শরীর, ভাবনার সঙ্গে ভাবনা, স্বপ্নের সঙ্গে স্বপ্নযেখানে সংলগ্ন সেখানে চিঠিতে আর কী লিখব এমন প্রশ্নেরউত্তর দিয়েছিলে, উচ্চারণে-স্পর্শে সবকিছুর ছোঁয়া পাই নাতোমার নান্দনিক প্রকাশশৈল্পিক অনুভূতির কোনো মানে বুঝিনি সেদিননীরবতা গ্রাস করেছিল, পৃষ্ঠদেশে পৃষ্ঠদেশ ঠেকিয়েবলেছিলে, তুমি বড্ড সরলমনে আছে?

Advertisement

সন্তান শৈশবের গণ্ডি ছাড়িয়ে কৈশোরের দিকে পা বাড়িয়েছেকেটে গেছে আসমুদ্র হিমাচল সময়এর পরও সেই চিঠির কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেছতুমি নিরুপম, নিরন্তর চিন্তা, জোছনা কিংবা সূর্যকিরণকিন্তু জানো, এসব কোনো কিছুই আমার চাওয়ার ইতি ঘটায় নাতোমার চিঠি চাই; দীর্ঘ চিঠিমনে আছে?

বিনিদ্র কত রাত কাটিয়েছি জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়েকখনো কখনো পাশ ফিরে ডিমলাইটের আলোয় দেখেছিঘুমকাতুরে তুমি শয্যায় যেন সমুদ্রের তরঙ্গায়িত ঢেউআমার দৃষ্টি তোমার অন্তর্দৃষ্টি এড়ায়নিঈষৎ চোখ মেলে প্রতিবারই বলেছনিঃশব্দের শব্দ আর গহিন বনের নীরবতার আকুতি দীর্ঘদিনেরমনে আছে?

চিঠিটি আজও লেখা হয়নি, শেষ করব বহুবার সিদ্ধান্ত নিয়েও পারিনিতবে ক্ষান্ত দিইনি, যা লিখি সবই মনে হয় শুধু আঁকিবুঁকি।

তুমি একাত্তরে আমার মানচিত্র অর্জনের রক্তস্নাত পাণ্ডুলিপিস্বাধীন দেশে প্রথম আনন্দ-মিছিলসব হারানোর বেদনা ভুলে যাওয়াতুমি উদার আকাশ, দিনের আরম্ভ, আদিত্যতুমি লাবণ্য, তুমি কারু, ধ্রুপদ খেয়ালে পারদর্শী শিল্পীআশ্বিন মাসের পূর্ণিমা, সর্বদর্শী নিবেদনচুম্বনের ধ্বনিহীন ধ্বনিতুমি গন্ধর্ব দলের প্রতিনিধি।

তুমি স্বর্গের উদ্যানস্থ বৃক্ষ, তুমি সময়ের সারথিতুমি সাংস্কৃতিক-গণতান্ত্রিক সব আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গযোজনব্যাপী বিস্তৃত গৌরব, মঙ্গল শোভাযাত্রাতুমি অ-গতির গতি, নিরাশ্রয়ী গৃহীর গৃহচিঠিটি লিখব, যে চিঠি লেখা হয়নি আজওসেখানে বর্ণিত হবে সব উপমা ছাড়িয়ে অখণ্ড বিবরণতুমি আমার বিশ্বব্রহ্মাণ্ড।

দুই.তুমি নির্মাণে সৃজনে(দেবাশীষ চৌধুরী রাজাদা ও সুপর্ণা দিদিকে)

আমি চাইলাম জল, শুধুই জলতুমি করতল মেলে দেখালে ভূমণ্ডলআমি চাইলাম নির্জনতার শব্দতুমি গিটারে আঙুল রেখে শোনালে তারের ঝংকার।

আমি চাইলাম একমাথা অবাধ্য চুলতুমি দেখালে পুষ্পসম প্রস্ফুটিত প্রভাতআমি চাইলাম কফির পেয়ালা নিয়ে অবিরত কথা বলতেতুমি শাড়ির আঁচল টেনে উড়িয়ে দিলে স্বপ্নঘুড়ি।

আমি চাইলাম নক্ষত্রখচিত রাততুমি দেখালে উচ্ছল ঝর্ণার জলধারাআমি আম্রকাননে, জ্যোতিষ্কমণ্ডলে তোমাকে চাইলামতুমি অবলীলাক্রমে সব দূরত্ব অতিক্রম করে গেলে।

আমি বললাম ভালোবাসার গভীরতা ও কষ্ট দুই-ই সমান্তরালতুমি বললে শীতের চাদরের মতো জড়ানো থাকে সৃজনশীলতাআমি বললাম ভালোবাসা কখনও কখনও সুখের অসুখও হয়তুমি বললে জীবনটাই তো পণ্যবাহী ট্রলার।

তোমার সঙ্গে যুক্তিযুদ্ধে আমি পরাস্ততুমি যেন পৃথিবীর আশ্চর্যতম এক আত্মাতুমি পাঁজরের ভাঁজে ভাঁজে বরফগলা রোদতুমি আমাকে ইচ্ছেমতো রাজা হওয়ার স্পর্ধা দিয়েছ।

তিন.বিপন্ন মানবতার প্রলম্বিত ছায়া

বেদনার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসা সেই আয়নাল কুর্দির কথা কি সভ্যতা-মানবতা মনে রেখেছে যে বালিতে মুখ গুঁজে সুমদ্রতীরে শেষ নিঃশাস ত্যাগ করেছিল?

‘আমার সন্তানেরা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শিশু। ওরা প্রতিদিন আমার ঘুম ভাঙাতখেলা করত আমার সঙ্গেএর চেয়ে সুন্দর মুহূর্ত আর কী হতে পারে? এ সবকিছুই হারিয়ে গেছে।’ সিরীয় শিশু আয়নালের বাবা আবদুল্লাহ কুর্দির শোকার্ত ওই উচ্চারণও কি কথিত মানবিক বিশ্ব মনে রেখেছে?

তুরস্কের সৈকতে লাল শার্ট, হাফ প্যান্ট পরা নিথর আয়নাল কিছু বিবেককে প্রচণ্ড নাড়া দিয়েছিলো অভিবাসী-সংকট নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ইউরোপের নির্লিপ্ত নেতাদের শেষ পর্যন্ত ঘুম ভাঙালেও এরই মধ্যে আয়নালের ভাই গালিব আর তার মা রেহানাসহ গৃহযুদ্ধকবলিত সিরিয়ার প্রায় আড়াই হাজার মানুষের প্রাণভূমধ্যসাগরে চিরতরে ডুবে গিয়েছিলো!

তুর্কি আলোকচিত্র সাংবাদিক নিলুফার দেমি বলেছিলেন, ‘যখন বুঝতে পারলাম ছেলেটাকে বাঁচানোর কোনো উপায়ই নেইমনে হলো, ওর ছবি তুলি; বেদনাদায়ক ঘটনাটা দেখুক সবাইআশা করি, এই ছবি যে ধাক্কা দিয়েছেতা চলমান সংকট সমাধানে সহায়ক হবে।’ বালু দিয়ে আয়নালের ভাস্কর্য বানিয়ে এর মর্মস্পর্শিতার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন ভারতীয় শিল্পী সুদর্শন পট্টনায়েক।ভাস্কর্যের পাশে তিনি লিখেছিলেন, ‘ভেসে যাওয়া মানবতা... লজ্জা লজ্জা লজ্জা’।

আলোকচিত্র সাংবাদিক দেমি, ভাস্কর পট্টনায়েকতোমাদের সেই বেদনাকাতর আবেদন মেরুকরণের বিশ্বে ভূ-রাজনীতির সমীকরণের বৃত্ত ভেদ করে না গাজায় চরম মানবিক বিপর্যয়েও পরাশক্তির ভোঁতা বিবেক জাগে না ইসরায়েলের জিঘাংসায় হাজার হাজার শিশু জন্মসনদের আগেই মৃত্যুসনদ নিয়ে ফের প্রশ্ন রেখেছে, এই কি সভ্যতার উৎকর্ষ আলো!

যুদ্ধ নয় শান্তি চাই শান্তিপ্রিয়দের এই চিৎকার কে শোনে রাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ও বিশ্বের কত দেশেইবিপন্ন-বিপর্যস্ত মানবতার প্রলম্বিত ছায়া!

এইচআর/জিকেএস