আবদুল আজিজ ৪৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। ফেনীর লেমুয়া ইউনিয়নের কসবা গ্রামেই কেটেছে তার শৈশব। ফেনী সরকারি কলেজ থেকে ইংরেজিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। বাবা মারা যাওয়ার পর মোকাবিলা করেছেন নানা প্রতিকূলতা। এরপর সব বাধা পেরিয়ে প্রথমবারেই পেয়ে যান বিসিএসে সাফল্য।
Advertisement
সম্প্রতি জাগো নিউজের সঙ্গে তিনি সংগ্রামী জীবন, বিসিএস জয় ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মামুনূর রহমান হৃদয়—
জাগো নিউজ: আপনার শৈশব কেমন কেটেছে?আবদুল আজিজ: শৈশব অন্য সাধারণ ছেলেদের মতোই কেটেছে। তবে আমার শিক্ষাজীবন শুরু হয় কওমি মাদ্রাসা থেকে। সেখানে আমি হাফতাম (সপ্তম) শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করি। সেখানে থাকা অবস্থায় আমার বাবা মারা যান। তারপর ২০০৯ সালে কওমি মাদ্রাসা থেকে বেরিয়ে আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হই। এরপর সেখান থেকেই আলিম (এইচএসসসি) পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি।
জাগো নিউজ: পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল?আবদুল আজিজ: বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবারে কিছুটা অসচ্ছলতা দেখা দেয়। তবে আমাদের কিছু পৈতৃক সম্পত্তি ছিল। সেগুলোর ওপর নির্ভর করেই পরবর্তী জীবন চলেছি। কিন্তু এখানে বড় একটা বাধা এসেছে সর্বোপরি আমাদের ভবিষ্যৎ কী হবে! আমি কতটুকু পড়াশোনা করতে পারবো। এরপর তো আলিয়া মাদ্রাসায় স্থানান্তর হলাম। পরিবারকে পাশে পাওয়ায় শেষে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করি।
Advertisement
আরও পড়ুন: চাকরি মানে শুধু বিসিএসকেই মনে হতো: পারভীন ইসলাম
জাগো নিউজ: বিসিএসের প্রস্তুতি কবে থেকে শুরু করলেন?আবদুল আজিজ: আমার বাবা ইতালি ছিলেন। অন্য আত্মীয়-স্বজনও ইতালিতে থাকেন। আমিও ভেবেছিলাম আলিম পরীক্ষা দিয়ে বিদেশ চলে যাবো। নানা জটিলতায় ভিসা বের করা যাচ্ছিল না। এরপর ফেনী কলেজে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হই। একাডেমিক পড়াশোনায় গুরুত্ব বেশি দিতে লাগলাম। জানতে হবে, বুঝতে হবে, শিখতে হবে—এর মধ্যেই ছিলাম। চাকরির প্রতি এতটা মনযোগী ছিলাম না। এরপর করোনা এলো। তখন অন্য অনেক পরিবারের মতো আমার পরিবারেও অসচ্ছলতা ভিড় করে। তারপর আমি বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি। খুঁজে খুঁজে সিলেবাস বের করি, সেখানে দেওয়া বিষয়বস্তু বোঝার চেষ্টা করি। এভাবেই শুরু।
জাগো নিউজ: আপনার সফলতায় কার অবদান সবচেয়ে বেশি?আবদুল আজিজ: সবচেয়ে বেশি অবদান ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার। আমরা যারা মফস্বলে বড় হয়েছি; তারা চারপাশ নিয়ে অনেক কম জানি, বিশ্ব রাজনীতি সম্পর্কে ধারণাও কম। কিন্তু ইন্টারনেট হাতের মুঠোয় আসার পর বিশেষ করে ইউটিউব সেই ঘাটতি অনেকাংশে পূরণ করেছে। আমি এই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়েছি। ইউটিউবে সার্চ দিয়ে রিসার্চ বেইজড কন্টেন্ট দেখতাম। ভিডিও কন্টেন্টগুলো আমার প্রস্তুতিতে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে।
জাগো নিউজ: ভাইভার জন্য কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন?আবদুল আজিজ: ভাইভা ভালো হওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে আপনি চয়েজ কী দিচ্ছেন। বিসিএস পরীক্ষায় যে বিষয়গুলো পছন্দ দিয়েছেন; সেই বিষয়গুলো সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকতে হবে। প্রতিটি ক্যাডারের দায়িত্ব, কর্তব্য এবং ক্যাডারের মাধ্যমে কিভাবে দেশকে এগিয়ে নিতে চান—তার যৌক্তিক ব্যাখ্যা তুলে ধারতে হবে। পাশাপাশি নিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভাগ সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। এছাড়া ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ, সংবিধান ও মানচিত্র, নিজ জেলা ও উপজেলা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জিজ্ঞেস করলে ঘাবড়ে না গিয়ে গুছিয়ে উত্তর দিতে হবে।
Advertisement
আরও পড়ুন: বিসিএসে প্রস্তুতি নিতে হবে আটঘাট বেঁধে: মোহাইমিনুল
জাগো নিউজ: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিসিএস জয়ের গল্প কম শোনা যায়—কারণ কী? আবদুল আজিজ: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে আমি না গর্বিত, না লজ্জিত। একটু যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা দিই—প্রথমে বলব, প্রত্যন্ত অঞ্চলের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত। আমাদের ফেনী কলেজে মাস্টার্সে শিক্ষক থাকার কথা অন্তত ১২ জন। সেখানে আছেন মাত্র ৩ জন। মফস্বলে এ অবস্থা আরও সংকটাপন্ন। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো রিসার্চ ওয়ার্ক। এখানের শিক্ষার্থীদের সাথে রিসার্চের কোনো যোগসূত্র নেই। শিক্ষকরাও রিসার্চের সঙ্গে খুব বেশি সম্পর্ক রাখেন না। তৃতীয়ত লাইব্রেরি সুবিধা কম। ফেনী কলেজে লাইব্রেরি সুবিধা ভালো হলেও সব প্রতিষ্ঠানে সমান সুবিধা নেই। চতুর্থ সমস্যা, শিক্ষার্থীদের নানা প্রতিকূলতার মাঝে পড়াশোনায় আগ্রহ কমে যাওয়া। বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি দিলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও অনেক ভালো কিছু করা সম্ভব।
জাগো নিউজ: তরুণদের জন্য কী বলতে চান—যারা বিসিএস জয়ের স্বপ্ন দেখেন?আবদুল আজিজ: প্রথমত বিসিএস জয়ই সবকিছু নয়। আরও অনেক কিছু আছে। বিসিএস না হলে জীবন বৃথা হয়ে যাবে—এমন মনোভাব আনা যাবে না। পড়তে থাকুন। পৃথিবীতে অন্য প্রফেশনের মানুষও দরকার। যারা দেশকে নানাভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। যদি বিসিএসের স্বপ্নই দেখেন, তাহলে খুবই কৌশলে সামনে এগোতে হবে। চারপাশটা দেখতে হবে, বুঝতে হবে। অনেকেই দেখি, শুধু প্রিলির জন্য পড়াশোনা করেন। এরপর পাস করলে লিখিত, তারপর ভাইভা পড়বেন। এরকম করা ঠিক নয়। সামগ্রিক বিষয়ে সমানে এগোতে হবে। ধরুন আপনি ‘মুক্তিযুদ্ধ’ বিষয়ে পড়ছেন—এটি প্রিলি, লিখিত, ভাইভা সবকিছুর জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। তাই একজন বিসিএস প্রত্যাশীকে প্রিলি, লিখিত, ভাইভা বিষয়ে সমান গুরুত্ব দিতে হবে। ভুলে যাওয়ার মতো কোনো তথ্যকে আলাদা নোট করে রাখতে হবে। লাইভ এমসিকিউতে টেস্ট দিয়ে নিজের দুর্বল বিষয় সম্পর্কে জানতে হবে। এভাবে একটু একটু করে সামনে এগোতে হবে।
আরও পড়ুন: বিসিএসে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্নপূরণ ঔষ্ণিকের
জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?আবদুল আজিজ: এটি আমার প্রথম বিসিএস ছিল, অ্যাপিয়ার্ড ফলাফল দিয়ে আবেদন করেছি। এটাতেই শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি। বর্তমানে ৪৪তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষা দিয়েছি। সামনে ৪৫তম লিখিত পরীক্ষা দেবো। প্রত্যাশা করছি ৪৪তম বা ৪৫তমতে আরও ভালো কিছু হবে। নয়তো আমি শিক্ষক হয়েই দেশের সেবা করে যাবো।
এসইউ/এমএস