দেশজুড়ে

গায়ে আগুন দেওয়া যবিপ্রবির গাড়ি চালকের মরদেহ নিয়ে বিক্ষোভ

কর্মস্থলে ‘মানসিক নির্যাতনের’ শিকার হয়ে আত্মাহুতি দেওয়া যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) জ্যেষ্ঠ চালক মফিজুর রহমানের মরদেহ নিয়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন এলাকাবাসী ও কর্মচারীরা।

Advertisement

মঙ্গলবার (২ জানুয়ার) রাতে তার মরদেহ এলাকায় পৌঁছালে যবিপ্রবির প্রধান গেটের সামনে সড়ক অবরোধ করে ঘণ্টাব্যাপী এ বিক্ষোভ করা হয়। এ সময় কর্মচারী সমিতির নেতৃবৃন্দ ও এলাকাবাসী মফিজুরের মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত ও জড়িতদের শাস্তির দাবি করেন।

এর আগে গত শুক্রবার রাতে (২৯ ডিসেম্বর) গায়ে আগুন দেওয়ার পর সোমবার রাতে (১ জানুয়ারি) ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন যবিপ্রবির জ্যেষ্ঠ চালক মফিজুর রহমান। মৃত্যুর আগে ঢাকায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ফেসবুক ভিডিওতে তিনি কর্মস্থলে ‘মানসিক নির্যাতনের’ অভিযোগ করেন এবং মারা গেলে যবিপ্রবির পরিবহন দপ্তরের পরিবহন প্রশাসক প্রফেসর ড. জাফিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করেন।

মফিজুরের গায়ে আগুন দেওয়ার পর পরিবহন প্রশাসক প্রফেসর ড. জাফিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে রেজিস্ট্রার বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন যবিপ্রবি’র ২২ জন চালক ও হেলপার।

Advertisement

মঙ্গলবার রাতে মফিজুর রহমানের মরদেহ যশোরে পৌঁছালে যবিপ্রবি কর্মচারীরা ও এলাকাবাসী মরদেহ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নেন। সেখানে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। ঘণ্টাব্যাপী অবরোধ কর্মসূচিতে যশোর-চৌগাছা সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সড়কের দুই ধারে যানজটের সৃষ্টি হয়।

অবরোধকালে মফিজুরের মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত ও জড়িতদের শাস্তির দাবি করে বক্তব্য দেন, কর্মচারী সমিতির নেতা বদরুজ্জামান বাদল, মোহাম্মদ শাহিন, গোলাম রসুল, সাবেক ইউপি মেম্বার সবুর হোসেন প্রমুখ।

যবিপ্রবি সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পারিবারিক মামলার অভিযোগ তুলে যবিপ্রবির জ্যেষ্ঠ চালক মফিজুর রহমানকে প্রায় ছয় মাস বসিয়ে রাখা হয়। এসময় তাকে কোনো গাড়ি চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। সম্প্রতি ‘জব অব নেচার’ পরিবর্তন করে তাকে অফিসের কাজে সংযুক্ত করতে চিঠি দেওয়া হয়। এছাড়াও তিনিসহ চালক ও হেলপারদের নানাভাবে মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে পরিবহন প্রশাসক প্রফেসর ড. জাফিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে। ওই চিঠি পাওয়ার পর ‘পিয়নের কাজ করতে হবে’ এই মানসিক যন্ত্রণায় মফিজুর ২৯ ডিসেম্বর রাতে বাড়িতে নিজের গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। এ সময় পরিবারের সদস্যরা টের পেয়ে আগুন নিভিয়ে তাকে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসাপাতালে নিয়ে যান। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় সেখান থেকে দ্রুত তাকে ঢাকায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পাঠানো করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার রাতে (০১ জানুয়ারি) তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এর আগে ফেসবুক ভিডিওতে মফিজুর রহমান বলেন, ‘গত ৮ মাস জাফিরুল স্যার আমাকে অন্যায়ভাবে বসিয়ে রেখেছেন। গত দু’দিন আগে অফিসিয়াল কাজের জন্য চিঠি দিয়েছে এবং বলেছে আমাকে আর কখনোই গাড়ি দেবে না। এ কারণে মনের কষ্টে ক্ষোভে আমি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলাম।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি যদি মরে যাই তাহলে ওই পরিবহন প্রশাসকের শাস্তির ব্যবস্থা করবেন।’ এদিকে, মফিজুর গায়ে আগুন দেওয়ার পর পরিবহন দপ্তরের প্রশাসক ‘উপাচার্যপন্থী শিক্ষক’ প্রফেসর ড. জাফিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে অসৌজন্যমূক আচরণের অভিযোগ এনে কর্মচারী সমিতির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর তার অপসারণ দাবিতে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ২২ জন চালক ও হেলপার। অভিযোগে বলা হয়েছে, পরিবহন দপ্তরের পরিবহন প্রশাসক প্রফেসর ড. জাফিরুল ইসলাম যোগদান করার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবহন দপ্তরের কর্মরত ড্রাইভার-হেলপারদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। তেল মাপা কমিটি কর্তৃক মাইলেজ নির্ধারণ করে দেওয়ার পরও পরিবহন প্রশাসক বিভিন্ন সময় কর্মরত ড্রাইভার-হেলপারদের তেল চোর বলেন।

Advertisement

এমনকি তারা মসজিদে নামাজ পড়তে গেলেও বলেন, ‘তোরা তো তেল চোর তোদের নামাজ পড়ে কী হবে?’ এভাবে তাদেরকে বিভিন্নভাবে হেয়প্রতিপন্ন করেন। এছাড়া একজন সিনিয়র ড্রাইভারকে বিনা অপরাধে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় সিনিয়র ড্রাইভার মফিজুর রহমানকে অফিসের দায়িত্ব দেওয়া হলে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং অপমানিত হওয়ায় রাতে গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করতে যান। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, অগ্নিদগ্ধ মফিজুর হাসপাতালে যাওয়ার সময় তার স্ত্রীকে বলে যান ‘আমার যদি কিছু হয় তুমি যানবাহন কর্মকর্তা ও পরিবহন প্রশাসকের নামে মামলা করবে।’

এসব অভিযোগের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন দপ্তরের পরিবহন প্রশাসক প্রফেসর ড. জাফিরুল ইসলাম বলেন, সকল অভিযোগ মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন। ড্রাইভার মফিজুর রহমানের চরিত্র ভালো না। কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হেলপারের স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে বিয়ে করেছেন। এখন তার দুই স্ত্রী। এসব কারণে তার বিরুদ্ধে মামলা হওয়ায় তাকে গাড়ি থেকে সরিয়ে এনে পরিবহন পুলের গাড়ির সুপারভিশন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। রেজিস্ট্রারসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও বিষয়টি সম্পর্কে অবগত। মূলত পারিবারিক বিষয় নিয়ে কলহে সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। পারিবারিক কারণে সে গায়ে আগুন দিতে পারে।

ভিডিওতে অভিযোগের ব্যাপারে তিনি উল্লেখ করেন, তাকে দিয়ে একটি মহল ওইসব কথা বলিয়েছে।

এ বিষয়ে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, একজন সহকর্মীর স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর তাকে ‘গ্রাউন্ডস্’ করা হয়েছে। শুধু মফিজুর নয়; তিনজন চালকের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এরপরও যেহেতু সে সিনিয়র ড্রাইভার এ কারণে তাকে গাড়িগুলোর অফিসিয়াল সুপারভাইজারি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ফলে তার অভিযোগ সঠিক নয়। এরপরও যেহেতু অভিযোগ পাওয়া গেছে এজন্য তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। প্রতিবেদনের আলোকে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

মিলন রহমান/এফএ/এএসএম