লোকাল বাসে বা ট্রেনে হকারদের মুখে হরহামেশাই শোনা যায় ‘খাইতে মজা, তিলের খাজা’। আগ্রহী যাত্রীরাও হাত বাড়ান ‘দেখি’ বলে। দাম জেনে কিনে নেন অনেকে। আবার অনেকের প্রশ্ন ‘আসল না নকল ?’ তবে এ নিয়ে হকারদের বেশি কথা বলতে শোনা যায় না। কারণ তিলের খাজা নকল করার কিছু নেই। নেই কোনো আধুনিকতা। সেই সনাতন পদ্ধতিইে হাতে তৈরি হয় তিলের খাজা। কিন্তু এই খাজার রয়েছে ‘সমৃদ্ধ ইতিহাস’।
Advertisement
দেশের ঐতিহ্যবাহী খাবারের তালিকায় দিনাজপুরের তিলের খাজা স্থান করে নিয়েছে। জনপ্রিয়তার দিক দিয়েও দারুণভাবে এগিয়ে স্বল্পমূল্যের এই স্থানীয় খাবারটি।
উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য জেলাতেও দিনাজপুরের তিলের খাজার উপস্থিতি মেলে। শত বছরের এই খাদ্যপণ্যটি এখন ক্ষুদ্র শিল্পে রূপ নিলেও এটি প্রায় বিলুপ্তির পথে। দিনাজপুর ছাড়াও এটি উৎপাদিত হয় অন্য জেলাতেও। বাবা-দাদার পেশাকে টিকিয়ে রেখেছে কিছু পরিবার।
দিনাজপুরে ঠিক কবে থেকে এই তিলের খাজার উৎপাদন শুরু হয় এর সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। ইতিহাস অনুসারে, অবিভক্ত ভারতের উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর জেলার সদর উপজেলার ৬নং আউলিয়াপুর ইউনিয়নের তাঁতী পাড়ায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মহন্ত সম্প্রদায়ের ৮-১০টি পরিবারের মানুষ এ খাবার তৈরি করতেন।
Advertisement
দিনাজপুরের ইতিহাস সন্ধানী কিছু মানুষের বিশ্বাস, ১৯০০ সাল বা তার আগে পরের কাছাকাছি সময়ে ‘তাঁতী’ সম্প্রদায়ের লোকদের মাধ্যমে এই খাবারটি প্রথম দিনাজপুরে তৈরি হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ওই গ্রামে ‘তাঁতি’ সম্প্রদায়কে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে কয়েকটি পরিবারকে ১০-১৫ বছর আগেও তিলের খাজা তৈরি করতে দেখা যেতো। তাঁতি পাড়ায় কয়েকটি খাজা তৈরির পারিবারিক কারখানা গড়ে ওঠে। কিন্তু তিলের দুঃপ্রাপ্ততা, চিনি-গুড়ের দাম বৃদ্ধি ও কঠোর পরিশ্রমের উপযুক্ত মজুরি ও খাজা তৈরির জন্য আধুনিক কোনো যন্ত্রপাতি আবিস্কৃত না হওয়ায় দিনাজপুরে ধীরে ধীরে তিলের খাজা তৈরি বিলুপ্ত হতে থাকে। পেশা পরিবর্তন করে অনেকে চলে যান অন্য পেশায়।
কিন্তু বাবা-দাদার পেশাকে বদলাতে পারেননি ওই গ্রামের শংকর মহন্ত (৫৫)। স্ত্রী, ছোট ভাই ও পরিবারের অন্যান্য ১০ জন সদস্যকে নিয়ে এখনো তৈরি করেন তিলের খাজা। দিনাজপুরে একমাত্র তার পরিবারই এই তিলের খাজা তৈরি করছে।
তৈরির উপকরণ ও প্রক্রিয়া
সাধারণত ২ ধরনের তিলের খাজা তৈরি হয়ে থাকে। একটি তৈরি হয় চিনি, অন্যটি গুড় দিয়ে। চিনি বা গুড়ের সঙ্গে থাকে তিল। বড় লোহার কড়াইয়ে চিনি বা গুড় জ্বাল দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট তাপের পর তা চুলা থেকে নামানো হয়। হালকা ঠান্ডা হলে মিশ্রণটি জমানো সিরা বা 'লই' হয়।ওই সিরাকে শিংয়ের মতো গাছের ডাল বা লোহার আংটায় আটকে নিয়ে হাতে টানা হয়। এক পর্যায়ে তা বাদামি থেকে সাদা হলে কারিগররা বিশেষ কায়দায় তা হাতের ভাজে ভাজে টানতে থাকেন। তখন এর ভিতরটা ফাঁপা হতে থাকে।
Advertisement
ফাঁপা অংশগুলোকে বারবার টেনে টেনে ভাঁজ করা হয়, যাতে করে ভেতরে ফাঁপা ছিদ্র অনেক বেশি হয়। এরপর তা টেনে লম্বা করে রাখা হয় পরিষ্কার স্থানে। নির্দিষ্ট মাপে কেটে তাতে মেশানো হয় খোসা ছাড়ানো তিল। এভাবেই তৈরি হয় ‘তিলের খাজা’।
শংকর মহন্ত জানান, আরও এক ধরনের তিলের খাজা তারা তৈরি করেন। তাতে দুধ মেশানো হয়। এর উপকরণ দুধ, চিনি ও তিল। তবে সেটা খুব কম। অর্ডার পেলে তৈরি করে দেওয়া হয়।
বাড়ির সমানে উঠনে তিনদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ‘তিলের খাজা’ তৈরি হয়। চিনি ও গুড় স্থানীয় বাজার থেকে কেনা হলেও তিল কেনা হয় যশোর, ফরিদপুর ও চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে। তবে ভালোমানের তিল পাহাড়ি অঞ্চল থেকেও সংগ্রহ করা হয়।
প্রতি কড়াইয়ে ৭ কেজি চিনি অথবা গুড়, ৪ লিটার পানি আর দেড় কেজি তিল থেকে প্রায় ৮ কেজি খাজা হয়। প্রতিদিন তিনি পরিবারের ১০ জন সদস্যকে নিয়ে ৪০ কেজি খাঁজা তৈরি করতে পারেন। যা বাজারে বিক্রি করেন পাইকারি ২৪০ টাকা কেজি। এতে যা লাভ হয় তাতে সংসার চলে যায়।
দিনাজপুরে তিলে খাজা তৈরি বিলুপ্তপ্রায়
কুষ্টিয়া, ঢাকা, খুলনা, রাজবাড়ী, নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর ও গাজীপুরসহ অন্যান্য স্থানে তৈরি হয় তিলের খাজা। কিন্তু দিনাজপুরে এই একটি মাত্র পরিবার টিকিয়ে রেখেছে এই পেশা বা তিলের খাজা তৈরির ঐতিহ্য। সারাবছর ধরেই এখানে তৈরি হয় খাজা। প্রতিদিন ৪০-৫০ কেজি খাজা তৈরি হয়ে থাকে।
মালিকই শ্রমিক, শ্রমিকই মালিক
ওই পরিবারের সদস্যরাই তিলের খাজা তৈরির মালিক শ্রমিক। এটি পরিচালিত হয় পারিবারিক ব্যবসা হিসেবে। তারা পরিবারের ১০ জন সদস্য এক বেলা সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৬ ঘণ্টা কাজ করেন। পুঁজি বলতে প্রতিদিনের উৎপাদন ও উপকরণ খরচ।
এ ব্যবসার ধরনও ভিন্ন। প্রতিদিন সকাল ৬টার দিকে খাজা তৈরি শুরু হয়। দুপুর ১২টা পর্যন্ত উৎপাদন প্রক্রিয়া চলে। তৈরি হওয়া খাজা দুপুরে নিয়ে যান পাশে সিকদারহাট বাজারের দোকানে। বিক্রি শেষে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেন খাজা তৈরির উপকরণ নিয়ে। লভ্যাংশ দিয়ে পরিবারের খরচ মিটিয়ে যা থাকে তাই পরিবারের অন্যান্য খরচ ও জমা।
খাজা তৈরির প্রধান শংকর মহন্তের মামি লতা মহন্ত (৬০) এই মুহূর্তে দিনাজপুরে তিলের খাজা তৈরির সবচেয়ে প্রবীণ কারিগর। প্রায় ৪৫ বছর ধরে তিনি খাঁজা তৈরি করছেন। এ ব্যবসাটি পরিবারের ঐতিহ্যের অংশ। দেশ-বিদেশ থেকে অনেকে আসেন এখানকার তিলে খাজার তৈরি দেখতে।
তিনি বলেন, এই পরিবারে বউ হিসেবে আসার পর থেকেই দেখছেন তিলের খাজা তৈরি। এই গ্রামে এক সময় ৮-১০টি পরিবার তিলের খাঁজা তৈরি করতো। সবাই পেশা ছেড়েছে। আমরা একটি মাত্র পরিবার এই পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছি। এটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে সার্বিক সহায়তা দিয়ে এ শিল্পকে আরও শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হবে। তার মতে, ঋণ সহায়তা নিলে ব্যবসার লভ্যাংশ দিয়ে তা শোধ করা কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
তিনি বলেন, এই শিল্প অল্প সময়ের মধ্যে দিনাজপুরের মানুষের কাছে গল্পে পরিণত হবে।
শংকর মহন্তের ছোট ভাই পুলক কুমার মহন্ত (২৬) বলেন, আমরা পারিবারিকভাবে দেখতে দেখতেই খাজা তৈরি করতে শিখেছি। আমাদের পরিবারের তিলের খাজা তৈরিতে রয়েছে শত বছরের ঐতিহ্য। আমাদের আগে আমাদের বাবা ফনিন্দ্রনাথ মহন্ত খাজা তৈরি করতেন। তিনিও তার বাবার কাছে খাজা তৈরি শিখেছিলেন। বাবার কাছে শুনেছি তিনিও পরিবার নিয়ে এই তিলের খাজা তৈরি করতেন।
শংকর মহন্তের হিসাব মতে, এক কেজি চিনির দাম ১৪০ টাকার বেশি। তা দিয়ে খাজা হয় ৯০০ গ্রাম। এছাড়াও, আছে তিল ও জ্বালানিসহ অন্যান্য খরচ। সবকিছুর দাম বাড়লেও তিলের খাজার দাম বাড়ানো যাচ্ছে না। লাভ সীমিত।
টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে পড়েছে
উদ্যোক্তা বর্ণি আহমেদ ও রাকিব হাসান বলেন, ছোট পরিসরের শিল্প হলেও এর পরিচিতি বিশ্বজোড়া। পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। তিলের খাজার চাহিদাও রয়েছে। এই ক্ষুদ্র শিল্পকে প্রসারিত করে ব্যাপক মানুষের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। এই ব্যবসার জন্য যথেষ্ট পুঁজির প্রয়োজন। ব্যবসা আরও প্রসারিত হলে কয়েক হাজার মানুষের কাজের সুযোগ হবে।
এফএ/এএসএম