অর্থনীতি

ছোট হচ্ছে পোশাক পণ্যের বড় বাজার, বিকল্পের খোঁজে রপ্তানিকারকরা

ছোট হচ্ছে পোশাক পণ্যের বড় বাজার, বিকল্পের খোঁজে রপ্তানিকারকরা

দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশ আসে পোশাক শিল্পখাত থেকে। আর এই দেশীয় তৈরি পোশাকের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো। এরমধ্যে একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সর্ববৃহৎ বাজার যুক্তরাষ্ট্র। পোশাক রপ্তানি করে মোট আয়ের ৮৫ শতাংশ আসে এসব প্রচলিত বাজার থেকে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বড় বাজারগুলোতে বাংলাদেশের পোশাক পণ্যের রপ্তানি কমেছে। একই চিত্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির আরেক বড় বাজার কানাডায়ও। পোশাক পণ্যের বড় বাজারগুলোতে রপ্তানি কমায় চিন্তার ভাঁজ পড়েছে উদ্যোক্তাদের মাঝে। বাজারের এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে এ খাত থেকে দ্রুতই কমা শুরু হতে পারে রপ্তানি আয়।

Advertisement

তবে এরই মধ্যে বিকল্প বাজার সন্ধানের পথে হাঁটা শুরু করেছেন পোশাকখাতের উদ্যোক্তারা। তারা ইউরোপ-আমেরিকার ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নতুন বা অপ্রচলিত বাজারের দিকে ঝুঁকছেন। বড় বাজারগুলোর ওপর অতিনির্ভরতা এড়াতে অপ্রচলিত বাজার সম্প্রসারণে নেওয়া হয়েছে নানান উদ্যোগ। সরকারের পক্ষ থেকেও রপ্তানিতে দেওয়া হচ্ছে ৪ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা। সব মিলিয়ে দেশীয় পোশাক পণ্যের রপ্তানি মন্দার এ বাজারে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে পোশাকের অপ্রচলিত বা বিকল্প বাজার।

আরও পড়ুন: শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা না জরিমানা? 

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বড় বাজারগুলোতে রপ্তানি কমে যাওয়া তাদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে। শ্রম অধিকার রক্ষার ইস্যুতে রয়েছে নিষেধাজ্ঞার শঙ্কাও। আবার দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক ধরনের টানাপোড়েনও চলছে বাংলাদেশের। সব মিলিয়েই রপ্তানি বাজার নিয়ে উদ্বেগ বাড়ে উদ্যোক্তাদের। তবে বিকল্প বাজার তাদের আশা দেখাচ্ছে। যদিও নতুন বা অপ্রচলিত বাজারে এখন পর্যন্ত তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানির পরিমাণ তুলনামূলক কম।

Advertisement

 

ইউরোপ-আমেরিকার ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নতুন বা অপ্রচলিত বাজারের দিকে ঝুঁকছেন উদ্যোক্তারা। বড় বাজারগুলোর ওপর অতিনির্ভরতা এড়াতে অপ্রচলিত বাজার সম্প্রসারণে নেওয়া হয়েছে নানান উদ্যোগ। সরকারের পক্ষ থেকেও রপ্তানিতে দেওয়া হচ্ছে ৪ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা। সব মিলিয়ে দেশীয় পোশাক পণ্যের রপ্তানি মন্দার এই বাজারে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে পোশাকের অপ্রচলিত বা বিকল্প বাজার

 

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, ইউরোপীয় সদস্যভুক্ত দেশগুলোতে চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) যে পরিমাণ পোশাক পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, তা গত অর্থবছরের একই সময়ের (প্রথম পাঁচ মাস) তুলনায় শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ কম।

২০২২-২৩ অর্থবছরে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে আগের অর্থবছরের চেয়ে তৈরি পোশাক পণ্যের রপ্তানি বেড়েছিল প্রায় ১০ শতাংশ। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে বেড়েছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৪ শতাংশ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে বাড়ে আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৪ শতাংশ।

বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল মনে করছেন, বৈশ্বিকভাবে ২০২৩ সাল পোশাক খাতের জন্য ২০২২ সালের মতো এতটা ভালো ছিল না। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) তথ্যের বরাতে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, সংস্থাটির তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালে বৈশ্বিকভাবে মোট পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৫৭৬ বিলিয়ন ডলারের। ২০২৩ সালে তা কিছুটা কমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এরই মধ্যে ইউরোপ-আমেরিকার বাজারগুলো পোশাকের ক্রয়াদেশ বা আমদানি কমিয়েছে।

Advertisement

আরও পড়ুন: নতুন বাজারে বাড়ছে পোশাক রপ্তানি 

ডব্লিউটিওর ওই প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, পোশাক রপ্তানিতে চীনের পরেই দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রাখে বাংলাদেশ। বছরজুড়ে বিশ্ববাজারে বিক্রি হওয়া ৫৭৬ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাকের মধ্যে চীন রপ্তানি করেছে ১৮২ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক, যা ছিল মোট বাজারের ৩১ দশমিক ৬৭ শতাংশ। একই বছর (২০২২ সালে) তৈরি পোশাক মার্কেটের ৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ বাংলাদেশের দখলে ছিল, যা আগের বছর ২০২১ সালে ছিল ৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ।

 

চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসে ইউরোপের দেশগুলোয় রপ্তানি হয়েছে ৯০৫ কোটি ডলারের পোশাক পণ্য, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে (প্রথম পাঁচ মাস) ছিল ৯০৭ কোটি ডলার। অর্থাৎ, এসময় ইইউভুক্ত দেশসমূহে পোশাকের মোট রপ্তানি আয় ৪৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ থেকে ৪৭ শতাংশে নেমেছে

 

আর্থিক বিবেচনায় ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে মোট পোশাক রপ্তানি হয় ৪৫ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারের, যেখানে প্রবৃদ্ধি হয় ৩২ দশমিক ৬০ শতাংশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে শীর্ষ আটটি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হলো যথাক্রমে- চীন, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, তুরস্ক, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র।

মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, নতুন বছর (২০২৪ সালে) সার্বিকভাবে আমরা একটু চাপেই থাকবো। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের তৈরি পোশাকের চাহিদা বাড়ার ইঙ্গিতও পাচ্ছি। আমরা যদি অভ্যন্তরীণ সাপ্লাই চেন ঠিক রাখতে পারি আর নতুন পণ্য ও বাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে পারি, তাহলে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারবো।

তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসে ইউরোপের দেশগুলোয় রপ্তানি হয়েছে ৯০৫ কোটি ডলারের পোশাক পণ্য, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে (প্রথম পাঁচ মাস) ছিল ৯০৭ কোটি ডলার। অর্থাৎ, এসময়ে ইইউভুক্ত দেশসমূহে পোশাকের মোট রপ্তানি আয় ৪৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ থেকে ৪৭ শতাংশে নেমেছে।

আরও পড়ুন: শঙ্কা কাটছে না পোশাক খাতে, রপ্তানিতে ভাটা 

এরমধ্যে অন্যতম বৃহৎ বাজার জার্মানিতে গত পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রপ্তানি কমেছে ১৫ শতাংশ। দেশটিতে আলোচিত সময়ে বাংলাদেশের পোশাক পণ্য রপ্তানি হয়েছে ২৩১ কোটি ডলারের, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২৭২ কোটি ডলার। এ হিসাবে রপ্তানি কমেছে ৪১ কোটি ডলারের। যুক্তরাষ্ট্রে গত পাঁচ মাসে পোশাক রপ্তানি কমেছে ৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ। দেশটিতে গত অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ৩৪৮ কোটি ডলারের পোশাক বিক্রি হলেও চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা ৩২৮ কোটি ডলারে নেমেছে। এ হিসাবে মার্কিন মুলুকে রপ্তানি কমেছে ২০ কোটি ডলারের।

পোশাক রপ্তানির এ অবনমনকে উদ্বেগের জানিয়ে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান জাগো নিউজকে বলেন, পোশাক রপ্তানির সিংহভাগই আসে প্রচলিত বড় বড় বাজার থেকে। এসব বাজারে রপ্তানি কমে আসা উদ্বেগের। প্রচলিত বাজারে রপ্তানি কমার ফলে সার্বিকভাবে অর্থবছর শেষে পোশাক রপ্তানি ঋণাত্মক ধারায় যেতে পারে। অন্যদিকে নতুন তথা অপ্রচলিত বাজারে ধীরে ধীরে রপ্তানি বৃদ্ধিও দেশের পোশাকশিল্পের জন্য ইতিবাচক ইঙ্গিত।

এ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানির গতি বেশ ধারাবাহিক। বৈশ্বিক নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও নতুন বাজারে রপ্তানি বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) অন্যসব বাজারের তুলনায় অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানি বেড়েছে। সেসব বাজারের প্রতি রপ্তানিকারকদের যেমন আস্থা বাড়ছে, অন্যদিকে আমদানিকারকরাও বাংলাদেশের তৈরি পোশাকে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। সর্বোপরি, উদ্যোক্তাদের নানা উদ্যোগ এবং রপ্তানিতে সরকারের নগদ সহায়তা অপ্রচলিত বাজার সম্প্রসারণকে উৎসাহিত করছে।

 

যুক্তরাষ্ট্রে গত পাঁচ মাসে পোশাক রপ্তানি কমেছে ৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ। দেশটিতে গত অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ৩৪৮ কোটি ডলারের পোশাক বিক্রি হলেও চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা ৩২৮ কোটি ডলারে নেমেছে। এ হিসাবে মার্কিন মুলুকে রপ্তানি কমেছে ২০ কোটি ডলারের

 

অপ্রচলিত বাজারের মধ্যে ১৮টি দেশে তুলনামূলকভাবে বেশি পোশাক বিক্রি করে বাংলাদেশ। যার মধ্যে অন্যতম প্রধান বাজার জাপান। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) জাপানে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৩৯ শতাংশেরও বেশি। এসময়ে দেশটিতে পোশাক রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ৪৫ কোটি ডলারের। অপ্রচলিত দ্বিতীয় প্রধান বাজার অস্ট্রেলিয়া। যেখানে জাপানের চেয়েও বেশি হারে রপ্তানি বেড়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় রপ্তানি বেড়েছে ৫৪ শতাংশ হারে। অপ্রচলিত এ বাজারেও রয়েছে রপ্তানি ধারাবাহিকতা। অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে দেশটিতে মোট ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে।

আরও পড়ুন: ২৩৩৯টির মধ্যে সরাসরি অর্ডার পায় ১৬০০ পোশাক কারখানা 

বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, বিজিএমইএতে আমরা দায়িত্ব নেওয়ার আগে থেকেই পোশাক পণ্যের রপ্তানিতে নতুন তথা বিকল্প বাজার তৈরিতে উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছি। আমরা সেভাবেই কাজ করেছি। কূটনৈতিকভাবেও নানান সহযোগিতা নিয়ে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পোশাকের ব্র্যান্ডিং করেছি।

তিনি বলেন, প্রচলিত বাজারে রপ্তানি কমে যাওয়া ভাবিয়ে তুলেছে আমাদের। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে তা রপ্তানি খাতের জন্য বিপদের কারণ হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং শ্রম অধিকার রক্ষার ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞার শঙ্কা আগামী দিনে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে প্রভাব ফেলবে কি না, তা নিয়ে রপ্তানিকারকদের উদ্বেগ রয়েছে। এছাড়া মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে নীতি সুদহার বাড়িয়ে আমদানি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ।

ইএআর/এমকেআর/জিকেএস