মাত্র এক সপ্তাহ পরই দেশে জাতীয় নির্বাচন। এ মুহূর্তে নির্বাচনী এলাকাগুলোতে চলছে ভোটের প্রচার-প্রচারণা। প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন। নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজের পক্ষে ভোট চাইছেন। সব মিলিয়ে সারাদেশে এখন ভোটের আমেজ। এর বাইরে নয় রাজধানী ঢাকাও। ব্যস্ততম এই নগরীর প্রায় সব অলিগলি ও গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে শোভা পাচ্ছে প্রার্থীদের ব্যানার-পোস্টার। এখানেও সমান তালে চলছে গণসংযোগ।
Advertisement
ঢাকার ২০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে বরাবরই আলোচনার কেন্দ্রে থাকে ঢাকা-১০ আসনটি। ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, নিউমার্কেট ও কলাবাগান এই চার থানার আওতাভুক্ত এলাকা নিয়ে গঠিত এ আসনটিকে অনেকটা অভিজাত হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১০ সংসদীয় আসন থেকে ভোটের লড়াইয়ে অংশ নেওয়া সব প্রার্থীই এখন প্রচার-প্রচারণায় কমবেশি সরব। ব্যানার-পোস্টার টানিয়ে, মাইকিং এবং গণসংযোগ করে ভোটের প্রচারে দিন-রাত ঘাম ঝরাতে দেখা যাচ্ছে সেখানকার প্রার্থীদের৷
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮ ও ২২ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত ঢাকা-১০ আসনে ভোটার সংখ্যা তিন লাখ ২৪ হাজার ৯৩৯ জন। তাদের মধ্যে পুরুষ এক লাখ ৭৩ হাজার ২৭৫ জন, নারী এক লাখ ৫১ হাজার ৬৬১ জন এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন তিনজন।
আরও পড়ুন: স্ত্রীর চেয়ে সম্পদ কম ফেরদৌসের
Advertisement
বিগত কয়েকটি নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঢাকার এই আসনে সর্বশেষ নির্বাচন (উপনির্বাচন) অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০২০ সালের ২১ মার্চ৷ এ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় মনোনায়ন পেলে আসনটি ছেড়ে দেন৷ সেই উপনির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন ৷
এ আসনটিকে অনেকটা অভিজাত হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১০ সংসদীয় আসন থেকে ভোটের লড়াইয়ে অংশ নেওয়া সব প্রার্থীই এখন প্রচার-প্রচারণায় কমবেশি সরব। ব্যানার-পোস্টার টানিয়ে, মাইকিং এবং গণসংযোগ করে ভোটের প্রচারে দিন-রাত ঘাম ঝরাতে দেখা যাচ্ছে সেখানকার প্রার্থীদের
ওই উপনির্বাচনে নৌকার প্রার্থী শফিউল ইসলাম পেয়েছিলেন ১৫ হাজার ৯৯৫ ভোট৷ তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি মনোনীত প্রার্থী শেখ রবিউল আলম পেয়েছিলেন ৮৭১ ভোট৷ অন্য প্রার্থীদের মধ্যে জাতীয় পার্টির হাজী মো. শাহজাহান ৯৭ ভোট, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল-পিডিপির কাজী মুহাম্মদ আব্দুর রহিম ৬৩ ভোট, বাংলাদেশ মুসলিম লীগের নবাব খাজা আলী হাসান আসকারী ১৫ ভোট এবং বাংলাদেশ কংগ্রেসের মো. মিজানুর রহমান পেয়েছিলেন ১৮ ভোট। ওই উপনির্বাচনে মোট ভোট পড়েছিলো ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ৷
ঢাকা-১০ আসনের গত সাতটি সংসদ নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, পাঁচটিতেই জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ৷ বাকি দুটি নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন৷ এরমধ্যে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয় পান ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা আবদুল মান্নান৷ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এইচ বি এম ইকবাল, ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির আবদুল মান্নান, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ কে এম রহমতুল্লাহ এবং ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস জয়লাভ করেন৷ সে হিসাবে এ আসনটিকে আওয়ামী লীগের বেশ শক্ত ঘাঁটিই হিসেবেই ধরা হয়৷ সবশেষ উপনির্বাচনে নৌকার প্রার্থী শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন ১৫ হাজার ভোট পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন।
Advertisement
গত কয়েকদিনে সরেজমিনে ঢাকা-১০ আসনের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রার্থীরা গণসংযোগে ব্যস্ত সময় পার করছেন৷ তাদের কর্মী-সমর্থকরা রাস্তায় রাস্তায় পোস্টার লাগাচ্ছেন এবং মানুষকে ভোটদানে উৎসাহিত করছেন। তবে এই আসনে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থী চিত্রনায়ক ফেরদৌস আহমেদের প্রচারণা সবচেয়ে তুঙ্গে। ব্যানার-পোস্টারেও তার উপস্থিতি বেশি। চলচ্চিত্রের পরিচিত মুখ হওয়ায় ভোটের রাজনীতিতেও ভোটারদের কাছে বাড়তি আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছেন ফেরদৌস৷ আসনটিতে আওয়ামী লীগের কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী না থাকায় ঐক্যবদ্ধভাবে জমজমাট প্রচারণা চালাচ্ছেন তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা৷
এবারের নির্বাচনে ঢাকা-১০ আসনে মোট পাঁচজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন৷ আসনটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী চিত্রনায়ক ফেরদৌস আহমেদ নৌকা প্রতীকে, জাতীয় পার্টি থেকে হাজী মো. শাহজাহান লাঙ্গল প্রতীকে, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি থেকে এ কে এম শামসুল আলম আম প্রতীকে, বিএনএফ থেকে মো. বাহারানে সুলতান বাহার টেলিভিশন প্রতীকে এবং গণমুক্তি জোট থেকে শাহরিয়ার ইফতেখার ছড়ি প্রতীকে ভোটে লড়ছেন।
ঢাকা-১০ আসনের গত সাতটি সংসদ নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, পাঁচটিতেই জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ৷ বাকি দুটি নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন৷ সে হিসাবে এ আসনটিকে আওয়ামী লীগের বেশ শক্ত ঘাঁটিই হিসেবেই ধরা হয়৷ সবশেষ উপনির্বাচনে নৌকার প্রার্থী শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন ১৫ হাজার ভোট পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন।
এ আসনের এমপি প্রার্থী গণমুক্তি জোটের চেয়ারম্যান এবং সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের উপদেষ্টা শাহরিয়ার ইফতেখার জাগো নিউজকে বলেন, আমি ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছি৷ একদিকে গণসংযোগ ও পোস্টারিং চলছে, অন্যদিকে লিফলেট বিতরণ হচ্ছে। আমার লোকজন বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে, মাইকিং হচ্ছে৷ অনলাইনসহ যত ধরনের প্রচারণার মাধ্যম আছে সবকিছুতেই আমরা সরব আছি।
আরও পড়ুন: নৌকা পেয়েই ভোটের প্রচারে নায়ক ফেরদৌস
ভোটের প্রচারে সাধারণ মানুষের সাড়া কেমন পাচ্ছেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব দল তো নির্বাচনে নেই৷ যারা নির্বাচনে নেই তাদের সমর্থকদেরও নির্বাচনের প্রতি তেমন আগ্রহ নেই৷ আমার প্রতি জনগণের আগ্রহ রয়েছে৷ আমার পাশে জনগণ থাকবে, এটা নিশ্চিত। কিন্তু কত শতাংশ ভোটার ভোটকেন্দ্রে যাবেন এটাই এখন বড় কথা৷ আমার মনে হয় না খুব বেশি ভোটার ভোট দিতে যাবেন৷ সর্বোচ্চ ২০ থেকে ৩০ শতাংশ মানুষ ভোট দিতে যেতে পারেন৷ তাদের মধ্যে ৬০ শতাংশই আমার পক্ষে থাকবে৷
প্রচারণা আশাব্যঞ্জক হলেও অভিযোগও আছে এই প্রার্থীর। তিনি বলেন, আমার বাসা এবং অফিস পাশাপাশি৷ আমার বাসার সামনে আওয়ামী লীগের অফিস বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল৷ নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দেয়ার পর তা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে৷ আমি অফিস থেকে বের হলে আওয়ামী লীগের ছেলেরা ‘ভুয়া ভুয়া’ চিৎকার করতে থাকে৷ এটা কোনো আচরণবিধি হতে পারে না৷ শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন ছড়ি প্রতীকের এই প্রার্থী।
নির্বাচনী প্রচারণার বিষয়ে বিএনএফ মনোনীত টেলিভিশন প্রতীকের প্রার্থী বাহারানে সুলতান বাহার জাগো নিউজকে বলেন, আমরা সীমিত আকারে প্রচারণা চালাচ্ছি৷ জনগণের কাছে গেলে মুভমেন্ট ফিরে যায়৷ জনগণের কাছে গেলে তারা যে হাসিমুখে ফুটন্ত ফুলের মত গ্রহণ করবে সেভাবে নেয় না৷ এ বিষয়টি আমাদের বেদনাদায়ক অবস্থায় ফেলে দিয়েছে৷ আমি মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে এ অবস্থা দেখেছি৷
জানা গেছে, এ আসনে আওয়ামী লীগ শক্তিশালী অবস্থানে থাকলেও দলীয় কিছু অন্তর্কোন্দল এখন পর্যন্ত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। গত শনিবার (৩০ ডিসেম্বর) দুপুরে সেন্ট্রাল রোডে ফেরদৌসের প্রচারণায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে৷ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওইদিন ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে ফেরদৌসের গণসংযোগ ছিল
ন্যাশনাল পিপলস পার্টি থেকে আম প্রতীকে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া এ কে এম শামসুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, নির্বাচনের পরিবেশ সুষ্ঠু আছে৷ আমাদের নেতাকর্মীরা প্রচারণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন৷ ব্যানার-পোস্টার টানানো হয়েছে৷ আমি নিজেও জনগণের কাছে যাচ্ছি৷ খুব ভালো সাড়া পাচ্ছি৷ আমাদের প্রচারণা আরও বাড়ানো হবে৷
আরও পড়ুন: রাজনীতি ও নির্বাচনের মাঠে সরব তারকারা
জাতীয় পার্টি প্রার্থী হাজী মো. শাহজাহানকেও বেশ আঁটঘাট বেঁধে প্রচারণা চালাতে দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় পোস্টার টানিয়েছেন৷ লাঙ্গল প্রতীকের পক্ষে রাস্তায় রাস্তায় নির্বাচনী গান বাজিয়ে ভোটারদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছেন। তিনি নিজেও ওয়ার্ডভিত্তিক গণসংযোগ করছেন৷ তবে নির্বাচনী প্রচারণার হালচাল জানতে এই প্রার্থীকে একাধিকবার ফোনকল করলেও তিনি রিসিভ করেননি৷
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ আসনে আওয়ামী লীগ শক্তিশালী অবস্থানে থাকলেও দলীয় কিছু অন্তর্কোন্দল এখন পর্যন্ত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। গত শনিবার (৩০ ডিসেম্বর) দুপুরে সেন্ট্রাল রোডে ফেরদৌসের প্রচারণায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে৷ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওইদিন ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে ফেরদৌসের গণসংযোগ ছিল৷ এসময় সেন্ট্রাল রোডে প্রয়াত সংগীতশিল্পী সুবীর নন্দীর মেয়ের বাসায় যান তিনি৷ এসময় নিচে থাকা ১৮ এবং ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের সমর্থকদের মধ্যে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে উভয়পক্ষ সংঘর্ষে জড়ায়।
পরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ঢাকা-১০ আসনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী সমন্বয়ক টিমের সদস্যসচিব ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাজী মোরশেদ হোসেন কামাল তাৎক্ষণিভাবে মিটমাট করে দেন৷
ওই সংঘর্ষে জনি বাবু (৩০), অনিন্দ্র চৌধুরি (২৩), শিশির (৩৫), রাসেল (৩০), আব্দুল জলিল (৩৮), সোহেল খান (২৮), মাহি (২৫), ইব্রাহিম, আলিফ (৩৫), উজ্জল হোসেনসহ (৩০) আরও বেশ কয়েকজন আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন৷
আরও পড়ুন: সংঘর্ষের ঘটনাকে ‘ভালোবাসার বাড়াবাড়ি’ বললেন ফেরদৌস
তবে এ বিষয়ে জানতে কাজী মোরশেদ হোসেন কামাল ও ফেরদৌস আহমেদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের পাওয়া যায়নি। পরে নৌকার নির্বাচনী কার্যালয়ে গিয়েও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে সংঘর্ষের দিন বিকেলেই সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ ঘটনাকে ‘ভালোবাসার বাড়াবাড়ি’ বলে উল্লেখ করেন ফেরদৌস।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা (অঞ্চল-১) ও ঢাকা-১০ আসনের সহকারী রিটার্নিং অফিসার মুহাম্মদ শফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, প্রার্থীরা আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলে ‘নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি’র মাধ্যমে যাচাই করে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷
এনএইচ/এমকেআর/এমএস