রাজনীতি

বাঁশখালীতে ভোটের চেহারা পাল্টে দিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা

দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে অনেকটা নির্বিঘ্নে জয় পায় আওয়ামী লীগ। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত ওই দুই নির্বাচনে বিজয়ী হন বর্তমান সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি না থাকায় বিএনপি-জামায়াতের দুর্গ হিসেবে খ্যাত আসনটিতে অনেকটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীনভাবে জয়ী হন নৌকার প্রার্থী। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী প্রয়াত জাফরুল ইসলাম চৌধুরীকে হারান মোস্তাফিজ। তবে এ নির্বাচন নিয়েও রয়েছে বিতর্ক।

Advertisement

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো অংশ না নিলেও বাঁশখালীতে উল্টে গেছে ভোটের সমীকরণ। স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই ভোটের চেহারা পাল্টে দিয়েছেন এবার। পাশাপাশি নানান ঘটনায় বিভিন্ন সময় সমালোচিত হন বর্তমান সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। আসন্ন নির্বাচনে তিনি নৌকার টিকিট পেলেও তার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগেরই দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী। ফলে আসন্ন নির্বাচনে প্রতিপক্ষের ইমেজের কাছেই আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভরাডুবি হবে বলে ধারণা অনেকের।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, ১৪টি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভা নিয়ে চট্টগ্রাম-১৬ আসন। এ আসনে ভোটার ৩ লাখ ৭০ হাজার ৭৭৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ এক লাখ ৯৭ হাজার ৮৭৬ জন, নারী এক লাখ ৭২ হাজার ৮৯৭। এছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন দুজন। নির্বাচনে ১০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

আরও পড়ুন: চট্টগ্রামের ১০ আসনে আওয়ামী লীগের ‘চ্যালেঞ্জ’ আওয়ামী লীগ 

Advertisement

এ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীরা হলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মুজিবুর রহমান সিআইপি, স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ কবির লিটন, স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. খালেকুজ্জামান, এনপিপির মুহাম্মদ মামুন আবছার চৌধুরী। এছাড়া রয়েছেন বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মো. মহিউল আলম চৌধুরী, কংগ্রেসের এম জিল্লুর করিম শরীফি, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের আবদুল মালেক, ন্যাপের আশীষ কুমার শীল ও ইসলামী ঐক্যজোটের মো. শওকত হোসেন। এসব প্রার্থীর মধ্যে মূলত আওয়ামী লীগের তিন নেতার মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে ধারণা স্থানীয় ভোটারদের। এদের মধ্যে মোস্তাফিজুর রহমান ‘নৌকা’, মুজিবুর রহমান ‘ঈগল’ এবং আবদুল্লাহ কবির লিটন ‘ট্রাক’ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

১৯৯১ সালের ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাঁশখালী আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী প্রয়াত সুলতাল উল কবির চৌধুরী জয়ী হন। তবে সেটাও স্বল্প ভোটের ব্যবধানে। ওই নির্বাচনে গৃহীত ভোটের এক-তৃতীয়াংশের কম ভোট পেয়ে জয়ী হন নৌকার প্রার্থী। এরপর থেকে তিনটি (৭ম, ৮ম ও ৯ম) নির্বাচনে বিএনপির জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর কাছে হারেন আওয়ামী লীগের সুলতান উল কবির চৌধুরী। পরের দুই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। তবে এর মধ্যে একটিতে বিএনপি অংশ নেয়নি, অন্য নির্বাচন নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। ফলে বলা যায়, ১৯৯১ সাল থেকে বাঁশখালীর ভোটের মাঠ কখনোই আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে ছিল না।

চলতি নির্বাচনের চিত্র একেবারে ভিন্ন। বিএনপি-জামায়াত ভোট বর্জনের কারণে তাদের সমর্থকদের বড় একটি অংশের কাছে নির্বাচন নিয়ে অনীহা রয়েছে। তবে বিএনপি-জামায়াতের অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোট দিতে আগ্রহী বলে ধরা হচ্ছে। অন্যদিকে বাঁশখালী উপকূলীয় এলাকা। এখানকার লোকজন শিক্ষা, চিকিৎসা সুবিধা থেকে দীর্ঘদিন পিছিয়ে ছিল। যদিও সময়ের ব্যবধানে চিত্র পাল্টেছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে স্কুল-কলেজ, ক্লিনিক। যার সুফল পাচ্ছেন স্থানীয় পর্যায়ের লোকজন। এ আসনে আওয়ামী লীগের বিপক্ষ ঘরানার লোকজন বেশি থাকলেও নানান হিসাব-নিকাশে বাঁশখালীর সাধারণ ভোটারদের একটি অংশ ভোটের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এতে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর চেয়ে স্বতন্ত্র দুই প্রার্থীর পাল্লা ভারী বলে মনে করছেন অনেকেই। এদের মধ্যে অন্যদের চেয়ে ভোটের মাঠে এগিয়ে মুজিবুর রহমান সিআইপি। বাঁশখালীর গ্রামীণ পর্যায়ে শিক্ষা বিস্তারে অবদান রাখা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সহযোগিতাসহ বিগত সময়ে নানান আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে জনপ্রিয় তিনি। বর্তমানে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির দায়িত্বে আছেন মুজিবুর রহমান। এর আগের মেয়াদে ছিলেন ওই কমিটির অর্থ সম্পাদক। যে কারণে স্থানীয় বাঁশখালী উপজেলাসহ চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে মুজিবুর রহমানের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের।

 

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেও তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিস্তর ফারাক রয়েছে মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর। বিগত সময়ে নির্বাচন কর্মকর্তাকে মেরে মামলার আসামি হন তিনি। পরে মামলা থেকে রেহাই পেলেও চলতি নির্বাচনে মনোনয়ন জমা দিতে গিয়ে সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হন।

Advertisement

 

আরও পড়ুন: ‘বিদেশি চাপ আমরা কেয়ার করি না’ 

আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ কবির লিটনের আলাদা একটি বলয় রয়েছে। বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান গালিব সাদলী নির্বাচনী মাঠে লিটনের পক্ষে। তিনিও জোর প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেও তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিস্তর ফারাক রয়েছে মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর। বিগত সময়ে নির্বাচন কর্মকর্তাকে মেরে মামলার আসামি হন তিনি। পরে মামলা থেকে রেহাই পেলেও চলতি নির্বাচনে মনোনয়ন জমা দিতে গিয়ে সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হন। এ নিয়েও তার বিরুদ্ধে মামলা করে নির্বাচন কমিশন। দুদিন পর স্থানীয় বাঁশখালী থানার ওসিকে গালমন্দ করে নতুন সমালোচনার জন্ম দেন। যার প্রভাব পড়ছে ভোটের রাজনীতিতে।

বৃহস্পতিবার (২৮ ডিসেম্বর) বাঁশখালীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে নির্বাচনের এই চিত্র দেখা মিলেছে।

বাঁশখালীর শেষপ্রান্তের দুই ইউনিয়ন পুঁইছড়ি এবং শেখেরখীল। চট্টগ্রাম থেকে যেতে নাপোরা বাজার পেরিয়ে ডানপাশে দেখা মেলে মাস্টার নজির আহমদ ডিগ্রি কলেজ। রাস্তার বাম পাশে চোখে পড়ে মাস্টার নজির আহমদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠান দুটিই মুজিবুর রহমান সিআইপি পরিবারের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত। কলেজটিতে ব্যবস্থাপনা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে স্নাকত পর্যন্ত পড়ানো হয়। প্রতি বছর কলেজটি থেকে শত শত শিক্ষার্থী বের হন।

আবার দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগ্রুপ স্মার্ট গ্রুপের মালিক মুজিবুর রহমানের পরিবার। তাদের ব্যবসা রয়েছে- তৈরি পোশাক রপ্তানি, টেক্সটাইল, কনটেইনার ডিপো, এনার্জি, রিয়েল এস্টেট, খাদ্য, মিডিয়া, ব্রোকার হাউজ, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদনসহ আরও বিভিন্ন খাতে। তাদের প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৩০ হাজার লোক সরাসরি কাজ করেন। এদের বড় অংশই বাঁশখালীর বাসিন্দা।

সরেজমিনে অসংখ্য স্থানীয় ভোটারের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাদের কথায় উঠে এসেছে বেশিরভাগ ভোটারেরই ভোটের ব্যাপারে অনীহা। নির্বাচন হবে কি না- সেটা নিয়েও সন্দিহান অনেকে। আরেক অংশের মতে, এবার আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে চরমভাবে মোকাবিলা করতে হচ্ছে নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের।

আরও পড়ুন: প্রতিদ্বন্দ্বীরা ‘লাইটওয়েট’, তবুও দিন-রাত গণসংযোগে সাঈদ খোকন 

ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমান সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর এলাকা সরল ইউনিয়নেও একচেটিয়া ভোট পেতে ব্যর্থ হবেন। তিনি পৌরসভা এলাকায় বেশি ভোট পেতে পারেন। যেখানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ভোট বেশি। পুরো উপজেলার প্রায় ৪৫ হাজার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একটি অংশই নৌকার পক্ষে থাকলেও আরেক অংশের ভোট পাবেন স্বতন্ত্র দুই প্রার্থী। স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল্লাহ কবির লিটনের নিজ ইউনিয়ন পুকুরিয়ায় আধিপত্য থাকবে। অন্য প্রার্থী মুজিবুর রহমান সিআইপির বাড়ি পুঁইছড়ি ইউনিয়নে। ওই ইউনিয়ন বাদে পাশের শেখেরখীল, ছনুয়া ও চাম্বল ইউনিয়ন একচ্ছত্র ভোট পেতে পারেন তিনি। ওই চার ইউনিয়নে রয়েছে এক লাখের কাছাকাছি ভোট। অন্য ৮ ইউনিয়নে তিনজনই ভোট পাবেন সমান্তরালে। যে কারণে ভোটারের দিক থেকে মুজিবুর রহমানই এগিয়ে অন্যদের চেয়ে।

ভোটাররা কী বলছেনচাঁনপুর এলাকায় কথা হয় আবুল কালাম নামের এক রিকশাচালকের সঙ্গে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবো কি না জানি না। আমরা খেটেখাওয়া মানুষ। বিগত সময়ে কোনো সুযোগ-সুবিধা পাইনি। রিকশা চালিয়ে সংসার চালাই। আমাদের ভোটের আর মূল্য কী! তবে এখানে সিআইপি মুজিবের সমর্থক বেশি।’

কালীপুর এলাকায় কথা হয় পশ্চিম বাঁশখালী এলাকার বাসিন্দা ফরিদ আহমদের সঙ্গে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘এই কদিনে বাঁশখালীর যেখানেই গিয়েছি, আমার মনে হচ্ছে, সিআইপি মুজিব যা পাবেন, অন্য দুজন মিলে তাই পাবেন।’

বৈলছড়ি এলাকার হারাধন দে বলেন, ‘এখানে মোস্তাফিজ, মুজিব, লিটন তিনজনই ভোট পাবেন। কে বিজয়ী হবেন, ভোটের দিন বোঝা যাবে।’

চেচুরিয়া এলাকার ৭৫ বছর বয়সী সৈয়দ আহমদ বলেন, ‘মসজিদ মাদরাসাত রোজাত চনাবুট, ইফতারি দে সিআইপি মুজিব। এন্ডে মুজিব বেশি ভোট পাইবু। যদি ভোটকেন্দ্রত যাই, আঁর মতন বউত মাইনষে তারে ভোট দিবু’। (রোজার সময় মসজিদ, মাদরাসায় ইফতার দেন সিআইপি মুজিব। এখানে মুজিব বেশি ভোট পাবেন। যদি কেন্দ্রে যাই, আমার মতো অনেক মানুষ তাকে ভোট দেবে)।

সরল ইউনিয়নের দেলা মার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী সুনীল দে জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা ভোট দিতে যাবো। তিনজনই শক্ত প্রার্থী। আগে থেকে কে জিতবে বলা মুশকিল। তবে ভোটে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে।’

আরও পড়ুন: ‘সাকিবের মাধ্যমে নেত্রীকে নৌকা উপহার দিতে চাই’ 

চাম্বল বাজারে বাদাম বিক্রি করেন পূর্ব চাম্বল গ্রামের আবুল কালাম। তিনি বলেন, ‘আঁরা গরিব মানুষ। বাজারত বাদাম বেচি সংসার চলাই। মাইনষে ভোটকেন্দ্রত যাইত পারিবু না হইত নঁ পারি। তয় পাইখ বেশি দেহা যার। গেইলি পাইখুত (ঈগল) দিয়্যুম’। (আমরা গরিব মানুষ। বাজারে বাদাম বিক্রি করে সংসার চালাই। লোকজন ভোটকেন্দ্রে যাবে কি না বলতে পারি না। তবে ঈগলের সমর্থন বেশি দেখা যাচ্ছে। যেতে পারলে ঈগলে ভোট দেবো।)

পূর্ব চাম্বল গ্রামে বাঁশখালী মূল সড়কে ধানের খড় শুকাচ্ছিলেন স্থানীয় ৫নং ওয়ার্ডের আনছার মিয়া। তিনি বলেন, ‘এখানে মুজিব এবং লিটনের সঙ্গে ফাইট (প্রতিদ্বন্দ্বিতা) হবে। তবে মুজিবের জনপ্রিয়তা বেশি। কারণ পুরো বাঁশখালীর মসজিদগুলো রোজা এলেই ইফতারি দেন। স্কুলের শিক্ষার্থীদের বই-খাতা দেন। পূজায় মন্দিরেও সহযোগিতা দেন। এখানকার শত শত মানুষকে তার কারখানায় চাকরি দিয়েছেন।’

নাপোরা বাজারের পান বিক্রেতা লক্ষ্মী চৌধুরী বলেন, ‘আমি নিজেই আওয়ামী লীগ করি। কিন্তু মুজিব আমাদের ঘরের ছেলে।’

একই এলাকায় কথা হয় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল ইসলামের সঙ্গে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘আমি গাছের ব্যবসা করি। পুঁইছড়ি ৯নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। আমাদের কমিটি হয়েছিল ২০০৯ সালে। সুলতান ভাই করেছিলেন। এইপর্যন্ত এমপি মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে সরাসরি কোনোদিন দেখা হয়নি। কখনো ডাকেননিও। আমার মতো তৃণমূলের কর্মীদের কোনো মূল্য নেই।’

এসব বিষয়ে কথা হয় এই আসনে নৌকা প্রতীকের প্রধান নির্বাচন সমন্বয়কারী বাঁশখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল গফুরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এখানে মোস্তাফিজুর রহমানই আওয়ামী লীগের প্রার্থী। আর কেউ নয়। আওয়ামী লীগ করলেও তারা (স্বতন্ত্র) এখন আওয়ামী লীগের নন। তাদের বিষয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। বিগত দিন যে উন্নয়ন হয়েছে, ওই উন্নয়নের কারণে লোকজন নৌকাকেই ভোট দেবে। এখানে নৌকাই জিতবে।’

ট্রাক প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল্লাহ কবির লিটনের প্রধান নির্বাচনী সমন্বয়কারী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান নুর হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘যেখানেই যাচ্ছি ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। এমপি মোস্তাফিজুর রহমানের নিজ ইউনিয়ন সরলে আমাদের পথসভায় কমপক্ষে ৫ হাজার মানুষ হয়েছে। বাঁশখালীর মানুষ পরিবর্তন চায়। আমরা জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী।’

স্বতন্ত্র প্রার্থী মুজিবুর রহমান সিআইপি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আল্লাহ আমাদের অনেক দিয়েছেন। বড় পরিসরে মানুষের সেবা করার জন্য ভোটে দাঁড়িয়েছি। এবার কেন্দ্রে ভোটার আনার জন্যই প্রধানমন্ত্রী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচন করার ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আশা করি বাঁশখালীর কেন্দ্রগুলো উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হবে। জয়ী হলে বাঁশখালীর উন্নয়ন চিত্রই পাল্টে যাবে।’

আরও পড়ুন: প্রতিশ্রুত লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড পাচ্ছি না 

বিগত ৬টি নির্বাচনে কোন দলের কত ভোট ১৯৯১ সালের ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাঁশখালী আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সুলতান উল কবির চৌধুরী ২৯ হাজার ৭০৪ ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী মাহমুদুল হক চৌধুরী পান ২৯ হাজার ৭৮ ভোট। জামায়াতের প্রার্থী ‘দাড়িঁপাল্লা’ প্রতীকে মৌলানা মুমিনুল হক চৌধুরী পেয়েছিলেন ২১ হাজার ২৭১ ভোট। বিএনপির ‘ধানের শীষ’ প্রতীকে আবু সালেহ চৌধুরী পান ৯ হাজার ৩০৮ ভোট। আসনটিতে সেবার ৯৩ হাজার ৭০৮টি ভোট পড়ে। ভোটার ছিল এক লাখ ৯০ হাজার ৮৬২ জন।

 

বেশিরভাগ ভোটারেরই ভোটের ব্যাপারে অনীহা। নির্বাচন হবে কি না- সেটা নিয়েও সন্দিহান অনেকে। আরেক অংশের মতে, এবার আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে চরমভাবে মোকাবিলা করতে হচ্ছে নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের।

 

১৯৯৬ সালের ১২ জুনের ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সুলতান উল কবির চৌধুরীকে হারান তখনকার ব্যবসায়ী নেতা বিএনপির প্রার্থী জাফরুল ইসলাম চৌধুরী। ওই নির্বাচনে জাফরুল ইসলাম চৌধুরী পান ৪৫ হাজার ৩৯২ ভোট। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সুলতাল উল কবির চৌধুরী ‘নৌকা’ প্রতীকে পান ৩৪ হাজার ৭৬ ভোট। বৈধ ভোটের ২৮ দশমিক ৫০ শতাংশ পান তিনি। নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী ১৮ হাজার ৬২৪ ভোট এবং জামায়াতের মৌলানা মুমিনুল হক চৌধুরী পান ১৮ হাজার ৭০ ভোট। নির্বাচনে মোট ২ লাখ ২৩ হাজার ৬৪ ভোটের মধ্যে ভোট পড়ে এক লাখ ২০ হাজার ৯১১টি।

২০০১ সালের ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও জাফরুল ইসলাম চৌধুরী বিজয়ী হন। ওইবার জাফরুল ইসলাম চৌধুরী ‘ধানের শীষ’ প্রতীকে পান এক লাখ ৮৫৬ ভোট। ‘নৌকা’ প্রতীকে সুলতান উল কবির চৌধুরী পান ৫৬ হাজার ৩১৪ ভোট। মোট ২ লাখ ২১ হাজার ৮৪১ ভোটের মধ্যে এক লাখ ৬৩ হাজার ২৮৮ জন ভোটার ভোট দেন।

২০০৯ সালের ৯ম জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলেও আসনটিতে জিতেছিল বিএনপি। বিএনপির প্রয়াত নেতা জাফরুল ইসলাম চৌধুরী ৯৯ হাজার ৮৯৫ ভোট পেয়ে অল্প ভোটের ব্যবধানে তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা সুলতান উল কবির চৌধুরী নৌকা প্রতীকে পেয়েছিলেন ৯১ হাজার ৮৭০ ভোট। সেবার ৮৫ দশমিক ৭২ শতাংশ ভোট পড়েছিল। মোট ভোটার ছিল ২ লাখ ২৭ হাজার ৯৮১।

২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসনটিতে ২ লাখ ৬৮ হাজার ২০৯ ভোটের মধ্যে এক লাখ ৫৫ হাজার ৯৯০ ভোট পড়ে। বিএনপি-জামায়াত ওই নির্বাচন বর্জন করে। নির্বাচনে ‘নৌকা’ প্রতীকে মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী এক লাখ ৪৭ হাজার ৮৫৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। জাতীয় পার্টি (জেপি) অ আ ম হায়দার আলী চৌধুরী ‘বাইসাইকেল’ প্রতীকে পেয়েছিলেন ৬ হাজার ৮৪৮ ভোট।

সবশেষ ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত অংশ নেয়। তবে দল দুটি নির্বাচনকে ‘রাতের ভোটের নির্বাচন’ আখ্যা দিয়ে ফল বর্জন করে। নির্বাচনে আসনটিতে মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী ‘নৌকা’ প্রতীকে পান এক লাখ ৭৫ হাজার ৩৫৭ ভোট। বিএনপির জাফরুল ইসলাম চৌধুরী ‘ধানের শীষ’ প্রতীকে পান মাত্র ২৬ হাজার ৩৭৭ ভোট। এছাড়া জাতীয় পার্টির মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী ‘লাঙ্গল’ প্রতীকে পান ১৮ হাজার ৬৩৫ ভোট এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জামায়াতের মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম ‘আপেল’ প্রতীকে পান ১৭ হাজার ১৬০ ভোট। ওই নির্বাচনে ৩ লাখ ৩ হাজার ১২৩ ভোটের মধ্যে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৩১৪টি ভোট পড়ে।

এমডিআইএইচ/কেএসআর/জিকেএস