আসন্ন নির্বাচনকেন্দ্রিক বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে ইদানীংকার আলোচিত বিষয়বস্তু আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারটি। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে দেশের চলমান রাজনীতির ধারাবাহিকতায় কোনো পরিবর্তন একেবারেই প্রত্যাশিত নয়। সঙ্গত কারণেই আওয়ামী লীগের সর্বশেষ নির্বাচনী ইশতেহারটি বাংলাদেশের আগামীর জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল। কারণ জনগণ যখন আরো একবার এবং টানা চতুর্থ মেয়াদে আওয়ামী লীগের উপর দেশ পরিচালনায় আস্থা রাখতে যাচ্ছেন, তখন এই দলটি আগামী পাঁচ বছর দেশটাকে কোন জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য কীভাবে কাজ করবে তা নিয়ে যারা রাজনীতি করেন-বোঝেন, তাদের আগ্রহ থাকাটাইতো সঙ্গত এবং এর উল্টোটাই বরং প্রত্যাশিত হতো না।
Advertisement
অতএব সঙ্গত কারণেই ইশতেহারটিকে নিয়ে কথাবার্তা, বিচার বিশ্লেষণ আর এর চুলচেরা ব্যবচ্ছেদ কম হচ্ছে না। বোদ্ধারা তাদের কাজটি করছেন, কাজেই আমি সেই জায়গাটায় যাচ্ছি না। সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচার-বিশ্লেষণের মাপকাঠিতে ইশতেহারটিকে মাপামাপির কোনো আগ্রহই আমার নেই। আমি বরং মোটাদাগে এই ইশতেহারটির যে দিকগুলো আমার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়েছে সে বিষয়গুলোর উপর আলোকপাত করতে চাই।
ইশতেহারটির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এতে আগামীর বাংলাদেশের রূপরেখাটি বিস্তারিতভাবে দেয়া আছে। আমার মনে হয় এই প্রথমবারের মত ‘কি হবে, কি করবো, কি করতে যাচ্ছি ইত্যাদি’ টাইপ ইশতেহারের গন্ডি পেরিয়ে বাংলাদেশ একটা অন্যরকম নির্বাচনী ইশতেহার পেলো। এই প্রথম একটি দল গর্বের সাথে তার ইশতেহারের বলতে পারছে যে ‘করেছি এবং আরো করবো’।
ডিজিটাল বাংলাদেশের যে স্বপ্ন ২০০৯-এর নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দেখিয়েছিল, রূপকল্প ২০২১-এর সফল বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে তা পরিপূর্ণতা পেয়েছে। সেই করতে পারা আর করে দেখানোর প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের এবারের ইশতেহারের বাংলাদেশকে চারটি মূল স্তম্ভের উপর দাঁড় করিয়ে এই ‘স্মার্ট সোনার বাংলায়’ রূপান্তরের ঘোষণা আছে। এই ইশতেহারটিতে এমন এক বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে যেই বাংলাদেশে নাগরিক-সরকার-সমাজ সবই হবে স্মার্ট। সেই বাংলাদেশে সব নাগরিকের জন্য থাকবে স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা আর সর্বজনীন পেনশন তাদের দিবে নিশ্চিন্ত অবসরের গ্যারান্টি।
Advertisement
কৃষির যান্ত্রিকীকরণ আর শিল্পের বিস্তার যেমন একদিকে বাংলাদেশের সব নাগরিকের জন্য কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দেবে, তেমনি গণতন্ত্রের অধিকতর চর্চা ও প্রসার সেই সব নাগরিকের রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করবে, কারণ এ দেশের সংবিধানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ঐ জনগণের হাতেই ন্যস্ত করা হয়েছে। এই ইশতেহারটি তাই এক কথায় একটি স্বপ্নালু ইশতেহার যা নতুন করে স্বপ্ন দেখাচ্ছে স্বপ্নের এক আগামীর বাংলাদেশের।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ইশতেহারটি ঘোষণা করে তার সরকারের ভুলত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনার উদারতা যেমন দেখিয়েছেন, তেমনি তার সরকারের সব সাফল্যের কৃতিত্ব তিনি উজাড় করে দিয়েছেন এদেশের মানুষকে এবং এর মাধ্যমেই তিনি প্রমাণ করেছেন যে তিনি কত বড় মাপের একজন নেত্রী।
ইশতেহারটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আওয়ামী লীগ দাবি করার চেষ্টা করেনি যে গত ১৫ বছরে তারা শুধু ভালো আর ভালোই করে গেছেন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ব্যাংকিং খাতে শৃংখলার অভাব কিংবা আইন শৃংখলা বাহিনীর জবাবদিহিতা নিয়ে মানুষের মনে যে সব প্রশ্ন মাঝে-সাঝেই উঁকি দেয় সে সবের বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়ে ইশতেহারে এসব ক্ষেত্রে সংশোধন এবং সংস্কারের কথা বলা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ইশতেহারটি ঘোষণা করে তার সরকারের ভুলত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনার উদারতা যেমন দেখিয়েছেন, তেমনি তার সরকারের সব সাফল্যের কৃতিত্ব তিনি উজাড় করে দিয়েছেন এদেশের মানুষকে এবং এর মাধ্যমেই তিনি প্রমাণ করেছেন যে তিনি কত বড় মাপের একজন নেত্রী। তার নির্বাচনী এই ইশতেহারটি তাকে এতটুকুও খাটো করেনি, বরং তিনি আরো একবার প্রমাণ করলেন তিনি কত বড়, কত বিশাল।
Advertisement
ইশতেহারটির সর্বশেষ যে দিকটি আমার কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যবহ বলে মনে হয়েছে, তা হলো ইশতেহারটিতে সাম্প্রদায়িকতা আর সন্ত্রাস প্রতিরোধকে সরকারের অন্যতম এজেন্ডা হিসেবে তুলে আনা হয়েছে। আমার পেশার জায়গাটার বাইরে ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ নামের যে সামাজিক-নাগরিক প্ল্যাটফর্মটির সাথে আামর সম্পৃক্ততা, সেখানে দাঁড়িয়ে আমি এবং আমরা বরাবরই বলার চেষ্টা করেছি আগামীর বাংলাদেশে আমাদের কালচারাল জিডিপি বাড়ানোর উপর জোর দিতে হবে আর গুরুত্ব দিতে হবে অসাম্প্রদায়িকতার ডিভিডেন্ট আরো বেশি-বেশি সংগ্রহ করার উপর।
আমার প্রচণ্ড সন্তুষ্টির জায়গাটা হচ্ছে এই এগারো দফার ইশতেহারটির একটি দফা আমার-আমাদের প্রাণের এই দাবির জায়গাটিকে ঘিরেই। অতএব যদি আমাকে প্রশ্ন করেন ইশতেহারটি কেমন হয়েছে আমার এক কথায় উত্তর হবে ‘দারুণ’, কিন্তু তারপর আমার একটা কিন্তু জুড়ে দিতেই হবে। ইশতেহারটি দারুণ হয়েছে কারণ এর পিছনে আছেন এবং একে বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিয়েছেন এমন একজন মহিয়সী মানবী যার কথা মাথায় রেখেই বোধকরি কবিগুরু শতবর্ষ আগে লিখেছিলেন, ‘..... ....... তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ’ ।
লেখক: ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
এইচআর/জিকেএস