চলতি বছর ইতিহাসের সর্বোচ্চ দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনে খেতে হচ্ছে ভোক্তাদের। কৃষিপণ্যের বাজারে সিন্ডিকেটের কথা প্রকাশ্যেই স্বীকার করেছেন সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে আসছে। এ কারণে সবখানেই খরচ কমানোর চেষ্টা করছে মানুষ। এর ধাক্কা গিয়ে পড়ছে খাবারে। বছরজুড়েই ক্রেতার নাগালের বাইরে প্রায় সব ধরনের শাক-সবজি। চড়া ডিম, মাছ ও মাংসের বাজার। এ কারণে খাবারের তালিকায় পরিবর্তন এনেছেন বেশিরভাগ মানুষ। বাজারের তালিকাও কাটছাঁট করছেন তারা।
Advertisement
মেসগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। সেখানে আমিষ-প্রোটিনের উৎসই এখন প্রায় শূন্য। ভর্তা-ভাজিই যেন নিত্যসঙ্গী। এ নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শরীরে যে পরিমাণ প্রোটিন দরকার সেটি না পেলে পুষ্টিহীনতা দেখা দিতে পারে। তাদের মতে, পুষ্টিহীনতার কারণে নানান রোগ শরীরে বাসা বাঁধে। এতে শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয়, উৎপাদন কমে যায় কলকারখানায়। জাতীয় অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাসিরুল ইসলাম। পুরান ঢাকার নারিন্দা এলাকায় একটি মেসে থাকেন।
নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে সেভাবে খাবার কেনা হয় না। গরু বা খাসির মাংস মেসে আনা হয় না। মাঝে মাঝে মুরগি আনা হয়, সেটিও অনিয়মিত। ডিম রান্না করা হয় ভাজি করে। এতে একটা ডিম দুই ভাগ করা যায়।
Advertisement
নাসিরুল জাগো নিউজকে বলেন, বাড়ি থেকে সামান্য টাকা পাই। তা দিয়ে মেসের ভাড়া হয়। খাবার খরচ আসে টিউশনি থেকে। এখন নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে সেভাবে খাবার কেনা হয় না। গরু বা খাসির মাংস মেসে আনা হয় না। মাঝে মাঝে মুরগি আনা হয়, সেটিও অনিয়মিত। ডিম রান্না করা হয় ভাজি করে। এতে একটা ডিম দুই ভাগ করা যায়। মূলত সব কিছুর দাম বেশি হলেও টিউশনের টাকা বাড়েনি। এ কারণে কাটছাঁট করেই চলছি আপাতত।
মেসের নিয়মিত খাবার মেন্যু কী রাখা হয়, জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবারই ক্লাস থাকে। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ি আমরা। মেসে দুই বেলা (দুপুর ও রাত) রান্না হয়। এখন শাক-সবজি অথবা আলুর ভর্তা আর ডাল। ডিম হলেও এক ডিম দুই ভাগ করা হয়। লাউ-মিষ্টি কুমড়াও চলে নিয়মিত। আমরা যেহেতু সবাই শিক্ষার্থী তাই মানিয়ে নিতে খুব বেশি কষ্ট হয় না।
আরও পড়ুন>> খাবারের তালিকায় ভাজি-ডাল-শাকসবজি, বাদ পড়ছে ডিমও
একই কথা জানান মতিঝিল ব্যাটারি গলির একটি মেসে থাকা তারিকুল ইসলাম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের এখানে চাকরিজীবী ও শিক্ষার্থী মিলে মেস। দুই বেলা রান্না হয়। বেলা ১১টার পর খাবার খাই। এতে দুপুরে আর খাওয়ার প্রয়োজন হয় না। তবে দুই বেলা সবজি খাওয়ার চেষ্টা করি। শুক্রবার হলে ব্রয়লার মুরগি বা মাছ রান্না হয়। এভাবেই চলছে। ভালো কিছু খাওয়ার চিন্তা এ মুহূর্তে করছি না। সব কিছুর দাম বাড়ার পর মেসের খরচও বেড়েছে।
Advertisement
তারিক বলেন, পড়ালেখার পাশাপাশি পার্টটাইম জব করি। পরিবারের জন্য কিছু টাকা পাঠাতে হয়। সব কিছুর দাম বাড়ায় এখন খরচ চালাতে পারছি না। অসুস্থ হলে মনে হয় চিকিৎসার টাকা থাকবে না। শরীরের পুষ্টি চাহিদাও মেটাতে পারি না। নিয়মিত আমিষ খাবো কীভাবে? এর আগে আমরা নিয়মিত মাছ-মুরগি খেলেও প্রতি মিল (এক বেলা খাবার) খরচ হতো ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। এখন সবজি খাই। তবুও ৪০ টাকা মিল খরচ হচ্ছে। সাবান-শ্যাম্পুর দামও বেড়েছে। তার মতো আরও অনেকেই একই রকম কথা জানান।
হেঁটে অফিসে ছুটছে মানুষ
জীবনের প্রতিটি দিকই পর্যালোচনা করতে হচ্ছে। খরচ বাঁচাতে হেঁটেই গন্তব্যে যাচ্ছেন অনেকে। বিশেষ করে নিত্যদিনের অফিস যাওয়া হেঁটেই সারছেন বিপুল সংখ্যক মানুষ।
কথা হয় মাহবুবের সঙ্গে। তিনি একটি রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকে কর্মরত। থাকেন বাসাবো এলাকায়। মাহবুব জাগো নিউজকে বলেন, বেতন থেকে হোম লোনবাবদ টাকা কেটে নেওয়া হয়। এরপর যা আসে তা দিয়ে চলছে না। সন্তানের পড়ালেখা আর সংসারের খরচ নিয়ে টানাটানি। শাক-সবজিই এখন মাছ-মাংসের মতো মনে হচ্ছে। সব কিছুর দাম বেড়েছে। তাই হেঁটে অফিসে আসা-যাওয়া করি প্রায় সময়। হাঁটাহাঁটি করার সময় পেতাম না আগে। এখন হেঁটে অফিস করছি, ব্যায়ামও হচ্ছে।
খাবারের মান কমে গেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তখন চিকিৎসার প্রয়োজনও বেশি হয়। অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে একান্ত বাধ্য না হলে চিকিৎসা নিতে যান না। যখন যান তখন তার অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে যায়। শরীরে অসুস্থতার হার বেড়ে যায়। সব মিলিয়ে নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য চূড়ান্তভাবে আমাদের জনস্বাস্থ্যের মানকে অবনমিত করে
শাহজাহানপুর থেকে মতিঝিল অফিস করেন জয়নাল আবেদিন। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা তিনি। এর আগে রিকশাযোগে চলাচল করলেও এখন চলাফেরায় পরিবর্তন এনেছেন। একবেলা রিকশায় চড়লে পরের বেলায় ফেরেন হেঁটে।
অনেকেই আবার বেশি হাঁটার কারণে শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। বিশেষ করে শরীরে ক্লান্তির ছাপ তৈরি হচ্ছে তাদের। এমনই একজন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কবির আহমেদ।
তিনি বলেন, খরচ বাঁচাতে এখন হেঁটে অফিস করছি। এতে অনেক সময় শরীর বেশি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, আনমোনা হয়ে পথ চলা হয়। রাস্তায় হাঁটাহাঁটির পরিবেশও নেই। তবুও টিকে থাকতে, সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আছি। তারা সবাই ঢাকায়ই পড়ালেখা করছে।
এ পরিস্থিতি নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে আসছে। খরচ বাঁচাতে খাবারের তালিকায় পরিবর্তন এনেছে মানুষ। খাবারের পাঁচটি মৌলিক উপাদানের মধ্যে কার্বোহাইড্রেট হলো চাল। এর দাম বেড়েছে। মাংসের দাম বেড়েছে। স্নেহজাতীয় খাবারের মধ্যে তেলের দাম বেড়েছে, শাক-সবজি এবং ফলমূলের দামও বেড়েছে। ফলে অনিবার্যভাবে খাবারের মানে অবনমন ঘটেছে। একটা মানুষকে সুস্থ থাকতে হলে প্রতিদিন যে পরিমাণ সুষম খাবার খেতে হয় বা যে অনুপাত থাকতে হয়, সেসব উপাদানে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যেটি মানুষের স্বাস্থ্যকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। অর্থাৎ তার শরীরে যে পরিমাণ প্রোটিনের দরকার সেটি সে নিতে পারছে না, স্নেহজাতীয় পদার্থের দরকার সেটি পাচ্ছে না, শাক-সবজি বা ফলমূলের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।
ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, এ কারণে তার শরীরে পুষ্টিহীনতা দেখা দিচ্ছে। আর পুষ্টিহীনতা দেখা দিলে তার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তখন রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ বেশি হয়, পরিশ্রম করার ক্ষমতা কমে যায়। এ কারণে জাতীয় শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয়ে যায়। এটি জাতীয় উৎপাদনে প্রভাব ফেলে। অর্থাৎ অর্থনীতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
আরও পড়ুন>> ডিমও ভাগ করে খাচ্ছেন মেসের শিক্ষার্থীরা
তিনি বলেন, খাবারের মান কমে গেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তখন চিকিৎসার প্রয়োজনও বেশি হয়। অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে একান্ত বাধ্য না হলে চিকিৎসা নিতে যান না। যখন যান তখন তার অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে যায়। শরীরে অসুস্থতার হার বেড়ে যায়। সব মিলিয়ে নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য চূড়ান্তভাবে আমাদের জনস্বাস্থ্যের মানকে অবনমিত করে। রোগ-বালাই বেড়ে যায়, স্বাস্থ্য খরচ বেড়ে যায়।
সন্তানের পড়ালেখা আর সংসারের খরচ নিয়ে টানাটানি। শাক-সবজিই এখন মাছ-মাংসের মতো মনে হচ্ছে। সব কিছুর দাম বেড়েছে। তাই হেঁটে অফিসে আসা-যাওয়া করি প্রায় সময়। হাঁটাহাঁটি করার সময় পেতাম না আগে। এখন হেঁটে অফিস করছি, ব্যায়ামও হচ্ছে।
হাঁটার বিষয়ে ড. লেলিন বলেন, হাঁটার কারণে একদিকে শারীরিক সুবিধা পাওয়া যায়। অন্যদিকে দুর্ঘটনার শঙ্কাও থাকে। অনেক সময় রোদ-গরমের মধ্যে হেঁটে অসুস্থ হয়ে পড়েন অনেকে। হাঁটার মধ্যে শুধু লাভ হচ্ছে, এটাও বলা যাচ্ছে না। আবার ক্ষতি হচ্ছে তাও বলা যায় না। এটার মিশ্র ফলাফল আসে। কিন্তু যদি হাঁটার মতো পরিবেশ থাকতো তাহলে লাভ হতো। একটা মানুষ যখন সকালে হেঁটে অফিসে যায়, অফিসে কিন্তু ক্লান্তি নিয়ে যায়। এতে তার কাজ করার মানসিকতা কমে যায়। এ কারণে বলবো, হাঁটাটা হাঁটার সময়ই হওয়া উচিত। অফিসে যাওয়ার সময় হেঁটে গেলে মন্দই বেশি হতে পারে।
অন্যদিকে নিত্যপণ্যের মূল্যের কথা উঠলেই উঠে আসে বাজারে সিন্ডিকেটের কথা। কিন্তু তদারকির দায়িত্বে থাকা নিয়ন্ত্রক সংস্থা যেন ‘ভাতঘুমে’। কৃষিপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেওয়া হলেও কার্যকর কিছু করত দেখা যায় না সংস্থাটিকে।
ঢাকা জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মিজানুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের আইনে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত ছাড়াও মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিদপ্তরসহ অন্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করি। টোটাল হিসাব (বছরে কতগুলো অভিযান) থাকে না। শুধু আমাদের আইনে কতগুলো হয়েছে, সেই হিসাব রাখা হয়।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান জাগো নিউজকে বলেন, দামের কারণে আমিষ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষ। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষও বিপাকে রয়েছে। সরকার চাইলেও যে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না কয়েকটি পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়ার পরে দেখা গেছে। এটা দুঃখজনক।
ইএআর/এমএইচআর/জেআইএম