একসময় ক্যানসার হলেই মানুষ ভাবতো জীবনের শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। তবে বিজ্ঞানের কল্যাণে ক্যানসার এখন নিরাময়যোগ্য রোগ। দেশে ক্যানসার চিকিৎসায় উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। একই সঙ্গে ক্যানসার চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেক রোগীর পরিবার চিকিৎসা খরচ বহন করতে পারে না। এ অবস্থায় দেশের নিম্নআয়ের ক্যানসার রোগীদের একমাত্র ভরসা জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। তবে লোকবলের অভাব আর পর্যাপ্ত শয্যা না থাকায় রোগীদের চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে দেশের একমাত্র বিশেষায়িত ক্যানসার চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের।
Advertisement
রোগীর চাপ থাকায় হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ৩০০ থেকে বাড়িয়ে সম্প্রতি ৫০০ করা হলেও সে অনুযায়ী নিয়োগ হয়নি লোকবল। বর্তমানে হাসপাতালটিতে যে জনবল রয়েছে তা ৩০০ শয্যার জন্যও অপ্রতুল। দেশের বিশাল জনসংখ্যার জন্য একটিমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতাল থাকায় সারাদেশ থেকে ক্যানসার আক্রান্ত রোগীরা এখানে আসেন চিকিৎসা নিতে। ফলে হাসপাতালের ৫০০ শয্যার কোনো শয্যাই কখনো খালি থাকে না। এমনকি প্রতি শয্যার বিপরীতে অপেক্ষায় থাকতে হয় অন্তত সাতজনকে। এর বাইরে জরুরি-বহির্বিভাগ ও অন্য বিভাগে প্রতিদিন অন্তত ৫০০ ক্যানসার রোগী আসেন চিকিৎসা নিতে। শয্যা পেতে রাতের পর রাত এসব রোগীকে হাসপাতাল ভবনের বাইরে খোলা জায়গায় অপেক্ষা করতে হয়। এছাড়া গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে হাসপাতালের ফার্মেসিতে নেই প্রয়োজনীয় ওষুধের সরবরাহ।
হাসপাতালের ৫০০ শয্যার কোনো শয্যাই কখনো খালি থাকে না। এমনকি প্রতি শয্যার বিপরীতে অপেক্ষায় থাকতে হয় অন্তত সাতজনকে। এর বাইরে জরুরি-বহির্বিভাগ ও অন্য বিভাগে প্রতিদিন অন্তত ৫০০ ক্যানসার রোগী আসেন চিকিৎসা নিতে।
আরও পড়ুন: জাতীয় ক্যানসার হাসপাতালের ৬ রেডিওথেরাপি মেশিনের ৫টিই অকেজো
Advertisement
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভর্তি থাকা রোগী কিংবা নতুন রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে পড়তে হচ্ছে জটিলতায়। কিছু ক্ষেত্রে পরীক্ষা করতে পারলেও ফলাফল (টেস্টের রিপোর্ট) পেতে লাগে দীর্ঘ সময়। এরপর ওই রিপোর্ট চিকিৎসককে জমা দিলে অনেক সময় চিকিৎসক জানান, ‘রিপোর্ট দেরি হয়েছে। আবার নতুন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে’। এরপর ওই পরীক্ষা আবারও করতে হচ্ছে। দ্রুত রিপোর্ট পেতে অনেক সময় হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীও বাইরে থেকে (ডায়াগনস্টিক সেন্টার) পরীক্ষা করান। হাসপাতালে জনবলের অভাবকেই এজন্য দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) উদ্যোগে দ্য গ্লোবাল ক্যানসার অবজারভেটরির ২০২০ সালের তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রতি বছর দেড় লাখ মানুষ নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। এছাড়া দেশে ক্যানসারে প্রতি বছর মারা যায় এক লাখ ৮ হাজারের বেশি মানুষ।
আউটডোরে টিকিট যুদ্ধসম্প্রতি জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে সরেজমিনে দেখা যায়, দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা ভোর থেকেই টিকিটের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছেন। এই প্রতিবেদক যখন টিকিট কাউন্টারের সামনে দীর্ঘ লাইন দেখেন তখনো আউটডোরে রোগী দেখা শুরু হয়নি।
আরও পড়ুন: ক্যানসার আক্রান্ত মায়ের কষ্ট দেখে বুক ফেটে যায় তাসিনের
Advertisement
রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, টিকিটের লাইনের সামনের দিকে থাকতে অনেকেই আগের রাতে এসে হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের আঙ্গিনায় অবস্থান করেন। সকাল হলে সেখান থেকে এসে সিরিয়ালে দাঁড়ান।
আউটডোরে টিকিট নিতে আসা রোগী হাসানুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আউটডোর দুপুর ২টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এর মধ্যেই চিকিৎসক দেখাতে হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ সবকিছু এই সময়ের মধ্যেই করতে হয়। তাই ভোরে এসেই সিরিয়াল দিয়েছি, যাতে ডাক্তার দেখিয়ে বাকি সব কাজ সারতে পারি।’
কথা হয় আউটডোরে লাইনে থাকা শারমিন আরার সঙ্গে। জাগো নিউজকে তিনি জানান, তিনি ফজরের নামাজের পর এসেছেন। তবুও লাইনের পেছনে পড়ে গেছেন।
হাসপাতালের ফার্মেসিতে দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে ওষুধ পাচ্ছেন না রোগীরা। সরবরাহ বন্ধ থাকায় রোগীরা ওষুধ পাচ্ছেন না। শিগগির নতুন করে টেন্ডারের মাধ্যমে ওষুধ কেনা হবে। এরপর থেকে রোগীরা ওষুধ পাবেন।
দুপুর ১২টার পর রিপোর্ট জমা বন্ধহাসপাতালের দ্বিতীয় তলার সিঁড়ির বাম পাশে বসে মেডিকেল বোর্ড। সেখানে চিকিৎসকরা রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল দেখে পরবর্তী চিকিৎসা পরামর্শ দেন। প্রয়োজনে দেন ভর্তি কিংবা সার্জারির পরামর্শ।
আরও পড়ুন: দেশে প্রতিবছর ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে আড়াই লাখ মানুষ
কথা হয় ওই বিভাগে কর্মরত এক নার্সের সঙ্গে। জাগো নিউজকে তিনি জানান, দুপুর ২টা পর্যন্ত চিকিৎসকরা বসেন এখানে। তবে রোগীদের ফাইল জমা বন্ধ হয়ে যায় ১২টার দিকে। কারণ, দুপুর ২টার মধ্যে সব ফাইল দেখে শেষ করতে হয়। দুপুর ১২টার মধ্যে যতগুলো ফাইল জমা পড়ে, সেগুলোর পরামর্শ দিতে অনেক সময় ২টা পার হয়ে যায়। তাই ১২টার পরে আর কোনো ফাইল জমা নেওয়া হয় না।
হাসপাতালের ভেতরে-বাইরে পাটি বিছিয়ে রোগীদের অপেক্ষাদেশের নিম্ন আয়ের ক্যানসার রোগীদের একমাত্র ভরসার স্থল এ হাসপাতাল। বেসরকারি হাসপাতাল বা দেশের বাইরে চিকিৎসা নেওয়ার সামর্থ্য নেই এসব রোগীর। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে আসেন তারা। তবে প্রয়োজনের তুলনায় হাসপাতালে শয্যা কম হওয়ায় ফ্লোরে পাটি বিছিয়ে চিকিৎসা নেন অনেক রোগী।
দুপুর ১টার দিকে হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় পাটি বিছিয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায় অনেক রোগীকে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছেন তারা। তবে হাসপাতালে আসতে দেরি হওয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে দেরি হচ্ছিল তাদের। আবার কেউ চিকিৎসক দেখালেও ভর্তি হতে পারেননি। পরদিন হাসপাতালে ভর্তি হতে আবারও চেষ্টা করবেন। এ কারণে তারা পাটি পেতে হাসপাতালের ফ্লোরে অপেক্ষা করছেন।
কিছুক্ষণ পর ফ্লোরে থাকা রোগী ও স্বজনদের বের করে দেন হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্য ও কর্মচারীরা। এরপর হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের সামনের খালি জায়গায় পাটি পেতে অবস্থান নেন তারা। এসময় অপেক্ষমাণ রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন এখানে অনেকেই এসে ঘুমান। এই ঠান্ডার মধ্যে মশার কামড় খেয়েও চিকিৎসা নিতে অবস্থান করেন খোলা জায়াগায়। অনেকেই এসেছেন কাঁথা-কম্বল, থালা-বাসন নিয়ে। হাসপাতালে শয্যা খালি না থাকায় তারা ভর্তি হতে পারেননি। এছাড়া দেরিতে আসায় কেউ কেউ ডাক্তারের সিরিয়াল পাননি। কেউ আবার কম খরচে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে বেশ কয়েকদিন ধরে এখানেই আছেন।
আরও পড়ুন: মধ্যবয়সী নারীরা জরায়ুমুখ ক্যানসারে বেশি আক্রান্ত, মূলে বাল্যবিয়ে
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থেকে এসেছেন আছিয়া। তার শরীরে ধরা পড়েছে টিউমার। এখানে পরীক্ষা করিয়েছেন অনেক কষ্টে। তবে এখনো চিকিৎসককে দেখানো সম্ভব হয়নি। জাগো নিউজকে আছিয়া জানান, তিন রাত কাটিয়েছেন হাসপাতালের এই খোলা জায়গায়। ঢাকায় আত্মীয়-স্বজন না থাকায় বাধ্য হয়েই হাসপাতালের এই খোলা জায়গায় অবস্থান করছেন।
দশদিন ধরে স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে অবস্থান করছেন আকরাম মিয়া। সম্প্রতি তার স্ত্রীর জরায়ু ক্যানসার ধরা পড়েছে। এখনো হাসপাতালে ভর্তি হতে না পারায় এই শীতের মধ্যেও হাসপাতালের এই খোলা জায়গায় অবস্থান করছেন এই দম্পতি।
চরম লোকবল সংকট বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্ট্যান্ডার্ড সেটআপ (প্রস্তাবিত) অনুযায়ী ৫০০ শয্যার এ হাসপাতালে লোকবল প্রয়োজন অন্তত দুই হাজার ৮৫৮ জন। বর্তমানে হাসপাতালটিতে লোকবল রয়েছে এক হাজার ১৭৬ জন। অর্থাৎ, প্রায় ৬০ শতাংশ কম লোকবল নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে বিশেষায়িত এ হাসপাতাল।
এখানে বর্তমানে অধ্যাপক আছেন মাত্র চারজন, প্রয়োজন আরও ৩৭ জন। বিভিন্ন বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক আছেন ১৩ জন, প্রয়োজন ৬১ জন। সহকারী অধ্যাপক আছেন ২৮ জন, প্রয়োজন ১২০ জন। এছাড়া মেডিকেল অফিসার আছেন ৬৭ জন, প্রয়োজন ২৩৬ জন। মেডিকেল টেকনোলজিস্ট প্রয়োজন ৬৬ জন, আছে মাত্র ১৫ জন।
দশদিন ধরে স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে অবস্থান করছেন আকরাম মিয়া। সম্প্রতি তার স্ত্রীর জরায়ুর ক্যানসার ধরা পড়েছে। এখনো হাসপাতালে ভর্তি হতে না পারায় এই শীতের মধ্যেও হাসপাতালের খোলা জায়গায় অবস্থান করছেন এই দম্পতি।
এসব বিষয়ে কথা বলতে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নিজামুল হকের সঙ্গে কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে ব্যস্ততার কারণ দেখিয়ে তিনি সময় দেননি। পরে হাসপাতালের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই জনবল সংকটে ভুগছে বিশেষায়িত এই হাসপাতাল। চিকিৎসক, প্যাথলজিস্ট, এনেস্থেসিওলজিস্ট ও কর্মচারী সংকট প্রকট। এতে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার জনবলের জন্য বলা হয়েছে। চিঠি দেওয়া হয়েছে। কত জনবল লাগবে সে বিষয়ে মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। তবে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি মন্ত্রণালয়।
আরও পড়ুন: ১১ বছর ধরে বাক্সবন্দি ১০ কোটি টাকায় কেনা মেশিন
হাসপাতালের উপ-পরিচালক (প্রশাসন) ডা. কাজী মো. আইনুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরেই লোকবল সংকটে ভুগছি। আমাদের চিকিৎসকরা কষ্ট করে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। জনবল কম হওয়ায় এটা একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে একাধিকবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়েছি। লোকবল না থাকলে রোগীদের প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়া কঠিন।’
বিনামূল্যের ওষুধ পাচ্ছেন না রোগীরা হাসপাতালের ফার্মেসিতে দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে ওষুধ পাচ্ছেন না রোগীরা। প্রতিষ্ঠানটির পুরোনো বা মূল ভবনের তৃতীয় তলায় বিনামূল্যে ওষুধ পান রোগীরা। এ কারণে বেশিরভাগ সময় এখানে রোগীদের ভিড় লেগে থাকে। তবে দীর্ঘদিন ধরে ফার্মেসিতে ওষুধ সরবরাহ বন্ধ।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের এক কর্মকর্তা জানান, সরবরাহ বন্ধ থাকায় রোগীরা বিনামূল্যে ওষুধ পাচ্ছেন না। শিগগির নতুন করে টেন্ডারের মাধ্যমে ওষুধ কেনা হবে। এরপর থেকে রোগীরা ওষুধ পাবেন।
সামগ্রিক বিষয়ে কথা হয় মেডিকেল অনকোলজিস্ট ও ক্যানসার মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এ টি এম কামরুল হাসানের সঙ্গে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘দেশে ক্যানসার রোগের ব্যাপকতা বাড়লেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসদের সংখ্যা সেভাবে বাড়েনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি ১০ লাখ লোকের জন্য একটি ক্যানসার সেন্টার প্রয়োজন, সেখানে সারাদেশে আছে মাত্র ২০ থেকে ২২টি সেন্টার। প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য একজন ক্যানসার বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন। অথচ আমাদের দেশে আছেন মাত্র ৩শ জন ক্যানসার বিশেষজ্ঞ।
এএএম/কেএসআর/জেআইএম