মানবপাচার চক্রের সক্রিয় সদস্য মমিনুল ইসলাম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় হয় কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর থানার নাসরিন আক্তারের সঙ্গে। সৌদিতে ভালো চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ২০২১ সালের ৮ জুলাই নাসরিনকে সৌদিতে পাঠান তিনি। সৌদিতে যাওয়ার সব খরচ বহন করেন মমিনুল নিজেই! সৌদিতে পৌঁছার পর নাসরিনকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি বাড়িতে। সেখানে আগে থেকেই বাংলাদেশের আরও ১৫-১৬ জন নারী অবস্থান করছিলেন। তাদের মধ্যে নাসরিনের বান্ধবী পাপিয়াও ছিলেন। বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলে নাসরিন জানতে পারে সেখানে জোরপূর্বক তাদের আটক রেখে অবৈধভাবে দেহব্যবসা করানো হচ্ছে। নাসরিনকেও একইভাবে সেখানে দেহব্যবসায় করতে বাধ্য করা হয়। এক পর্যায়ে নাসরিনের কফিলের সহায়তায় ওই দেশের পুলিশ তাকে উদ্ধার করে ২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেন।
Advertisement
আরও পড়ুন: ‘জাতিসংঘের কনফারেন্সের’ আড়ালে যুক্তরাষ্ট্র-ফ্রান্সে মানবপাচার
এ ঘটনায় ২০২২ সালের ৫ মার্চ নাসরিনের স্বামী তাকে সঙ্গে নিয়ে রাজধানীর পূর্ব কাফরুল থানায় মানবপাচার আইনে একটি মামলা করেন। মামলার তদন্ত শেষে ১০ জনকে সাক্ষী করে কাফরুল থানার এসআই জিল্লুর রহমান ২০২২ সালের ২৭ এপ্রিল আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। এরপর আদালত মমিনুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।
অভিযোগ প্রমাণের জন্য যতজন সাক্ষী ছিল তারমধ্যে একজন সাক্ষী (বাদী নিজে) ছাড়া আর কেউ আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসেননি। অপরদিকে আসামি মমিনুল আদালতে তার যুক্তি উপস্থাপনে উল্লেখ করেন সৌদিতে যাওয়ার পর নাসরিনকে যে বাসায় কাজে দিয়েছিলেন সে বাসা থেকে নাসরিন পালিয়ে গিয়ে অন্যত্র চলে যায়। সেখানে সমস্য হাওয়ায় নাসরিন দেশে চলে আসে। তারা নিজেদের মধ্যে বিষয়টি আপস-মীমাংসা করে নিয়েছেন। যুক্তিতর্ক উপস্থাপন চলাকালীন রাষ্ট্রপক্ষ কোনো প্রকার অভিযোগের সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়। আদালত মমিনুলের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণিত না হাওয়ায় ২০২৩ সালের ১৭ এপ্রিল তাকে খালাস প্রদান করেন।
Advertisement
যুক্তরাষ্ট্র-ফ্রান্সে মানবপাচার চক্রের সদস্য-ফাইল ছবি
ঘটনা-২
মাইন উদ্দিন বয়স ৩৭ বছর। দিনমজুরির কাজ করে কোনো রকমে পরিবার নিয়ে জীবনযাপন করেন। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর থানার চারাগাঁও এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস তার। পার্শ্ববর্তী গ্রামের দীর্ঘদিন সৌদি আরবে চাকরি করে দেশে আসা হামিদা খাতুন তার সাংসারিক অভাব-অনটন ও দৈন্য-দশার সুযোগ নিয়ে স্ত্রী শরিফা খাতুনকে সৌদি আরব পাঠানোর প্রস্তাব দেয়। মাইন উদ্দিন তাতে রাজি না থাকলেও তার স্ত্রী সৌদি গেলে পরিবারের অভাব-অনটন কাটবে স্বাবলম্বী হবেসহ বিভিন্ন লোভনীয় প্রস্তাবেও প্রলোভনে শরিফা খাতুনকে রাজি করেন। এক পর্যায়ে শরিফা তার স্বামী মাইন উদ্দিনকেও রাজি করায় সৌদি যাওয়ার জন্য। শুধু শরিফা নয় একই এলাকার আর চারজন নারীর কাছ থেকে সৌদিতে পাঠানোর জন্য ৪০ হাজার টাকা করে নেয় হামিদা খাতুন।
আরও পড়ুন: আসামির বাড়ি থেকে মানবপাচার মামলার বাদীর স্বামী উদ্ধার
Advertisement
শরিফাসহ পাঁচজন নারীর পাসপোর্ট ও মেডিকেলসহ অন্যান্য কাগজ তৈরির জন্য ঢাকায় নিয়ে আসেন হামিদা। কনকর্ড এ্যাপেক্স রিক্রুটিং এজেন্সির অফিসে নিয়ে এসে তাদের দিয়ে অলিখিত নন-জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর/টিপসই রেখে ২০২১ সালের ২৪ ডিসেম্বর সৌদিতে পাঠিয়ে দেয়। সৌদি যাওয়ার দুই মাস পর শরিফা তার স্বামী মাইন উদ্দিনকে মোবাইল ফোনে জানায় যে কফিলের কাছে তাকে পাঠানো হয়েছে সে তাকে গৃহস্থালির কাজ না দিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করছে।
মানবপাচার মামলার প্রতিবেদন দেওয়ার আগে পিপির ওপিনিয়ন নিতে হয়। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তারা আমার কাছে কোনো ওপিনিয়ন নেয় না। অনেক ক্ষেত্রে মামলায় তদন্তে দুর্বলতা থাকে তা পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করতে পারি। ওপিনিয়ন না নেওয়ার কারণে সঠিক তদন্ত হয়ে আসে না মামলাগুলো। অনেক সময় সাক্ষীরা আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসে না। —সাজ্জাদুল হক শিহাব
বিষয়টি রিক্রুটিং অফিসে জানালে তারা কোনো প্রকার ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো হুমিকা-ধামকি দিতে থাকে এবং শরিফাকে ফেরত পেতে হলে ৬ লাখ টাকা দিতে হবে বলে জানায়। শুধু শরিফা নয় সব নারীকেই একইভাবে নির্যাতনের কথাও জানতে পারে মাইন উদ্দিন। পরে মাইন উদ্দিন বিষয়টি র্যাবের কাছে অভিযোগ জানালে র্যাব সদস্যরা আসামি আলেয়া বেগম, আবুল হোসেন ও হামিদা খাতুনকে পল্টনে অবস্থিত সিটি হার্ট শপিং কমপ্লেক্সের ৬তলা কনকর্ড এ্যাপেক্স রিক্রুটিং এজেন্সির অফিস থেকে গ্রেফতার করে পল্টন থানায় সোপর্দ করে। ২০২৩ সালের মার্চ মাসে পল্টন থানার এসআই ফরহাদ মাতুব্বর আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। মামলার পর রিক্রুটিং এজেন্সি থেকে শরিফা খাতুনকে সৌদি থেকে ফিরিয়ে দেশে নিয়ে আসা হয়। মামলাটি ঢাকার মানবপাচার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন অবস্থায় উভয়পক্ষের মধ্যে আপস-মীমাংসা করা হয় এবং আদালতে দাখিল করা হয়। আদালতে বাদী এবং ভিকটিম উভয়ই বলে ভালো কাজের জন্য আসামিরা সৌদিতে প্রেরণ করলেও সেখানে ভালো কাজ না পেয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। আসামিদের সঙ্গে ক্ষতিপূরণ নিয়ে তারা আপস করেছেন। এজন্য মামলার বাদী মাইন উদ্দিন আর মামলা চালাতে চান না বলে আদালতে জানান। আসামিরা এই মামলা থেকে অব্যাহতি পেলে তাদের কোনো আপত্তি নেই। আদালত ২০২৩ সালের ২০ জুন আসামিদের মামলা থেকে অব্যাহতি প্রদান করেন।
আরও পড়ুন: ফেসবুক-টিকটকের কারণে বাড়ছে মানবপাচার
শুধু মমিনুল কিংবা মাইন উদ্দিন নন। ঢাকায় মানবপাচার ট্রাইব্যুনাল ঘটনের পর থেকে ১০৫৪ মামলার আসামিকে দেওয়া হয়েছে খালাস। অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে ১৪৭ মামলার আসামিকে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে সারাদেশে ১৪০৫ আসামিকে।
খালাসের মামলার অধিকাংশ আদেশে বিচারক উল্লেখ করেন, আসামিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ সুনির্দিষ্ট করে সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে। আইনগতভাবে সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়া কোনো আসামিকে সাজা দেওয়া সম্ভব হয়। তাই আসামিদের খালাস প্রদান করা হলো।
আরও পড়ুন: নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় না মানবপাচার মামলা
অপরদিকে অব্যাহতির আদেশে বিচারক উল্লেখ করেন, মামলার বাদী মামলা চালাবেন না বলে আদালতে জবানবন্দি প্রদান করেছেন। আসামি ও বাদী বিষয়টি নিয়ে আপস-মীমাংসা করে মামলা চালাবে না বলে আদালতে জানান। এছাড়া আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করার মতো কোনো উপদান না থাকায় মামলার দায় হতে অব্যাহতি প্রদান করেন।
আসামির বাড়ি থেকে মানবপাচার মামলার বাদীর স্বামী উদ্ধার-ফাইল ছবি
আরও পড়ুন: মানবপাচার আইনে নারীসহ দুইজনের যাবজ্জীবন
মানবপাচারের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি ও ন্যায়বিচার ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে ময়মনসিংহ বাদে দেশের সাত বিভাগে মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল গঠনের অনুমতি দেওয়া হয়। এরপর ২০২০ সালের ৯ মার্চ ঢাকায় মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১২৪৪টি মামলা নিষ্পত্তি করেন ঢাকার মানবপাচার ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে খালাস পেয়েছেন ১০৫৩টি মামলার আসামি। অব্যাহতি পেয়েছেন ১৪৭ মামলার আসামিরা। আর সাজা হয়েছে ৪৩টি মামলার আসামিদের।
খালাসের অধিকাংশ মামলার আদেশে বিচারক উল্লেখ করেন, রাষ্ট্রপক্ষ মামলা প্রমাণের জন্য আসামিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থিত করতে পারেনি। অপরদিকে অব্যাহতির আদেশে বিচারক উল্লেখ করেন, বাদী ও আসামি পক্ষ দুজনই আদালতে এসে বলে মামলা চালাবেন না। আসামি অব্যাহতি পেলে বাদীর কোনো আপত্তি নেই। সবদিকে বিবেচনা করে আদালত আসামিদের মামলার দায় হতে খালাস বা অব্যাহতি প্রদান করেন।
আরও পড়ুন: ঘটনা বিদেশে তদন্ত হয় দেশে
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের তথ্য অনুসারে সারাদেশে ২০২৩ সালে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মামলা হয়েছে ৬৮৩টি মামলা। পূর্ববর্তী মামলাসহ মোট মামলা দাঁড়ায় ৭১৬টি মামলা। পূর্ববর্তী মামলাসহ অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে ২৪৬টি মামলায় আর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে ১২৯টি মামলায়। আসামি করা হয়েছে ৩৩ হাজার ৫০৯ জনকে। পূর্ববর্তী মামলাসহ মোট ১৫ হাজার ১২৬ জনকে। খালাস দেওয়া হয় ১২৭৯ জন আসামিকে। সাজা দেওয়া হয় ৪ মামলার আসামিকে। বর্তমানে ৭৪৫টি মামলা তদন্তধীন। এদের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত ১২৫টি নতুন মামলা করা হয়। এদের মধ্যে ৫২টি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। বাকি ৭৩টি মামলা তদন্তাধীন।
সাক্ষী হাজির করার জন্য আমাদের প্রসিকিউশন বিভাগে যোগাযোগ করা হয়। মামলায় যারা পুলিশ সাক্ষী তারা আদালতে সাক্ষ্য দিতে হাজির হয়। পাবলিক সাক্ষী যারা তাদের আদালতে হাজির হওয়ার জন্য সমন জারি করা হয়। এছাড়া কিছু সাক্ষী ভ্রাম্যমাণ থাকায় তাদের বিরুদ্ধে সমন জারি করার পরও খুঁজে পাওয়া যায় না। পাবলিক সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিতে হাজির না হলে এটার জন্য শাস্তির কোনো ব্যবস্থা নেই। সাক্ষীদের আদালতে হাজির করার জন্য আমাদের পুলিশ সবসময় সতর্ক। — ফারুক হোসেন
২০২২ সালে মামলা হয়েছে ৫৩টি। ২০২১ সালের মামলাসহ মোট মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৪৮টি। অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে ৬৯টি মামলায়, আর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে ৬টি মামলায়। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ৩০ হাজার ৭৭৮ জনকে। পূর্ববর্তী মামলাসহ এদের মধ্যে আর ১৪ হাজার ২৯২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। খালাস দেওয়া হয়েছে ১২১টি মামলার আসামিকে আর সাজা দেওয়া হয়নি কোনো মামলায়। ৮২৬টি মামলা তদন্তাধীন। বিচারাধীন ছিল ৫ হাজার ২৯৫টি মামলা।
২০২১ সালে মামলা হয়েছে ৫৫৪টি। ২০২০ সালের মামলাসহ মোট মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ৬ হাজার ৫০১টি। এদের মধ্যে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে ৩৬৬টি মামলায় আর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে ৪০টি মামলায়। পূর্ববর্তী মামলাসহ এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে দুই লাখ ৬১ হাজার ২৪ জনকে। এদের মধ্যে আরও এক লাখ ১৬ হাজার ৩৬০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। খালাস দেওয়া হয়েছে পাঁচ মামলার আসামিকে। সাজা দেওয়া হয়নি কোনো মামলার আসামিকে। তদন্তাধীন ছিল ৬ হাজার ৯৫টি মামলা। বিচারাধীন ছিল ৪৫ হাজার ৭০৪টি মামলা।
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির তথ্যানুসারে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে মানবপাচারের ৭ হাজার ২৩৩টি মামলা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে বিভিন্ন আদালতে ৩৬৮টির নিষ্পত্তি হয়েছে আর বিচারাধীন ৫ হাজার ৯৭০টি (তদন্তাধীন মামলাসহ)।
ভারতে পাচার হওয়া শিশুসহ ১৯ নারী-পুরুষ-ফাইল ছবি
পুলিশি তদন্ত শেষে বিচারের জন্য বিভিন্ন আদালতে ঝুলছে ৫ হাজার ৭৭টি মামলা। এখন পর্যন্ত এ-সংক্রান্ত মামলায় ১১ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে ৩০৬ জনের। বিভিন্ন মেয়াদে ৮৬ জনের সাজা হয়েছে।
জাগো নিউজের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকার মানবপাচার ট্রাইব্যুনালে ২১৮টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন আদালত। এর মধ্যে খালাস পেয়েছেন ১৪১টি মামলার আসামি। অব্যাহতি পেয়েছে ৬৪ মামলার আসামি। আর সাজা দিয়েছেন ১৩ মামলার আসামিকে। ২০২২ সালের ৫৭৬টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন ঢাকার মানবপাচার ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে ১৪টি মামলায় সাজা হয়েছে। খালাস পেয়েছেন ৫১৪ মামলার আসামিরা। ২০২১ সালের মোট ৪১৩টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ১৭টি মামলায় সাজা হয়েছে। খালাস পেয়েছেন ৩৬১ মামলার আসামিরা। ২০২০ সালের ১২ মার্চ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আদালত ৩৭টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন। নিষ্পত্তি হওয়া কোনো মামলায় সাজা হয়নি। বরং সবাই খালাস পেয়েছেন।
আরও পড়ুন: বেনাপোল দিয়ে দেশে ফিরলেন শিশুসহ ১৯ বাংলাদেশি নারী-পুরুষ
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকার মানবপাচার ট্রাইব্যুনালে ৯৫১টি মামলা বিচারাধীন অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে থানার মামলাটি ৮৪১টি ও পিটিশন বা নালিশি মামলা ১০৮টি। ট্রাইব্যুনাল গঠন হওয়ার পর থেকে ৮৪টি মামলার আসামিকে জরিমানা দিয়ে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। মানবপাচার পাঁচ বছরের অধিকসময় ধরে চলছে ২৮৫টি মামলা। পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে চলমান মামলাগুলোতে সাক্ষীদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরও তারা সাক্ষ্য দিতে আদালতে হাজির হচ্ছেন না। তাই রাষ্ট্রপক্ষ মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে পারছে না।
যা বলছেন বিশেজ্ঞরা
ঢাকার মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (ভারপ্রাপ্ত পাবলিক প্রসিকিউটর) সাজ্জাদুল হক শিহাব জাগো নিউজকে বলেন, মানবপাচার মামলার সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে সমন জারি করেন আদালত। সমন জারির পরও সাক্ষীরা আদালতে সাক্ষ্য দিতে উপস্থিত না হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এরপরও সাক্ষীরা আদালতে সাক্ষ্য দিতে হাজির হন না। মামলার বাদী ও সাক্ষীদের যে ঠিকানায় সমন পাঠানো হয় সে ঠিকানায় তাদের পাওয়া যায় না। সাক্ষী ছাড়া মামলা প্রমাণ করা যায় না। তাই অধিকাংশ মানবপাচার মামলার আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছেন।
এছাড়া আদালতে বাদী ও আসামি হাজির হয়ে তাদের মধ্যে আপস-মীমাংসা হয়েছে বলে মামলা চালতে আগ্রহী নন বলে জানান। এসব কারণে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা সম্ভব হয় না।
তিনি আরও বলেন, মানবপাচার মামলার প্রতিবেদন দেওয়ার আগে পিপির ওপিনিয়ন নিতে হয়। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তারা আমার কাছে কোনো ওপিনিয়ন নেয় না। অনেক ক্ষেত্রে মামলায় তদন্তে দুর্বলতা থাকে তা পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করতে পারি। ওপিনিয়ন না নেওয়ার কারণে সঠিক তদন্ত হয়ে আসে না মামলাগুলো। অনেক সময় সাক্ষীরা আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসে না।
আদালতে সাক্ষী আনার দায়িত্ব পুলিশের আইনে তাই বলা রয়েছে। কিন্তু পুলিশকে আদালতের আদেশ পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে। তবুও সাক্ষীরা আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসছে না। আইনে নেই তবুও অনেকে আপস-মীমাংসা করে আদালতে এসে মামলা প্রত্যাহার করতে চায়। আবার কিছু মামলা ভিকটিম ক্ষতিপূরণ নিয়ে আপস করেন। তাই অধিকাংশ মামলার আসামিরা খালাস ও অব্যাহতি পেয়ে যাচ্ছেন।
মানবপাচার নিয়ে একটা মনিটারিং সেল হওয়া উচিত। কিন্তু মনিটরিং সেল নেই। মনিটরিং সেল হলে কতজন পাচার হয়েছে তা জানা যেত। গতানুগতিকভাবে মানবপাচার মামলা চলছে। এ বিষয়ে হাইকোর্টের ভালো ভালো রায় রয়েছে সেগুলোও কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে না। —অ্যাডভোকেট সালমা আলী
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এহসানুল হক সমাজী জাগো নিউজকে বলেন, মানবপাচার মামলা আপসযোগ্য নয়। আসামিদের আপসের ভিত্তিতে খালাস দেওয়া হলে আইনগতভাবে শুদ্ধ হবে না।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী জাগো নিউজকে বলেন, দিনের পর দিন মানবপাচার মামলার সাক্ষী আসে না। আসামিরা মামলার পর ভিকটিমদের ভয় দেখায়, তাদের মামলা উঠানোর জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। অনেক সময় টাকা দিয়ে মামলা তোলার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। এটা করে মানবপাচারের আসল হোতারা বাইরে থাকছেন। পুনরায় এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছেন। পরিবার থেকে সবাই মামলা তোলার জন্য বল প্রয়োগ করেন। এটাও কিন্তু একটা বড় বাস্তবতা। অনেক মামলায় যাবজ্জীবন হয়েছে হাইকোর্টে মামলা শেষে হতে কয় বছর লেগে যাবে তা জানা নেই।
তিনি আরও বলেন, মানবপাচার নিয়ে একটা মনিটারিং সেল হওয়া উচিত। কিন্তু মনিটারিং সেল নেই। মনিটারিং সেল হলে কতজন পাচার হয়েছে তা জানা যেত। গতানুগতিকভাবে মানবপাচার মামলা চলছে। এ বিষয়ে হাইকোর্টের ভালো ভালো রায় রয়েছে সেগুলোও কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
মানবপাচারকারী চক্রের ৪ সদস্য গ্রেফতার, উদ্ধার ২ নারী-ফাইল ছবি
ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, সাক্ষী হাজির করার জন্য আমাদের প্রসিকিউশন বিভাগে যোগাযোগ করা হয়। মামলায় যারা পুলিশ সাক্ষী তারা আদালতে সাক্ষ্য দিতে হাজির হয়। পাবলিক সাক্ষী যারা তাদের আদালতে হাজির হওয়ার জন্য সমন জারি করা হয়। এছাড়া কিছু কিছু সাক্ষী ভ্রাম্যমাণ থাকায় তাদের বিরুদ্ধে সমন জারি করার পরও তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। পাবলিক সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিতে হাজির না হলে এটার জন্য শাস্তির কোনো ব্যবস্থা নেই। সাক্ষীদের আদালতে হাজির করার জন্য আমাদের পুলিশ সবসময় সতর্ক থাকে।
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, অত্যন্ত দুঃখজনক যে মানবপাচারের আসামিরা পার পেয়ে যাচ্ছেন। মানবপাচারের আসামিরা খুব প্রভাবশালী থাকে আর যারা ভিকটিম বা বাদী তারা অত্যন্ত দুর্বল। এখন দেখা যায় সে মানুষকে যখন বছরের পর বছর আদালতে ঘুরতে হয়। পাচারকারীদের কোনো কিছুই হয় না। তখন দেখা যায় তারা গিয়ে বলে যে তোমাদের টাকা দেবো ক্ষতিপূরণ দেব। তখন অনেকেই কিন্তু কিছু টাকা বা ক্ষতিপূরণ নেন। তারা চিন্তা করে কিইবা হবে আসামির কাছ থেকে টাকা নিয়ে তারা সরে যায়। সাক্ষী দিতে আসে না। দীর্ঘ সূত্র থাকে না মামলার বিচার ব্যবস্থা বা তদন্তে ঘাটতি থাকে। ফলে দেখা যায় যে মূল প্রভাবশালী আসামিরা খালাস পেয়ে যায়। তার ফলাফল কী হয়? এই বার্তাটাই যায় ভুক্তভোগীর কাছে বিচার তো হবে না। কাজেই সে আসামির কাছ থেকে অল্প কিছু টাকা বা ভয় বা প্রভাব বা নানান কারণে সে খালাস পেয়ে যায়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আল মামুন রাসেল জাগো নিউজকে বলেন, মানবপাচার মামলা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় ৬-৭ জন আসামি হয়। এদের মধ্যে হয়তো মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত থাকে দু-একজন। কিন্তু ক্ষেত্রে যারা জানে না এ বিষয়ে শুধু ব্যক্তিগত আক্রোশে আসামি করা হয়। অনেক সময় অন্য কোনো কারণে শত্রুতা থাকলে তাকেও আসামি করে দেওয়া হয়।
ঘটনার স্থান দেশের বাইরে হওয়ায় অধিকাংশ মামলার সঠিক তদন্ত সঠিকভাবে হয় না। এটি এ আইনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একতরফা তদন্ত হয়, কারণ আসামিরা দেশের বাইরে থাকায় তারা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পায় না। তাই এই ডিজিটাল যুগে অভিযুক্তদের ও ভার্চুয়ালি ভাষ্য রেকর্ড করা উচিত। যাতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়।
তিনি আরও বলেন, বেশিরভাগ মানবপাচার মামলার আসামি হয় প্রবাসী। তারা আপসের শর্তে জামিন নিয়ে আবার বিদেশ চলে যায়। তাই আসামিদের জামিন দেওয়ার সময় তাদের পাসপোর্ট জিম্মা রাখার শর্তে জামিন দেওয়া যেতে পারে। যাতে আসামিরা দেশ থেকে পালিয়ে বিদেশে যেতে না পারে।
জেএ/এসএইচএস/এমএস