দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে দৃশ্যমান আর কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। বিএনপি ও তার মিত্ররা মানুষের কাছে আহ্বান রাখছে নির্বাচন বর্জন করতে। তো সেটা নির্বাচনের দিনই বোঝা যাবে কতটা নির্বাচন মানুষ বর্জন করেছে। তবে সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ নির্বাচন পরবর্তী সময়টিই। বিশেষ করে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বড় মাথাব্যথা হিসেবে থাকবে সামনের বছরটি।
Advertisement
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও বিষয়টির কিছুটা আভাস পাওয়া গেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, টাকা পাচার, ব্যাংকিং খাতের দুরাবস্থা, ডলার সংকট, সরকারের আয়-ব্যয়ের অসামঞ্জস্যতালএবং দুর্নীতির মতো বিষয়গুলো নিয়ে বড় করে ভাবতে চাচ্ছে সরকার।
শীতকালে আলুর অস্বাভাবিক মূল্যই বলে দেয় বাজার কার্যত নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অর্থনীতির সাধারণ সূত্র বলে, বাজারে কোনো পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকলে সেই পণ্যের দাম বাড়ে; একইভাবে সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকলে দাম কমে। কিন্তু ভরা মওসুমে আলুর দাম এখন চালের চাইতেও বেশি। এরকম একটি পণ্য যখন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায় তখন প্রমাণ হয় যে সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি পুরো বাজার ব্যবস্থা। এ অবস্থা বহুদিন ধরে চলবে এবং সেটি যে নির্বাচনের পরও আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য ভাবনা হয়ে থাকবে সেটা নিশ্চিত। তবে বিষয়টি ভাবনার যদি সরকার সত্যি সত্যি ভাবতে চায়।
২০২১ সাল থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণহীন এবং খোদ বাণিজ্যমন্ত্রী যখন সংসদে দাঁড়িয়ে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাবেনা বলে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন তখন মানুষ আরও বুঝতে পারে যে পুরো ব্যবস্থা কাদের নিয়ন্ত্রণে। সেই বিবেচনায় সরকারের তরফ থেকে যখন বাজার নজরদারি জোরদার করার কথা বলা হয় তখন মানুষ আসলে কোনো আস্থা দেখেনা। নির্বাচনের পরে কি পরিস্থিতি কিছুটা হলেও বদলাবে? জানতে চায় মানুষ।
Advertisement
অর্থনীতিকে সঙ্গীন অবস্থা থেকে বের করে আনাই নতুন বছের চ্যালেঞ্জ। অর্থনীতি চালু রাখতে গেলে স্বাভাবিক করতে হবে ডলারের বাজার। ঘোষিত দামের চেয়ে বেশি দাম দিয়েও ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার বহু ধরনের পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করেছে। তবে ব্যবসা মহলে কান পাতলেই শোনা যায় আর্তনাদ যে এলসি খুলতে পারছে না। পণ্য আমদানি, মূলধন ও কাঁচামাল আমদানি, সেবা খাত, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত, বিদেশ ভ্রমণ ও চিকিৎসা খাত, বিদেশি ঋণ পরিশোধ, বিমান ভাড়াসহ বহু কারণে আরও নানা খাত ডলারের ওপর নির্ভরশীল। কেবল আমদানি খাতেই ব্যয় করতে হয় বছরে ৮৪ বিলিয়নেরও বেশি ডলার। এ বিপুল পরিমাণ ডলার ব্যয় করতে হলে দেশে ডলারের জোগান প্রয়োজন। সেটা নেই বহুদিন ধরে। ছোট ছোট ব্যবসা বলতে গেলে পথে বসেছে, বড়রাও ধুঁকছে। প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় না বাড়লে সংকট উত্তরণ সম্ভব নয়।
অর্থনীতির অন্যতম অঙ্গ ব্যাংক ও আর্থিক খাতে দুঃশাসন চলছে। অবাধে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেয়া, সরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালনায় রাজনৈতিক প্রভাব এবং বেসরকারি ব্যাংকের রাজনৈতিকভাবে প্রশ্রয় পাওয়া মালিকদের লুটপাট পরিস্থিতি নাজুক করে তুলেছে। বেশ কয়েকটি ব্যাংক লোপাট হয়ে গেছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ বলেছে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত থেকে গত ১৫ বছরের ৯২ হাজার কোটি টাকারও বেশি পাচার হয়েছে। অনিয়মের মাধ্যমে প্রভাবশালী মহল এই টাকা ব্যাংক থেকে বের করে নিয়েছে।
দেশ থেকে টাকা পাচার বড় উদ্বেগের জায়গা। এটি শাসক দলের ইশতেহারেও স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। অর্থ পাচার রোধে সরকার কি পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নিয়েছে সেটা দৃশ্যমান নয়। কি পদক্ষেপ নিবে সেটা দেখার অপেক্ষায় আমরা। অর্থ পাচার প্রতিরোধ, পাচার চিহ্নিতকরণ, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা এবং পাচারকারীর জবাবদিহি নিশ্চিত করা সব সময় ও সব দেশের জন্যই দুঃসাধ্য। কিন্তু সম্ভব যদি সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে। প্রয়োজনীয় আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নিতে হলে সরকারের ভিতরের থাকা ব্যক্তিদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আরেকটি হলো প্রভাবশালী পাচারকারীদের যেন সরকার ভয় বা প্রশ্রয় না দেয়।
সরকারের সবচেয়ে বড় সমস্যার একটি হলো আয়ের চাইতে ব্যয় বেশি। প্রতি বছরই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা থেকে পিছনে থাকছে। ফলে ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকিং খাত থেকে চড়া সুদে ঋণ নিচ্ছে সরকার। ঋণ নিতে হচ্ছে বৈদেশিক সূত্র থেকেও। বাংলাদেশ একদিকে সর্বোচ্চ মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির দেশ, আবার একই সঙ্গে কর-জিডিপির অনুপাতের দিক থেকে সর্বনিম্নে থাকা দেশের একটি। অর্থাৎ একদিকে জিডিপি অনেক বেশি হারে বাড়ছে ঠিকই, অন্যদিকে সে তুলনায় রাজস্ব আয় বাড়ছে না। আর এ কারণেই সরকারের হাতে অর্থ থাকে কম। ফলে খরচও করতে পারে না। বাংলাদেশের মানুষ কর দেয় কম। কর ফাঁকির পরিমাণ অনেক বেশি। কর ফাঁকির টাকা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেশে থাকে না, পাচার হয়ে যায়। প্রভাবশালীদের কর ফাঁকি বন্ধে সরকারের পদক্ষেপ একেবারে নেই বলা যায়। বরং বারবার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে সরকার কর ফাঁকিকে একপ্রকার উৎসাহ দিয়েই আসছে।
Advertisement
আর হলো দুর্নীতি যা এখন জাতির মাথাব্যথা। প্রকল্পে দুনীতি, ঘুষ, অনিয়ম, আত্মসাতসহ এমন কোনো বিষয় বাকি নেই যা ঘটছে না দেশে। সরকার সরকারি কর্মীদের তিন গুণ বেতন-ভাতা বাড়িয়েছে, কিন্তু এরপরও কোনো দুর্নীতি কমেনি, বরং বেড়েছে। যথেচ্ছাচারী প্রকল্প পরিচালক, দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মকর্তা, ব্যাংক লুটেরাদের বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় ছোট বড় সব দুর্নীতি বাড়ছে এবং দুর্নীতি করাই এখন বড় সার্থকতা বলে ধরে নেয়া হচ্ছে।
রাজনৈতিক নেতৃত্বে শেখ হাসিনা সফল। কিন্তু তার এখন মনোযোগ দিতে হবে অর্থনৈতিক নেতৃত্বে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।
এইচআর/এমএস