# নতুন বিধিমালায় প্রাথমিকে আসছে উচ্চতর ডিগ্রিধারী# দেড় লাখ মাস্টার্সধারীসহ উচ্চশিক্ষিত ৩ লাখ শিক্ষক# এসএসসি-এইচএসসি পাস সবার অবসর ২০৪০ সালে# উচ্চশিক্ষিত শিক্ষকদের প্রাথমিকে ধরে রাখা চ্যালেঞ্জিং
Advertisement
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে সবার আগে প্রয়োজন স্মার্ট নাগরিক। দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো এ নাগরিক গড়ার আঁতুড়ঘর হিসেবে কাজ করবে। এ লক্ষ্যে কাজ করছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা ঠিক কতটা স্মার্ট নাগরিক তৈরির উপযোগী তা নিয়ে রয়েছে নানান আলোচনা-সমালোচনা।
প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের এখন যারা পাঠদান করাচ্ছেন তাদের মধ্যে এসএসসি ও এইচএসসি পাস শিক্ষক প্রায় ৮০ হাজার। কিছু মৌলিক কোর্স ছাড়া তারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেননি। নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদানে চরম বিড়ম্বনায় এসব শিক্ষক। গত কয়েক বছর প্রাথমিকে উচ্চশিক্ষিত শিক্ষকের হার বাড়ছে। তবে যে সুযোগ-সুবিধা তারা পান তা তাদের এ পেশায় আটকে রাখার জন্য যথেষ্ট নয় বলে মত সংশ্লিষ্টদের।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বলছে, ১৯৯১ সালের বিধিমালায় নারী প্রার্থীরা এসএসসি পাস ও পুরুষরা এইচএসসি পাস হলেই প্রাথমিকের শিক্ষক হতে পারতেন। সেই সময়ে যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের নিয়েই এখন বড় বিপত্তি। এসএসসি ও এইচএসসি পাস শিক্ষকদের স্বাভাবিক নিয়মে অবসরে যেতে লাগবে আরও ১৪ বছর। এরপর শতভাগ স্নাতক ডিগ্রিধারী শিক্ষক পাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়।
Advertisement
আরও পড়ুন>> মাধ্যমিকের চেয়ে প্রাথমিকে ছুটি কম, শিক্ষকদের অসন্তোষ
অধিদপ্তরের সবশেষ তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৬৫ হাজার ৫৪৪টি। কর্মরত শিক্ষক আছেন তিন লাখ ৮৮ হাজারের কিছু বেশি। এর মধ্যে নারী শিক্ষক দুই লাখ ৫৩ হাজার ৬২৩ জন। পুরুষ শিক্ষক এক লাখ ৩৫ হাজার ২১৫ জন।
স্নাতকধারীর বাইরে তো এখন শিক্ষক খুব কম। যারা আছেন, তারা অন্যদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে নিজেদের দক্ষতা বাড়ানোর কাজ করছেন। আমরাও প্রশিক্ষণের আয়োজন করি। হাতে-কলমে তারাও শিখছেন। তবে এটা সত্য যে, শতভাগ উচ্চতর ডিগ্রিধারী পেলে তাদের দিয়ে কাজ বাস্তবায়ন আরও সহজ হবে।- প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, কর্মরত শিক্ষকদের মধ্যে স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) ডিগ্রিধারী রয়েছেন এক লাখ ৫৫ হাজার ৭৪২ জন। স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রিধারী ২২ হাজার ২৯৫ জন। আর স্নাতক (পাস কোর্স) এক লাখ ছয় হাজার ৩৯৮ জন। এমবিএ ডিগ্রিধারী পাঁচ হাজার ৫৫০, বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং এক হাজার ৪৮১, কামিল পাস পাঁচ হাজার ৭৪৯ জন। অন্যদিকে ফাজিল ডিগ্রিধারী দুই হাজার ৩১ জন, বিএসসি ইন এগ্রিকালচার ৩৭৯ জন, বিএসএস ডিগ্রিধারী ৯ হাজার ২২৩ জন। এছাড়া এলএলবি, এলএল ডিগ্রিধারীসহ উচ্চশিক্ষিত আরও সাড়ে ছয় হাজারের বেশি শিক্ষক রয়েছেন।
Advertisement
১৯৯১ সালের বিধিমালায় নিয়োগ পাওয়া এসএসসি ও এইচএসসি পাস শিক্ষক রয়েছেন প্রায় ৮০ হাজার। এর মধ্যে এইচএসসি পাস ৫৫ হাজার ৭৪৪ জন, এসএসসি পাস ১২ হাজার ৬৬৬ জন। আর মাদরাসা থেকে দাখিল ও আলিম পাস শিক্ষক রয়েছেন এক হাজার ৪১৭ জন। তারা পরবর্তীসময়ে বিভাগীয় অর্থাৎ অধিদপ্তরের অধীন কিছু প্রশিক্ষণ কোর্স ছাড়া আর উচ্চশিক্ষা নেননি।
আরও পড়ুন>> প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে প্রতি পদের বিপরীতে ১৩০ প্রার্থী
এসএসসি ও এইচএসসি পাস শিক্ষকদের নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কোনো কর্মকর্তা। তাদের ভাষ্য, ‘ওই সময়ের বিধিমালা মেনে তাদের চাকরি হয়েছে। তাদের অযোগ্যতা বা অদক্ষতা নিয়ে এখন কথা বলাটা বিধিসম্মত নয়। এতে তারা অপমানিত বোধ করতে পারেন। এখন তাদের স্বাভাবিক অবসরের জন্য অপেক্ষা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।’
প্রাথমিকে উচ্চতর ডিগ্রিধারীদের প্রবেশ যেভাবেএসএসসি ও এইচএসসি পাস করেই ‘খুব সহজে’ একসময় প্রাথমিকের শিক্ষক হওয়া যেত। যোগ্যতা বলতে দ্বিতীয় বিভাগ থাকলেই চলতো। ১৯৯১ সালের বিধিমালায় ছিল এমন বিধান। ফলে উচ্চশিক্ষিতরা এ পেশায় আসতে চাইতেন না। তবে সরকারি চাকরিতে পরপর দুটি বেতন কাঠামো হওয়ার পর সেই দৃশ্যপট পাল্টে যায়। চাকরির বাজারের প্রতিদ্বন্দ্বিতাও বাড়তে থাকে। উচ্চশিক্ষিতরা প্রাথমিকে শিক্ষক হতে ব্যাপকহারে আবেদন করতে শুরু করেন।
পরিস্থিতি বুঝে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের আবেদন যোগ্যতায় পরিবর্তন আনে সরকার। ২০১৩ সালে বিধিমালায় পরিবর্তন আনা হয়। এতে পুরুষ প্রার্থীদের ক্ষেত্রে স্নাতক বা সমমানের ডিগ্রির কথা বলা হলেও নারীদের ক্ষেত্রে ছিল ভিন্ন। নারী প্রার্থীদের ক্ষেত্রে এইচএসসি পাস হলেই চলতো।
সবশেষ ২০১৯ সালের নীতিমালা অনুযায়ী—নারী ও পুরুষ উভয় প্রার্থীর জন্যই স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি বা সমমানের সিজিপিএসহ স্নাতক বা সমমানের ডিগ্রি থাকার বিধান করা হয়। ফলে সবশেষ কয়েকটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে যারা প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের সবারই সর্বনিম্ন যোগ্যতা স্নাতক।
আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গড়ার ভিত প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়তে অবশ্যই উচ্চশিক্ষিত ও স্মার্ট শিক্ষক প্রয়োজন। আমরা মেধা ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে সেই শিক্ষক বেছে নিতে কাজ করছি।- প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ
জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পলিসি অ্যান্ড অপারেশন বিভাগের পরিচালক মনীষ চাকমা জাগো নিউজকে বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষক জরুরি। দ্রুত সবকিছু বদলে যাচ্ছে, এর সঙ্গে তাল মেলানোর মতো মানসিকতা থাকা দরকার। এজন্য আমরা উচ্চশিক্ষিতদের এখন প্রাথমিকে স্বাগত জানাচ্ছি। তাদের হাত ধরেই প্রাথমিক শিক্ষার মানে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।’
শতভাগ স্নাতকধারী মিলবে ১৪ বছর পরপ্রাথমিকে এখন অধিকাংশ শিক্ষকই উচ্চতর ডিগ্রিধারী। তাদের মাধ্যমে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন তুলনামূলক সহজ হবে। তবে এসএসসি-এইচএসসি পাস ৮০ হাজার শিক্ষক দিয়ে এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জিং। তাদের স্বাভাবিক অবসরের জন্য অপেক্ষা করছে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন।
আরও পড়ুন>> ‘ঘুস দিয়ে প্রাথমিকে শিক্ষক হওয়ার সুযোগ নেই, মেধা-যোগ্যতায় নিয়োগ’
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বলছে, এসএসসি ও এইচএসসি পাস শিক্ষকদের চাকরি জীবন শেষের দিকে। চার বছর পর এ সংখ্যা কমে আসবে। আগামী চার বছরে অবসরে যাবেন প্রায় ২২ হাজার শিক্ষক। আর বাকিদের অবসরে যেতে লাগবে আরও ১৪ বছরের মতো সময়। ফলে প্রাথমিকে শতভাগ স্নাতক ডিগ্রিধারী শিক্ষক পেতে আরও এক যুগের বেশি অপেক্ষা করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্নাতকধারীর বাইরে তো এখন শিক্ষক খুব কম। যারা আছেন, তারা অন্যদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে নিজেদের দক্ষতা বাড়ানোর কাজ করছেন। আমরাও প্রশিক্ষণের আয়োজন করি। হাতে-কলমে তারাও শিখছেন। তবে এটা সত্য যে, শতভাগ উচ্চতর ডিগ্রিধারী পেলে তাদের দিয়ে কাজ বাস্তবায়ন আরও সহজ হবে।’
উচ্চশিক্ষিত শিক্ষক প্রাথমিকে রাখার চ্যালেঞ্জপ্রাথমিকে উচ্চশিক্ষিতরা চাকরি নিলেও তাদের নজর থাকে অন্য সরকারি চাকরির দিকে। সরকারি চাকরির বয়স থাকা পর্যন্ত তারা প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। অনেকেই প্রাথমিকে চাকরি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যান। এর নেপথ্যে রয়েছে আর্থিক সুবিধা ও পদোন্নতি না থাকা। প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের ৮০ শতাংশ একই পদে থেকে অবসরে যান। মাস্টার্স পাস করে এসে তারা যে বেতন বা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন, অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে তার ব্যবধান অনেক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নবম গ্রেডে যোগদানের পর ১১ বছরেই অধ্যাপক পর্যন্ত পদোন্নতি পান। কলেজের শিক্ষকরা নবম গ্রেডে যোগদানের পর পদ শূন্য সাপেক্ষে অধ্যাপক পর্যন্ত পদোন্নতি পান। মাধ্যমিকের শিক্ষকরা দশম গ্রেডে যোগদানের পর উপ-পরিচালক পর্যন্ত পদোন্নতি পান। কিন্তু একই যোগ্যতা নিয়ে প্রাথমিকের শিক্ষকদের অধিকাংশই ‘সহকারী শিক্ষক’ পদে থেকেই অবসরে যাচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সবশেষ ২০২২ সালের ডিসেম্বরে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে ৩৭ হাজার ৫৭৪ জন প্রার্থীকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করা হয়। তবে চাকরি পেয়েও যোগ দেননি দুই হাজার ৫৫৭ জন। তাদের মধ্যে এক হাজার ৯০২ জন কাগজপত্র জমা দিয়েও পরে আর প্রাথমিকে শিক্ষক পদে যোগ দেননি। তাদের অধিকাংশই অন্য সরকারি চাকরিতে চলে গেছেন।
সবশেষ নিয়োগে নির্বাচিত হয়ে নরসিংদী সদর উপজেলার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ দেন রায়হান আহমেদ। তিনি বলেন, ‘শিক্ষকতা করার শখ ছিল বলেই এখানে যোগ দিয়েছি। বেতন যাই হোক, ইচ্ছে ছিল এটিইও হবো, শিক্ষা প্রশাসনে কাজ করবো। এখন দেখছি—১০ বছরের আগে এটিইও হতে আবেদনই করা যাবে না। অথচ অন্য সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বিভাগীয় প্রার্থীদের দুই বছর পরই পদোন্নতির সুযোগ দেওয়া হয়।’ সামনে তার ৪৫তম বিসিএসে লিখিত পরীক্ষা। সেখানে ভালো কিছু হলে হয়তো তিনি প্রাথমিকে শিক্ষকতা করবেন না বলেও জানান।
দশম গ্রেড চান উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষকরাসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে যারা যোগ দেন, শুরুতেই ১৩তম গ্রেডে বেতন পান তারা। মূল বেতন ১১ হাজার টাকা। এর সঙ্গে বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, টিফিন ভাতা ও যাতায়াত ভাতা রয়েছে। মূল বেতনের বাইরে একজন নতুন সহকারী শিক্ষক চিকিৎসা ভাতা ১ হাজার ৫০০ টাকা, টিফিন ভাতা ২০০ টাকা ও যাতায়াত ভাতা ৩০০ টাকা পাবেন। বাড়িভাড়া মূল বেতনের ৬০ থেকে ৪৫ শতাংশ।
দীর্ঘদিন ধরে প্রাথমিকের শিক্ষকরা দশম গ্রেড পেতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এনিয়ে সরকারের কোনো পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষকদের দশম গ্রেড বাস্তবায়ন কমিটির সমন্বয়ক মু. মাহবুবর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘সরকার যদি আমাদের এ দাবি মেনে নিতো, তাহলে প্রাথমিকে উচ্চশিক্ষিতরা থেকে যেতেন। এখানে চাকরির পর আর তারা নতুন করে চাকরির পেছনে ছুটতেন না।’
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ বলেন, ‘আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গড়ার ভিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গড়তে অবশ্যই উচ্চশিক্ষিত ও স্মার্ট শিক্ষক প্রয়োজন। আমরা মেধা ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে সেই শিক্ষক বেছে নিতে কাজ করছি।’
উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষকরা বেতন বৈষম্য ও পদোন্নতি না থাকায় চলে যাচ্ছেন—বিষয়টি দৃষ্টিগোচর করা হলে সচিব বলেন, ‘আমি বরাবরই বলে আসছি, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে স্মার্ট নাগরিক তৈরি করবে প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেটা বাস্তবায়নে সরকার সব কিছুই করবে। আগামীতে তাদের বেতন কাঠামো ও পদোন্নতি নিয়ে আমরা কাজ করবো।’
এএএইচ/এএসএ/এমএস