দেশজুড়ে

হাজারো পরিবারে সচ্ছলতা ফিরিয়েছে যে ছাগল

প্রায় ৮ বছর আগে শখের বশে প্রথমে দুটি ব্ল্যাক বেঙ্গল (কালো জাতের) ছাগল কিনে বাড়িতেই পোষা শুরু করেন চুয়াডাঙ্গা সদরের সরিষাডাঙ্গা গ্রামের খালেক নামের এক যুবক। বর্তমানে তার বাড়িতেই ৫০টির বেশি ছাগল আছে। বলা যায় তার বাড়িটিই এখন মাঝারি খামার। এখান থেকে বছরে মোটা টাকা আয় হয় তার।

Advertisement

খালেক শাহ’র মতোই চুয়াডাঙ্গার বেকার তরুণ-তরুণী, যুবক ও নতুন উদ্যোক্তা এবং দরিদ্র কৃষকরা ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন করে জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি পুষ্টি সরবরাহের কাজেও অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন।

চুয়াডাঙ্গা জেলায় দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রেখে চলেছে ব্ল্যাক বেঙ্গল (কালো জাতের) ছাগল পালন। এই অঞ্চলের গ্রামীণ জনপদের প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে কালো ছাগলের ছোট-বড় খামার করে অনেকেই স্বাবলম্বী। বিশ্বখ্যাত কালো জাতের ছাগল পালন করে এ জেলার কৃষি পরিবারসহ অস্বচ্ছল পরিবারেও ফিরেছে সচ্ছলতা।

বাংলাদেশের স্থানীয় জাত ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল মানের দিক থেকে বিশ্বসেরা হিসেবে স্বীকৃত। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থা এফএও এবং আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা আইএইও ২০১৫ সালের মূল্যায়ন অনুযায়ী ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল বিশ্বের অন্যতম সেরা জাত। আন্তর্জাতিক বাজারে এই ছগল ‘কুষ্টিয়া গ্রেড’ হিসেবে পরিচিত। তবে বর্তমানে বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার অংশ অধুনা চুয়াডাঙ্গা জেলায় এই ছাগল বেশি পালন হওয়াতে জেলা প্রশাসন থেকে চুয়াডাঙ্গা জেলা ব্র্যান্ডিং হিসেবে ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল’ ঘোষণা করা হয়েছে।

Advertisement

চুয়াডাঙ্গার গ্রামীণ অর্থনীতির চিত্র বদলে যাচ্ছে ব্ল্যাক বেঙ্গল (কালো জাতের) ছাগল পালনে। বিশ্বখ্যাত এই ছাগল পালন করে এখানকার কৃষি পরিবারগুলোতে এসেছে আর্থিক সচ্ছলতা। প্রায় সব বাড়ির উঠানেই দেখা মেলে এই জাতের ছাগল। অনেক বাড়িতে আলাদা ঘর করে মাচায় ছাগল পালন করতে দেখা যায়। উঠানে বা মাচায় চলছে ছাগল লালন-পালন। অনেক খামারি ২০ থেকে ৩০টি ছাগল পালন করে বছরে দুই থেকে তিন লাখ টাকা আয় করেন। এতে অনেকেরই পাল্টে গেছে জীবনযাত্রা।

ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাড়াও চুয়াডাঙ্গায় চোখে পড়ে তোতামুখী, হরিয়ানা, যমুনাপাড়ি ও বিটল জাতের ছাগল। তবে এর মধ্যে ৭০ ভাগই ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল। এই অঞ্চলের বেকার তরুণ-তরুণী, যুবক ও নতুন উদ্যোক্তা এবং দরিদ্র কৃষকরা ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন করে জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি পুষ্টি সরবরাহের কাজেও অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন।

চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের পৌর কলেজ পাড়ায় ১৯৯৬ সালে ১০ একর জমির ওপর গড়ে ওঠে সরকারি ছাগল উন্নয়ন খামার। এ খামারের উদ্দেশ্য ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের জাত সংরক্ষণ। ২২৫টি মা ছাগি ও ৫০টি পাঠা নিয়ে যাত্রা শুরু হয় ছাগল খামারটির। পাঁঠা, বাড়ন্ত ছাগল ও ছাগি পালন করা হয় ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের। ছাগি প্রজননের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে লোকবল কম থাকায় ছাগল খামারের কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। পর্যাপ্ত লোকবল থাকলে ছাগল উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব বলে জানালেন এখানকার কর্মীরা।

এক হাজার ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এই খামারে বর্তমানে ৬৭৬টি ছোট-বড় ছাগল আছে। এ পর্যন্ত খামার থেকে ৪ হাজার পাঁঠা ও ২ হাজার ছাগি বিতরণ করা হয়েছে।

Advertisement

ছাগল উন্নয়ন খামার থেকে খামারিদের প্রত্যেকটি পাঁঠা ১ হাজার ২০০ টাকা ও ছাগি ১ হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ছাগল পালন সহজ ও লাভজনক। ছাগলের জন্য খাদ্য হিসেবে দেওয়া হয় ঘাস, ভুট্টা, খেসারি, গমের ভুসি, সয়াবিনের খৈল, ছোলাসহ বিভিন্ন দানাদার খাবার। ছাগি ১৩-১৪ মাসে বাচ্চা দেওয়া শুরু করে। বছরে দুই বারে ৪-৬টি বাচ্চা দেয় একটি ছাগি।

ছাগল পালনকারীরা জানান, এ জাতের ছাগল পালন লাভজনক ব্যবসা। সংসারসহ অন্য খরচ বহন করা সম্ভব হয়। বাড়িতে অল্প জায়গায়, কম খরচে ছাগল লালনপালন করা যায়। ছাগলের রোগবালাই কম। প্রাণিসম্পদ অফিস থেকেও তারা সহযোগিতা পেয়ে থাকেন। বছরে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা আয় হয়।

চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলায় বছরে প্রায় পাঁচ লাখ ছাগল উৎপাদন হয়ে থাকে। এর থেকে প্রাই ২৩ হাজার মেট্রিক টন মাংস উৎপাদিত হয়। বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি ছাগলের মাংসের দাম প্রকারভেদে ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকা কেজি। সে হিসাবে জেলায় ছাগলের মাংস ও চামড়া বিক্রি করে বছরে আয় হচ্ছে দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি। এছাড়া ছাগলের চামড়া বিক্রি করেও মোটা অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়ে থাকে। ফলে আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটছে এ জেলার মানুষের। এছাড়া ছাগল উন্নয়ন খামার থাকায় সহজে উন্নত জাতের ছাগি ও পাঁঠা সংগ্রহ করা যায় সহজে। এতে ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের প্রজনন বৃদ্ধিও সহজ এখানে। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের প্রাণী বিশেষজ্ঞদের মতে, এই জাতের ছাগলের রোগব্যাধি বলতে শীতকালে ঠান্ডাজনিত রোগ ছাড়া তেমন কোনো রোগবালাই হয় না। যদি রোগ হয়, প্রাণিসম্পদ দফতরের প্রশিক্ষিত চিকিৎসক রয়েছেন। তারা সার্বিক সহযোগিতা করে থাকেন। ছাগলের রোগবালাই কম। পিপিআর রোগপ্রতিরোধের জন্য ভ্যাকসিন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ছাগল পালনকারীদের খাবার ও ওষুধ দেওয়া হয় বিনামূল্যে। গোট রিচার্স সেন্টার ও কৃত্রিম প্রজননকেন্দ্র স্থাপন করা গলে এ জাত সংরক্ষণ সম্ভব হবে। খামারে রয়েছে ৮টি শেড, একটি রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র, কোয়ার্টার ও অফিস।

জেলার এই ঐতিহ্যবাহী ব্ল্যাক বেঙ্গল জাত সংরক্ষণে চুয়াডাঙ্গা তথা দেশের বৃহৎ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ওয়েভ ফাউন্ডেশন দামুড়হুদা উপজেলার কোষাঘাটায় ৩৫ বিঘা জমির ওপর একটি মিশ্র খামারে ব্ল্যাক বেঙ্গল জাত সংরক্ষণে আধুনিক পদ্ধতিতে ছাগি ও পাঁঠার উৎপাদনসহ বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করছে। ছাগল পালনের ওপর এলাকা ও দেশের আগ্রহী যুবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও রেখেছে তারা।

এ বিষয়ে কথা হয় এনজিও ওয়েব ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক জহির রায়হানের সঙ্গে। তিনি বলেন, বিশ্বখ্যাত ব্ল্যাক বেঙ্গল চুয়াডাঙ্গার এক স্বনামধন্য ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যের সমাদর শুধু দেশেই না, পৃথিবীজুড়ে চুয়াডাঙ্গার কালো ছাগলের চাহিদা রয়েছে। এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে সরকারের পাশাপাশি ওয়েভ ফাউন্ডেশনও এর বংশবৃদ্ধিতে কাজ করছে। আমি মনে করি, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল চুয়াডাঙ্গার একটি সম্পদ। এখানকার মানুষের দৈনন্দিন জীবন-জীবিকার সঙ্গে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

তিনি বলেন, জেলায় কমবেশি প্রায় সব বাড়িতেই এই ছাগল পালন হয়ে থাকে। এটাকে আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পালনে যদি সহযোগিতা করা যায় তাহলে এ অঞ্চলের মানুষ আরও বেশি স্বাবলম্বী ও সমৃদ্ধ হতে পারবে।

ওয়েভ ফাউন্ডেশন থেকে ঋণ নিয়ে ৪টি ছাগল কিনে যাত্রা শুরু করেছিলেন চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার সাতগাড়ি গ্রামের স্বামী পরিত্যাক্তা রোকসানা খাতুন। ছয় বছরের ব্যবধানে তার খামারে এখন ৮০টি ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল রয়েছে। এখন তার সংসারে এসেছে স্বচ্ছলতা। তার মতো হাজারো পরিবার আছে, যাদের জীবনযাত্রা পাল্টে গেছে এই জাতের ছাগল লালন-পালন করে।

জীবনগর উপজেলার মিঠুন মাহমুদ বলেন, আমি একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। পড়াশোনার পাশাপাশি ছয় বছর ধরে ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল পালন করে আসছি। এখন আমি স্বাবলম্বী। ছাগল বিক্রি করে বছরে অনেক টাকা আয় করছি। বেকারত্ব ঘুচিয়েছি। সরকারিভাবে সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি। আরও সুযোগ-সুবিধা পেলে আমরা বাণিজ্যিকভাবে ছাগল পালন করতে পারবো।

তিনি বলেন, বেকার যুবক ও তরুণ উদ্যোক্তারা পড়াশোনার পাশাপাশি এই ছাগল পালন করতে পারেন। অল্প সময়ের মধ্যে ভালো আয়ের সুযোগ হতে পারে এই জাতের ছাগল।

চুয়াডাঙ্গা ছাগল উন্নয়ন খামারের প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আরমান আলী বলেন, খামারটি সুনামের সঙ্গে চলছে। ছাগল উৎপাদন প্রতি বছর ভালোই হয়। বর্তমানে লোকবল কম রয়েছে। ছাগলের চাহিদা রয়েছে অনেক। জেলার একটি ব্যান্ড ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল। জেলার ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটের জাত সংরক্ষণে ১৯৯৬ সালে চুয়াডাঙ্গায় ছাগল উন্নয়ন খামার প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিবছর এ খামার থেকে খুলনা বিভাগের ১০টি জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্ধারিত মূল্যে ছাগল সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এ খামারে প্রায় ১ হাজার ছাগল পালন করা হয়।

চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বলেন, চুয়াডাঙ্গা জেলার প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। এই গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য ও আমিষের চাহিদা পূরণে এই কালো জাতের ছাগল পালন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। জেলায় ছাগলের মাংস ও চামড়া বিক্রি করে বছরে আয় হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। আর চুয়াডাঙ্গাকে ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটের জন্য একটি অভয়াশ্রম বলা যায়। এখানকার উষ্ণ অনুকূল আবহাওয়ার কারণে ছাগল পালনের ক্ষেত্রে এটা সব থেকে উপযোগী এলাকা। ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটের জাত সংরক্ষণে সরকারের উদ্যোগ রয়েছে। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল (কালো জাত) হলো চুয়াডাঙ্গার ব্র্যান্ড।

এফএ/জিকেএস